Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন : গণতন্ত্র, গণমাধ্যম ও স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য হুমকি

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

স্বাধীন সাংবাদিকতা ও দলনিরপেক্ষ গণমাধ্যম আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামো এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। মার্কিন সিভিল ওয়ারের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজে যে সিভিল সোশ্যাইটির উন্মেষ ঘটেছিল তার মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীন গণমাধ্যম। কর্পোরেট পুঁজিবাদের আধিপত্য ক্রমবিস্তারিত হয়ে পড়ার সাথে সাথে মূলধারার কিছু গণমাধ্যম এসব কর্পোরেট স্বার্থের তল্পিবাহক হয়ে পড়লেও গণতান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্রশক্তি কখনো কখনো গণমাধ্যম দাবিয়ে রাখার চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। বিশেষত: পশ্চিমা সমাজে গণমাধ্যম রাষ্ট্র ও সরকারের স্বার্থের চাইতে সিভিল সোশ্যাইটি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ ও সমর্থনের কথা সমীহ করেই পথ চলেছে। গাল্ফ ওয়ার এবং ওয়ার অন টেররিজমের প্রোপাগান্ডায় তথাকথিত এম্বেডেড জার্নালিজমের প্রচলন মূলধারার গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিকল্প ও স্বাধীন গণমাধ্যমের তৎপরতাকে কোন রাষ্ট্রশক্তি কখনো বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। বিশ্বের প্রধান শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্ত গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী রিপোর্টের কারণে প্রেসিডেন্টের গদি উল্টে যেতে দেখা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাটি ঘটেছিল সত্তুরের দশকে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের শাসনামলে। হোয়াইট হাউজের কিছু অতি উৎসাহী দলবাজ রাজনৈতিক কর্মচারী ১৯৭২ সালের নির্বাচনে নিক্সনকে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বিরোধিদলের কর্মকান্ডের উপর নজরদারির ব্যবস্থা করেছিল। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে জুন মাসের ১৭ তারিখ ভোরবেলা নিরাপত্তা রক্ষিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াটারগেট হোটেলের ৬ তলায় অবস্থিত ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির কার্যালয়ে ঢুকে পড়েন ৫ ব্যক্তি। তারা ডেমোক্রেটিক পার্টির গুরুত্বপূর্ণ ফাইলপত্রের ছবি তুলেছিল এবং অফিসের টেলিফোনে আড়িপাতার যন্ত্র বসিয়েছিল। অবশেষে হোটেলে একজন নিরাপত্তা রক্ষির টহলে ডেমোক্রেট পার্টির অফিসে অনুপ্রবেশের ঘটনা নিশ্চিত হয়ে তিনি পুলিশে খবর দেন। পুলিশ অনুপ্রবেশকারিদের কাছ থেকে জব্দ করে ২৩টি ১০০ ডলারের নোট. অর্থাৎ ২৩০০ ডলার। এই ডলারের সুত্র ধরেই তদন্ত শুরু করার পর কেলেঙ্কারীর সাথে হোয়াটহাউজ ও প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সম্পৃক্ততা বেরিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন সিনেট কমিটি ও এফবিআই’র তদন্তের চেয়ে দুই তরুন অনুসন্ধানী সাংবাদিক কার্ল বার্নস্টেইন ও বব উডয়ার্ড গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছিলেন। অনুপ্রবেশকারিদের কাছ থেকে জব্দ করা ডলারগুলো নিয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, নিক্সনের নির্বাচনী ব্যয়ের জন্যই এই ডলারগুলো ব্যাংক থেকে উঠানো হয়েছিল। তবে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির তদন্তে সিআইএ, এফবিআই’র সাথে পেশাদার ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মধ্যে এক ধরনের ঠান্ডা লড়াই ও প্রতিদ্বন্দিতা স্পষ্ট হয়ে পড়েছিল। সরকারী সংস্থাগুলোর নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ না হলেও নিক্সনের মুখপাত্র প্রতিনিধিদের সাথে গণমাধ্যম কর্মীদের অন্তর্দ্বন্দ ‘নিক্সন বনাম প্রেস’ অভিধায় ভ’ষিত হয়েছিল। ওয়াটারগেট কেলঙ্কারির ঘটনা গণমাধ্যমে ঝড় তোলার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিপুল ভোটের ব্যবধানে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হন। তবে অনুসন্ধানী সংবাদকর্মীরা ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির খুঁটিনাটি বিষয় এবং তদন্তের সামগ্রিক অগ্রগতি সম্পর্কে ওয়াশিংটন পোস্টে রিপোর্ট প্রকাশ অব্যাহত রাখেন। এ ক্ষেত্রে গোপণ সুত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উৎস হিসেবে ‘ডিপ থ্রোট’ ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সাংবাদিক তার সুত্র প্রকাশ করতে বাধ্য নন। সিনেট তদন্ত কমিটির কাছে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির পুরো ঘটনা খোলাসা হয়ে পড়ার পর সিনেটে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিসংসনের প্রস্তাব গৃহিত হয়। তবে ভোটাভুটিতে যাওয়ার আগেই দ্বিতীয় মেয়াদের পৌনে দুই বছরের মাথায় ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট নিক্সন পদত্যাগ করে হোয়াইট হাউজ ছাড়তে বাধ্য হন। তার বিরুদ্ধে আনীত মামলা চালু থাকাবস্থায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণকারী সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড নিক্সনের ক্ষমার আদেশ জারি করেন। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির তথ্য সুত্র ডিপ থ্রোট সম্পর্কে প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে কেউ কিছু জানতে না পারলেও ২০০৫ সালে মার্ক ফেল্ট নামের এক সাবেক সিআইএ এজেন্ট নিজেকে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির তথ্য প্রদানকারী ‘ডিপ থ্রোট’ বলে দাবী করেন। এর অনেক আগেই কার্ল বার্নস্টেইন এবং বব উডর্য়াড সাহসী ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য পুলিৎজার পুরস্কারে ভ’ষিত হয়েছিলেন। ক্ষমতার রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি-অপকর্মের বিরুদ্ধে স্বাধীন সাংবাদিকতা এক বড় প্রতিবন্ধক। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির তথ্য উদঘাটন এবং নিক্সনের পদত্যাগ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা একদিকে সংবিধানের দোহাই দিয়ে নিজেদের অধীনে নিজেদের নিয়োগকৃত নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের মাধ্যমে নির্বাচন করার সব রকম প্রস্তুতি নিয়েছে। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে জনগনের সামনে উন্নয়নের মডেল এবং আগামীদিনের জন্য বিশাল প্রতিশ্রুতির উপর সম্ভবত এখন আর আস্থা রাখতে পারছেনা তারা। মূলধারার গণমাধ্যমের উপর নানাভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা প্রায় অসম্ভব হওয়ায় সরকার এখন একটি ভীতিকর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আশ্রয় নিতে চাইছে। ইতিপূর্বে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে দেশে অনেক হইচই, আন্দোলন হয়েছে। দেশের সাংবাদিক সমাজ বহুদিন ধরেই রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত। গণমাধ্যমকর্মীরা ক্ষমতাসীন আওয়মীলীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক দর্শনে বিভক্ত হয়ে পড়ার কারণে সংঘশক্তি হিসেবে তারা অনেক দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে সরকার সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার নীতি বিরোধি নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক আইন ও নির্বতনমূলক তৎপরতা চালানোর সুযোগ পাচ্ছে। দেশের সব গণমাধ্যমের মালিক ও সাংবাদিকরা রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত না হলে এটা মোটেও সম্ভব হতো না। বিতর্কিত আইসিটি আইনের সাতান্ন ধারায় ইতিমধ্যে শত শত মামলা হয়েছে এবং এসব মামলার বেশীরভাগই মূলত রাজনৈতিক কর্মী ও সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে। তবে নির্বাচনের মাত্র তিনমাস আগে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ পাস করেছে। এটি পূর্বের যে কোন কালাকানুনের চেয়ে বেশী বিতর্কিত ও নির্বতনমূলক বলে বিবেচিত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তৃতি, দেশের কোটি কোটি মানুষ ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে যুক্ত হওয়ায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এখন আর শুধুমাত্র সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম কর্মীদের বিষয় হিসেবে সীমাবদ্ধ নয়। এ ধরনের আইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে যুক্ত যে কোন ব্যক্তির উপর পুলিশি খবরদারি ও হেনস্তা করার সুযোগ করে দিতে পারে। তা’ছাড়া এখনকার প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্র এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া অনলাইন, ফেইজবুকের সাথে সংযুক্ত থাকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় যে কাউকে যখন তখন পুলিশি হয়রানির সুযোগ থাকায় আইন নিয়ে সমাজে এক ধরনের ভীতির জন্ম দিয়েছে। সরকারীদল ও জোটের সমর্থক ও বর্তমান সরকারের বেনিফিশিয়ারিরা এ ধরনের আইনে ভীত সন্ত্রস্ত না হয়ে বিরোধি মত দমনে একটি প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। তবে পেশাদার সাংবাদিক, গণমাধ্যমকর্মী, সংবাদপত্রের মালিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সচেতন ব্যবহারকারীরা এ ব্যাপারে সোচ্চার ভ’মিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। গত বুধবার জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিল পাসের আগে সংসদে অবস্থানরত বিরোধিদল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরাও বিলটি পাসের আগে আরো যাচাই-বাছাই, স্টেকহোল্ডার ও জনমতের জন্য পাঠানোর প্রস্তাব রেখেছিল। দেশের বিশিষ্ট্যি নাগরিক, সম্পাদকবৃন্দের অনেকে, আইনজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এই আইনকে সাংবিধানিক অধিকারের লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর বড় আঘাত বলে দাবী করেছেন। আইনের খসড়া সংসদে পাস হওয়ার আগেই সম্পাদক পরিষদ এই আইন প্রত্যাখ্যান করেছিল। সংসদে পাস হওয়ার পর সাংবাদিক সংগঠনগুলো এই আইনের প্রতিবাদে রাজপথে প্রতিবাদ বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রতিবাদে সম্পাদক পরিষদ আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে যে মানব বন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন(ডিইউজে) এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন(বিএফএইউজে)ও তাতে সমর্থন জানিয়ে সাংবাদিকসহ সব শ্রেনী পেশার মানুষকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাধীন সাংবাদিকতা, মুক্ত গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাংবিধানিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা লঙ্ঘন করে মানুষের কণ্ঠরোধের এই আইন দেশের সব সাংবাদিক, গণমাধ্যমকর্মী ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য ঘুচিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে এনে দাঁড় করিয়েছে। এটি শুধু মুক্ত গণমাধ্যম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিক ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে নাগরিক নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, আইনের শাসন ও সভ্য দুনিয়ায় জাতির আত্মপরিচয়ের স্বার্থ।
বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। দেশের অর্থনীতি, ব্যবসায় বাণিজ্য ও সামাজিক যোগাযোগ এখন তথ্যপ্রযুক্তির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কোন মাধ্যমের সাথে অর্থনীতি ও জনসম্পৃক্ততা বাড়লে তার সাথে দুর্নীতি ও অপরাধ প্রবণতার মাত্রাও বাড়তে পারে, এটাই স্বাভাবিক। ইউরোপ-আমেরিকাসহ শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ইন্টারনেটের অ্যাকসেস ও ব্যবহার আমাদের দেশের চেয়ে অনেক বেশী। আমাদের সরকার ১০ বছর আগে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প ঘোষণা করলেও এখনো ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের দিক থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়েও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। ভারতের জাতীয় অর্থনীতির এক বড় অংশই তথ্যপ্রযুক্তি রফতানী থেকে আসে। চীন ও ভারতের মত বিশাল অর্থনীতির শতকোটি মানুষের দেশে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারকারী এবং এ সংক্রান্ত অপরাধের মাত্রাও অনেক বেশী হওয়ার কথা। তবে বিষ্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে পশ্চিমা শিল্পোন্নত বা আমাদের এশীয় প্রতিবেশী কোন দেশই বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত আইন তৈরী করেনি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে চাইলে সাংবিধানিক নিরাপত্তা ও বাধ্যবাধকতার কারণেই এ ধরনের আইন তৈরীর কোন সুযোগ নেই। গত ১৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, সম্পাদক ও আইন বিশেষজ্ঞরা একে কালো আইন আখ্যা দিয়ে দেশের গণমাধ্যম, স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য একটি দু:খজনক কালোদিবস বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে ডাক টেলিযোগযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী এ ধরনের আইন পাস করতে পেরে নিজেকে গর্বিত বোধ করছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি এ জন্যও গর্বিত যে বাংলাদেশই প্রথম এ ধরনের আইন তৈরী করল। এই আইনে কোন পরোয়ানা ছাড়াই যে কাউকে গ্রেফতারের সুযোগ দেয়া হয়েছে পুলিশকে। যে দেশে এমনিতেই প্রতি বছর পুলিশের অপরাধ প্রবণতান বাড়ছে। নানা অভিযান ও রাজনৈতিক আন্দোলন দমন ও কল্পিত নাশকতার অভিযোগে পুলিশি আটক ও গ্রেফতার বাণিজ্যের শিকার হয় হাজার হাজার মানুষ সেখানে, দেশের গণমাধ্যম কর্মী এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত কোটি কোটি মানুষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও আইসিটি আইনে আপত্তিজনক, নির্বতনমূলক ধারা সন্নিবেশিত করে পুলিশের হাতে সহজ নতুন অস্ত্র তুলে দেয়া হচ্ছে। মূলত সরকারের সমালোচক এবং বিরোধিদলের নেতাকর্মীরাই এই আইনের মূল টার্গেট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সাথে সাথে সড়ক নিরাপত্তা আইনও সংসদে পাস হয়েছে। অদক্ষ ও বেপরোয়া চালকদের কারণে প্রতিদিন সড়কে অসংখ্য প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে কুর্মিটোলায় রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাস চাপায় নিহত হওয়ার পর ঢাকাসহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবীতে রাজপথে নেমে আসে। দেশের নাগরিক সমাজ বেপরোয়া গাড়ী চালনায় দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের কঠোর শাস্তির বিধানের দাবী জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। সদ্য পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইনে দুর্ঘটনাজণিত হত্যাকান্ডের জন্য ৫ বছরের সাজার বিধান রাখা হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার ও রাষ্ট্র বিরোধি লেখা বা কমেন্টের জন্য সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং লাখটাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছে। এ কথা ভুলে গেলে চলবেনা যে, সরকার ও রাষ্ট্র এক জিনিস নয়। সরকারের সমালোচনা রাষ্ট্রের বিরোধিতা নয়। বর্তমান সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকান্ডে রাষ্ট্র ও সরকারের ধারণা গুলিয়ে যাচ্ছে। জনগণ ভুল বার্তা পাচ্ছে।
ডিজিটালাইজেশনের পথ ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকে হাজার কোটি টাকা চুরি হয়ে গেছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকেও হ্যাকাররা টাকা চুরি করছে। এসব ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা খুবই জরুরী বিষয়। তবে আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধিতার সাথে এসব বিষয়ের কোন সম্পর্ক নেই। আইনের যে সব ধারা রাজনৈতিক কারণে অপব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে এবং যে সব ধারা পুলিশকে বিনা ওয়ারেন্টে যে কোন নাগরিককে ধরপাকড়ের সুযোগ দিতে যাচ্ছে, সে সব ধারা নিশ্চিতভাবেই নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিবে। সভ্য দুনিয়ার কোথাও এ ধরনের আইন নেই। আমরা যখন দেশে একটি রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি, সরকার যখন সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে ফেলেছে, এসব অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগন নিজেদের মধ্যকার অনেক রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়তে যাচ্ছে। তখন সরকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকারের টুটি চেপে ধরতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে পুলিশের হাতে নিপীড়ন-হয়রানির ব্লাঙ্ক চেক তুলে দিতে চাইছে। যা’তে সরকারের ও সরকারী দলের অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ কোন মন্তব্য করতে বা লিখতে সাহস না পায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এমন রাজনৈতিক এবং অসাংবিধানিক ধারার বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে সাধারণ মানুষ এবং মানবাধিকার গ্রুপগুলো সোচ্চার হয়ে উঠেছে। জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৩৯তম অধিবেশনে যে কয়টি দেশের (ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিপোর্ট- ইউপিআর) মানবাধিকার রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা হয়েছে সেখানে বাংলাদেশ ছিল অন্যতম আলোচ্য বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে জননিনরাপত্তা, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে যে উদ্বেগজনক অবস্থা তৈরী হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সেই উদ্বেগের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এই আইনে ১৪টি জামিন অযোগ্য ধারা সংযোজন এবং ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতারের সুযোগ রাখা হয়েছে, সেখানে এই আইনের ব্যাপক অপব্যবহারের আশঙ্কা মানুষকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ নিরাপত্তা কোড হ্যাক হয়ে যায়, যেখানে সাধারণ মানুষের মোবাইল ফোনের সিম ক্লোন হয়ে যাচ্ছে সেখানে সাধারণ মানুষের ফেইজবুক আইডি ও টাইমলাইনে অনুপ্রবেশ খুবই সহজ ব্যাপার। এমনিতেই দেশের পুলিশ রাজনৈতিক কারণে হাজার হাজার ভুয়া, ভিত্তিহীন বা ভৌতিক মামলা দায়ের করে বিরোধি রাজনৈতিক দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মীর জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তুলেছে, সেখানে ফেইজবুক পোষ্টে আইন দ্বারা বারিত, রাজনৈতিক বিষয় পোষ্ট বা শেয়ার হওয়ার কারণে পুলিশকে যদি যে কাউকে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়, তার প্রভাব কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে তা’ সহজেই অনুমেয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পাশ হলেও এখনো রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়নি। রাষ্ট্রপতির কাছে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা এবং নাগরিক সমাজের দাবী হচ্ছে, তিনি যেন এই আইনের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, মতপ্রকাশ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী ধারাগুলো সংশোধনের জন্য ফেরত পাঠান। অন্যথায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ক্রমে আরো জোরালো হয়ে সরকার বিরোধি আন্দোলনে রূপ নিতে পারে। আইন তো জনগনের নিরাপত্তা ও কল্যানের জন্যই প্রণীত ও প্রযোজ্য হয়। যে আইন মানুষকে সন্ত্রস্ত ও নিরাপত্তাহীন করে তোলে, যে আইনের প্রতিবাদে মানুষ রাজপথে নেমে আসে তেমন আইন বলবৎ রাখতে অটল থাকার পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থই প্রাধান্য পায়। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্ত গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় নতুন প্রজন্মকে এমন একটি বিপ্রতীপ অবস্থানে ঠেলে দেবে, তা প্রত্যাশিত নয়।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিরাপত্তা আইন


আরও
আরও পড়ুন