পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি প্রকল্প ও রেলওয়ের দুটি প্রকল্পের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছেন। উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়নে নরেন্দ্র মোদীর সমর্থন মাইলফলক হয়ে থাকবে। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, আমাদের সম্পর্ক আরো গভীর হলো। বর্তমান সরকারের সাথে ভারতের গভীর সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। বহু দিন ধরেই সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। কারণ ‘দিতে পারলেই’ ভাল বলে একটা কথা আছে। পৃথিবীতে যে দিয়েই যায়, তার চেয়ে ভাল মানুষ বা বন্ধু কেউ হতে পারে না। ভারতের কাছেও বাংলাদেশ তেমন বন্ধু যে কেবল দিয়েই যাচ্ছে, তাকে কিছু দিতে হচ্ছে না। এ পর্যন্ত ভারত যা চেয়েছে, তার সবই পেয়েছে। সর্বশেষ ভারতের কলকাতা সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন গিয়েছিলেন, তখন তিনি অকপটেই বলেছিলেন, বাংলাদেশ ভারতকে যা দিয়েছে, তা চিরকাল মনে রাখবে। ভারত মনে রাখবে কিনা বা রাখছে কিনা, তার নজির অবশ্য আমরা এখনও দেখিনি। ভারত যে কেবল পেয়ে যাচ্ছে তা যে সে বোঝে না, তা মনে করার কারণ নেই। স্বাভাবিকভাবেই ভারত উচ্ছ¡সিত হয়ে বলবে, আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ একটি প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা যে ভারতের চাহিদা মতো সবকিছু দিলাম, আমরা কী পেলাম? আমাদের চাওয়া তো খুব বেশি কিছু ছিল না। শুধু নদ-নদীর ন্যায্য পানির হিস্যাটুকু পাওয়া। নিদেন পক্ষে তিস্তা চুক্তিটি সম্পন্ন করা। এই একটি চুক্তি কি ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে করেছে? করেনি। উল্টো নানা টালবাহানা করে হবে, হচ্ছে বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সরকার কেবল ভারতের মুখ থেকে ‘গভীর বন্ধুত্বে’র কথা শুনেই আনন্দে আছে। তার আচরণে মনে হচ্ছে, ভারত যদি আরও কিছু চায়, তা দিতে, বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। ইতোমধ্যে তো ভারতের চাওয়া মতো, ঋণ নেয়া থেকে শুরু করে ট্রানজিটের নামে করিডোরসহ ব্যবসা-বাণিজ্য, শ্রমবাজারসহ সবই দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশকে ভারত তার ব্যবসা-বাণিজ্য এবং স্বার্থের অন্যতম হাবে পরিণত করেছে। অন্যদিকে আমাদের যেন কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। এমনই একতরফা মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভারতের চাহিদা সরকার পূরণ করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। যদি ভারতের চাহিবা মাত্র না দিত, তাহলে কী হতো? এ প্রশ্নের জবাব দেয়া মুশকিল। তবে তার চাহিদা পূরণ করার পরও ভারত বন্ধুত্বের নামে বাংলাদেশকে কী দৃষ্টিতে দেখে, তা দেশের জনগণ গত কয়েক মাসে ভারতের ক্ষমতাসীন দলের নেতাসহ অন্যান্য দলের নেতাদের বিভিন্ন অমর্যাদকর বক্তব্য থেকেই বুঝে গিয়েছে। এখানে ভারতের ক্ষমতাসীন দলের একজন বিধায়কের মন্তব্য উল্লেখ করলেই পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। গত ১৯ মার্চ ভারতের আসাম রাজ্যের বিজেপির বিধায়ক হোজাই শিলাদিত্য আসামের নাগাঁও শহরে স্থানীয় এক সংবাদবিষয়ক চ্যানেলকে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সৃষ্টি ছিল বড় ভুল। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া উচিত ছিল ভারতের।’ তিনি এ কথাও বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে নতুন সৃষ্ট বাংলাদেশকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত না করে বড় ধরনের ভুল করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী (ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) ও তার তৎকালীন কংগ্রেস সরকার। বাংলাদেশ সৃষ্টিই একটি বড় ভুল ছিল। তবে বাংলাদেশকে ভারতের একটি অংশ করা হলে এই ভুল শোধরানো যেত।’ দেশটির ক্ষমতাসীন দলের নেতাসহ অন্য নেতারা যে বছরের পর বছর ধরে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে অত্যন্ত আপত্তিকর ও হুমকিমূলক কথা বলে যাচ্ছেন, তা নিয়ে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ করা দূরে থাক, টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করা হচ্ছে না। সর্বশেষ গত ১৮ জুলাই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) সাবেক নেতা তোগাড়িয়া বলেছেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচিত বাংলাদেশের একাংশ দখল করে নিয়ে সেখানে ‘অবৈধ অভিবাসীদের’ থাকার বন্দোবস্ত করা। গৌহাটিতে এক সভায় তোগাড়িয়া এ কথা বলেন। তিনি ভিএইচপির একাংশ ভেঙে আন্তঃরাষ্ট্রীয় হিন্দু পরিষদ (এএইচপি) গঠন করেছেন। সভায় তিনি দাবী করেন, সেখানে প্রায় ৫০ লাখ অবৈধ অভিবাসী থাকলেও গত দুই বছরে মাত্র ১৭ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এখন বাংলাদেশ এদের ফেরত নিতে অস্বীকার করলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচিত বাংলাদেশের ভূমি দখল করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া। বিভিন্ন সময়ে ভারতের ক্ষমতাসীন দলের নেতা থেকে শুরু করে দেশটির সেনাপ্রধানও বাংলাদেশের বিপক্ষে যায় এমন কথা বলেছেন। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এক কোটি বাংলাদেশীকে বিতাড়ন করা হবে। এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রানাওয়াত বলেছেন, ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবেই পাকিস্তান উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশীদের অনুপ্রবেশে মদদ দিচ্ছে। আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতকে পাকিস্তান দখলে নিতে চায়। তাই বাংলাদেশ থেকে মুসলমানদের নিয়ে আসামের জেলাগুলো ভরে দিচ্ছে। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এসব বক্তব্য যে বাংলাদেশকে দোষারোপ করা এবং প্রকারন্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, তা ব্যাখ্য করে বলার অবকাশ নেই। দুঃখের বিষয়, এসব বক্তব্যের কোনো ধরনের প্রতিবাদ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করা হয়নি।
দুই.
ভারত বাংলাদেশকে কী চোখে দেখে তা বিগত কয়েক বছরে দেশটির ক্ষমতাসীন দলের নেতা থেকে শুরু করে অন্যান্য দলের নেতাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য থেকে বোঝা যায়। তার মনোভাব এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, পারলে ভারত বাংলাদেশকে এখনই তার করায়ত্ত¡ নিতে পারলে ভাল হতো। তবে বিশ্বায়নের এ যুগে কোনো দেশকে করায়ত্ত¡ করার বিষয়টি ভিন্নভাবে করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে ক্ষমতাশালী দেশগুলো প্রতিবেশি দেশগুলোর ওপর দাদাগিরি করাসহ তার পুরো স্বার্থ বাজার দখল, জোর করে ঋণ দেয়া বা বানিজ্যের মাধ্যমে দখল করে নেয়। ভারত এখন এ কাজটিই বাংলাদেশের সাথে করছে। বলা যায়, বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে তার ওপর নির্ভরশীল করার কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে। ২০১৫ সালে যখন নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন ৭টি চুক্তি এবং ১০টি এমওইউ ও দলিল স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি ৭টি হচ্ছে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য (নবায়ন), উপকূলীয় জাহাজ চলাচল, আভ্যন্তরীণ নৌ ট্রানজিট ও বাণিজ্য প্রোটোকল(নবায়ন), বিএসটিআই ও ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডসের মধ্যে মানবিষয়ক সহযোগিতা, ঢাকা-শিলং-গৌহাটি ও কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সেবা এবং আখাউড়ায় ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ ইজারা। ১০টি এমওইউ-এর মধ্যে রয়েছে, উপকূলরক্ষী বাহিনী বিষয়ক, মানবপাচার, চোরাচালানা ও জাল নোট প্রতিরোধ, বাংলাদেশকে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে সাগর অর্থনীতি ও সমুদ্রবিষয়ক সহযোগিতা, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার, সার্কের ইন্ডিয়া এন্ডোমেন্ট ফর ক্লাইমেট চেঞ্জের আওতায় একটি প্রকল্প, ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের কাউন্সিল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রবিজ্ঞানবিষয়ক যৌথ গবেষণা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরর সঙ্গে ভারতের জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা সংক্রান্ত। দলিল বিনিময়ের মধ্যে রয়েছে, ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি ও এর ২০১১ সালের প্রোটোকল অনুসমর্থনে ইনস্ট্রুমেন্ট বিনিময়, ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি ও এর ২০১১ সালের প্রোটোকল বাস্তবায়নের উপায় বিষয়ে চিঠি বিনিময়, ২০১৫-২০১৭ সালের জন্য সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি, শিক্ষা খাতে বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতায় আগ্রহবিষয়ক বিবৃতি স্বাক্ষর এবং বাংলাদেশে ভারতের লাইফ ইনস্যুরেন্স করপোরেশনকে কার্যক্রম চালাতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সম্মতিপত্র হস্তান্তর। উল্লেখিত চুক্তি ও এমওইউ-এর দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশের নগদে একটি প্রাপ্তি ছাড়া তেমন কিছু নেই। প্রাপ্তিটি হচ্ছে স্থলসীমান্ত চুক্তি। বাকি সব আশ্বাস। আর ভারতের বাস্তব সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির তালিকা ব্যাপক। বলা যায়, মোদীর এক সফরেই ভারতের যা পাওয়ার দরকার ছিল তা পেয়ে গেছে। মোদী তার ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব দিয়ে আদায় করে নিয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলেছেন, সে সময় মোদীর সফরে যোগাযোগ ক্ষেত্রে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে, তাতে ভারতই একতরফাভাবে লাভবান হয়েছে। বিপরীতে বরাবরের মতো বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। তার ওই সফরে তিস্তা নদীর পানি বা অভিন্ন অন্যান্য নদী নিয়ে ভারতের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি আদায়ের সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ তা আদায় করতে পারেনি। মোদী বাংলাদেশ সফরে এসে যা পাবেন, তা তার জনগণকে আগেভাগেই জানিয়েছিলেন। তার দেশের জনগণের কাছে কোন কিছুই লুকাননি, সব স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করেছিলেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের জনগণ এর অনেক কিছুই জানতে পারেনি বা জানতে দেয়া হয়নি। মোদীর সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মানুষের অনেক চাওয়ার মধ্যে একটি চাওয়াই সবচেয়ে বেশি ছিল, সেটি হচ্ছে তিস্তা চুক্তি। সে সময় মোদীর সফরের আগেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। তারপরও মোদী বাংলাদেশ সফরে অনেক চমক দেখাবেন, এমন সংবাদ আমাদের দেশের কিছু পত্র-পত্রিকায় প্রচার করা হয়েছিল। সফর শেষে দেখা গেল, বাংলাদেশের জন্য হাতাশা ছাড়া কোন কিছু ছিল না, সব চমকই ছিল ভারতের জন্য। তিনি তার দেশের চাহিদা মতো অনেক কিছু নিয়ে গেছেন। এ নিয়ে তিনি টুইটারে তখন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। উচ্ছ্বসিত হওয়ারই কথা। সব ইচ্ছা পূরণ হলে কে বেজার থাকে? অন্যদিকে এক স্থলসীমান্ত চুক্তি নিয়েই বাংলাদেশের কিছু মিডিয়া এবং সরকার সমর্থক লোকদের মধ্যে এমন ভাব প্রকাশ করতে দেখা গেছে যে, ভারত যেন আমাদেরকে বিরাট কিছু দিয়ে দিয়েছে। তবে একজন সাধারণ মানুষও বুঝতে পারেন, স্থলসীমান্ত চুক্তির বিষয়টি নতুন কিছু ছিল না। এটি বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা ছিল। ৪১ বছর আগেই এই চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল। ভারত তা ৪১ বছর পর বুঝিয়ে দিয়ে এমন একটা ভাব দেখিয়েছে যে, বাংলাদেশকে সে বিরাট কিছু দিয়ে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত ও বাংলাদেশের সাথে দুয়েকটি দেশ সংযুক্ত করে যে যোগাযোগ ব্যবস্থার চুক্তি হয়েছে, তা প্রকারন্তরে কানেকটিভিটির নামে ভারতের বহু কাক্সিক্ষত ট্রানজিটই দিয়ে দেয়া হয়েছে।
তিন.
ভারত কৈয়ের তেলে কৈ ভাজার বিষয়টি বেশ ভালভাবেই জানে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। ঋণ দিয়ে ঋণের পুরো সুবিধা কিভাবে তুলে নিতে হয়, তা সে ভাল জানে। ২০১১ সালে বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার বেশ চড়া সুদ ও শর্তে ঋণ দিয়েছিল। যার বেশিরভাগ সুবিধাই ভারতের জন্য। এ ঋণের টাকায় যেসব প্রকল্প এক বছরে বাস্তবায়নের কথা ছিল, তা পাঁচ বছর হতে চললেও বাস্তবায়ন হয়নি। এবারও মোদির সফরের সময় বাংলাদেশকে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার চুক্তি হয়েছে। চুক্তির শর্তানুযায়ী, ঋণের অর্থে নেয়া প্রকল্পগুলোর অন্তত ৭৫ শতাংশ যন্ত্রপাতি ও সেবা ভারত থেকে নিতে হবে। এসব সেবা ও পণ্যর উৎপাদন প্রক্রিয়া ভারত থেকেই নিতে হবে। এই ঋণের ফলে ভারতকে বিপুল পরিমাণ রফতানির সুযোগ এনে দেবে। ঋণের টাকায় নেয়া প্রকল্পগুলোকে কেন্দ্র করে ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছে ভারতের পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়া। ঋণের ব্যাপারে অর্থনীতিবিদরা তখন বলেছিলেন, এই ঋণচুক্তির আগে কোনো সময়ই বাংলাদেশের কথা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। তাই শুধু ঋণেই না, প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও বাংলাদেশ লাভবান হবে না। এই চুক্তির জন্য ভারত নিজেদের মতো করে চিন্তা করেছে যে, তাদের লাভ হবে। ভারতের মিডিয়া ও বাংলাদেশের বিশ্লেষকদের বিশ্লেষনে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের লেনদেনের যে সম্পর্ক তা কেবল ভারতকে দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এটা একতরফা এবং অসম সম্পর্ক। এর জন্য ভারত যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায় আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকদের। কারণ তারা আমাদের ন্যায্য পাওনা বুঝে নিতে পারেনি বা পারছে না। নিজের বুঝ যে বুঝে নিতে পারে না, অন্যে তা নিয়ে নেবে, এটাই জগতের নিয়ম। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশের কাছে ভারতের চাইতে দেরি হয়, দিতে দেরি হয় না। যেমন বন্দর ব্যবহারের কথা ভারত বলতে না বলতেই চট্টগ্রামে ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজের ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। বন্দর ব্যবহারের পর এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভারতের পূর্বাঞ্চলে খাদ্য সরবরাহের জন্য ভারত মানবিক সহায়তা চাওয়ার সাথে সাথে বন্দর ব্যবহারের সুবিধা দেয়া হয়। ত্রিপুরার পালাটানায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য আশুগঞ্জ বন্দর দিয়ে ভারি যন্ত্রপাতি নিতে বাংলাদেশের সড়কের ক্ষতিসাধন করেও অনুমতি দেয়া হয়েছে। ভারতের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ অসামান্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। অর্থাৎ ভারতের যা যা প্রয়োজন বাংলাদেশ তাই দিয়েছে এবং দিচ্ছে। ফলে জনসাধারণের মনে যদি প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ কি পেল? এ প্রশ্নের উত্তর শুধু, আশ্বাস আর আশ্বাস। এক স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করতে ভারত সময় নিয়েছে ৪১ বছর। বাংলাদেশের জীবনমরণ সমস্যা ন্যায্য পানি প্রাপ্তির সমাধান হতে কত বছর লাগবে, তা কেউ বলতে পারবে না। দেখা যাবে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে যাচ্ছে, পানি সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। অনেকে বলতে পারেন, চুক্তি হওয়া স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হতেই ৪১ বছর লেগেছে। আর যে তিস্তা চুক্তি এখনও হয়নি, তা হতে এবং বাস্তবায়িত হতে কত সময় লাগবে, তা বলা সম্ভব নয়। সে সময় টাইমস অফ ইন্ডিয়া ঋণ চুক্তির ফলে বিভিন্ন প্রকল্পে ভারতের ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা উল্লেখ করেছিল। আর আমাদের দেশের একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, গত দুই দশকে পানির নিম্নপ্রবাহের কারণে তিস্তাপারের নদীনির্ভর ৩৫ শতাংশ মানুষ পেশা হারিয়েছে। আর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যেখানে আমাদের দেশের প্রায় ৪ কোটির বেশি শিক্ষিত তরুণ বেকার রয়েছে, তাদের অনেকের কর্মসংস্থান হবে কিনা, তা আমরা বলতে পারছি না। এটা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি হতে পারে! আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশ গঙ্গার পানি ধরে রাখার জন্য যে গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তাতেও ভারতের আপত্তি রয়েছে। অর্থাৎ ভারত পানিও দেবে না এবং বর্ষায় তাদের ছাড়া অতিরিক্ত পানি ধরেও রাখতে দেবে না। আশা করা হয়েছিল, মোদির সফরের সময় এই ব্যারেজ নির্মাণের অনুমতি মিলবে। সে আশায় গুড়ে বালি। বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভাগ্য যে, সরকার ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য দাবীর কোন কিছু আদায় করতে সক্ষম হচ্ছে না। জনগণকে অনেকটা অন্ধকারে রেখে ভারতের অনুকূলে চুক্তি করে তাকে খুশি করতেই যেন ব্যস্ত। এমনকি বিরোধী দলে যারা থাকে বা রয়েছে, তারাও এ নিয়ে কিছু বলে না। বাংলাদেশের সরকার ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এমন নতজানু অবস্থানের কারণেই ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে যা খুশি তা বলে যাচ্ছে। এটা জনগণের দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছুই নয়।
চার.
ভারতের জনগণের সাথে বাংলাদেশের জনগণের কি কোন শত্রæতা আছে? এ প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর পাওয়া মুশকিল। যদি শত্রæতা থাকে বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে কেন এই শত্রæতা, এ প্রশ্নের জবাব খোঁজা জরুরি। ভারত বা বাংলাদেশের মানুষ যদি দেখে এক দেশ আরেক দেশের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে, তবে বঞ্চিত দেশের যে কোন নাগরিকের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হবেই। ভারত যদি বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারগুলো যৌক্তিকভাবে সমাধান করে দেয়, তাহলে তো এ দেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী কোন মনোভাব থাকার কথা নয়। বরং দুই দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বের স্রোতধারা বয়ে যাওয়ার কথা। ভারতের কেবল নিয়েই যাব, দেব না কিছুই-এই নীতি অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে তাকে বন্ধু বলে ভাবার কারণ থাকতে পারে না। বিশেষ করে যখন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলে, তখন ভারতকে জনগণ বন্ধু হিসেবে নেয়ার প্রশ্ন উঠে না। আমাদের দেশের জনগণকেও ভারতের এ মনোভাব সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। বিষয়টি সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকেও বুঝতে হবে। ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার স্বার্থে নয়, দেশের স্বার্থে তাদেরকে রজনীতি করতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।