Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অমানবিকতা কাকে বলে!

আবদুল্লাহ আল মামুন : | প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাড়ি ফিরছিলেন নেত্রকোনার হাসান (৩৫)। রাজধানীর মহাখালী থেকে ঠিকঠাক মতো বাসেও ওঠেন। মাঝ রাতে এসে বাসও পৌঁছায় কিশোরগঞ্জে। তিনি জঙ্গলবাড়ি এলকায় এসে গাড়ি থেকে নামেন। পায়ে হেটে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক এমন সময় রাত সাড়ে ৩টার দিকে কালো রংয়ের একটি মাইক্রোবাস তাকে ধাক্কা দেয়। এতে সঙ্গে সঙ্গে ওলট-পালট হয়ে যায় তার জীবন। সব স্বপ্ন যেন নিমেষেই আঁধারে ঢেকে যায়। মাইক্রোবাসের ধাক্কায় তার বাম হাত মারাত্মকভাবে ভেঙে যায়। ঘটনার পর কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। পরে তারাই উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেয় ঢাকায়।
এ পর্যন্ত সব কিছু ঠিক ঠাক ছিল। বিপত্তি ঘটে ঢাকায় আসার পর। তিনি যখন উত্তরায় এসে পৌঁছলেন, কয়েকজন লোক চিকিৎসা করানোর কথা বলে তাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই করাত ও চাকু দিয়ে কনুইর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয় হাতের কব্জি। পরে চিকিৎসা ও ওষুধের টাকা সংগ্রহের কথা বলে তাকে দিয়ে করানো হয় ভিক্ষাবৃত্তি। ভাঙা হাতে ব্যান্ডেজ মুড়িয়ে তাকে দেখিয়ে আর্থিক সহায়তা নেওয়া হয়েছে অনেকের কাছ থেকে। কিন্তু একটি কানা কড়িও তার পেছনে খরচ করেনি তারা। বরং তাকে ব্যবহার করে সংগৃহীত সব টাকা নিয়ে তাকেই রাস্তায় ফেলে লোপাট হয় চক্রটি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাসান জানান, প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো সংগ্রহ করে তারা। কিন্তু তার চিকিৎসা বাবদ এক টাকাও তারা খবর করেনি। তিনি পিচ্চি সোহেল নামে একজনের নাম বলতে পারলেও আর কারো নাম বলতে পারছেন না।
তিনি বলেন, কাটা হাত নিয়ে অসহায় হয়ে পড়ি। কোন উপায়ন্তর না পেয়ে এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় ঘুরতে থাকি। বাড়িতে ফেরারও চেষ্টা করেছি বহুবার। কিন্তু দীর্ঘ কয়েকদিন চিকিৎসা করাতে না পেরে হাতে পচন ধরে যায়। খুব দুর্গন্ধ বের হতে শুরু করে হাত থেকে। এমন অবস্থা হয় যে, কেউ তার কাছে ভিড়তে পারছিলেন না।
হাসান বলেন, বাসে উঠতে গেলে দুর্গন্ধের জন্য নামিয়ে দেওয়া হতো। ট্রেনেও উঠলেও যাত্রীরা নামিয়ে দিতো। সবশেষে ট্রেনের চালককে নিজের দুরবস্থার কথা জানালে চালক তাকে নিতে রাজী হন। ট্রেন ছাড়ার সময় তিনি উঠতে গেলে হাত থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়ায় কয়েকজন ভাসমান শিশু-কিশোর ধাক্কা দিয়ে তাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেয় নিচে। এরপর আর কোন কিছুই মনে নেই তার। গত ৩ সেপ্টেম্বর তাকে দৈনিক বাংলা মোড়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে তাকে নিয়ে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করেন যমুনা ব্যাংকের ফাস্ট অ্যাসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শামীম আহমেদ।
পাগল ও অসহায় লোকের বন্ধু হিসেবে পরিচিত এই ব্যাংকার জানান, অফিস শেষে রাস্তায় বেরিয়ে সুরমা টাওয়ারের নিচে একটি লোককে হাঁটুভাঙা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। পুরো শরীরের হাড্ডিগুলো দেখা যাচ্ছিল। বাম হাতে ছেড়া কাপড় দিয়ে মোড়ানো ছিল। খুবই পঁচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল হাত থেকে। গন্ধে কেউ তার ধারে কাছে ভিড়তে পারছিলেন না।
শামীম জানান, ওই সময় লোকটি বেঁচে থাকলেও কোন চেতনা ছিল না। একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন। পঁচা হাতটিতে পোকা গিজ গিজ করছে। এ ছাড়া পুরো হাত ও শরীর জুড়ে মাছি ভনভন করছিল। তখন তিনি তার সহকর্মী আলি সাব্বির ও শফিকুল ইসলামকে ডেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে লোকটিকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যান।
তিনি জানান, হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে ভর্তি নিতে প্রথমে অনীহা প্রকাশ করলেও অনুরোধে ভর্তি নেন। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে শামীম বলেন, হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসকরা প্রথমে হাতটি ভালোমতো ড্রেসিং করেন। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শরীরে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ অনেক কম দেখতে পান। তিনি জানান, রক্তে হিমোগ্লোবিনেরপরিমাণ ছিল ৩.৬। পরে চার ব্যাগ ‘ও নেগেটিভ’ রক্ত দেওয়া হলে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ৬.৭-এ গিয়ে দাঁড়ায়।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট এবং লাইভ ভিডিও আপলোড করলে নেত্রকোনার এক বন্ধু হাসানের গ্রামের বাড়ি ও পরিবার সম্পর্কে তথ্য দেন। পরে তারা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
হাসপাতালে হাসানের বড় বোন খোদেজা বেগম জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বদলা উপজেলার ১০ নং নারাইনদা ইউনিয়নের নিজামপুর গ্রামে। পিতা মৃত কিতাব আলী। খুব ছোট বেলায় বাবা মারা যায়। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে হাসান চতুর্থ। তার মা রহিমা বেগম বহু কষ্টে তাদেরকে বড় করেন। বর্তমানে মা নিজেও সড়ক দুর্ঘটনায় আহত পঙ্গুত্ব বরণ করে ঘরে পড়ে আছেন। বড় ভাই হোসাইন আহমেদ এলাকায় ধান-চালের ব্যবসা করে কোনভাবে সংসার চালান।
এই বোন জানান, হাসান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভবনে পাইলিংয়ের কাজ করতো। এলাকায় এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হাসানের গায়ের রং কালো হওয়ায় স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। খোদেজা আরও বলেন, তার ভাইয়ের মাথায় সমস্যা রয়েছে। একটুতে রেগে যান। গত ঈদুল আযহার ২৬ দিন আগে বাড়ি থেকে বের হয় নিখোঁজ হয় হাসান। এরপর থেকে তার কোন খোঁজ পাননি তারা।
ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, হাসানের হাতের অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে আপাতত ড্রেসিং করে রাখা হচ্ছে। হাতে অস্ত্রোপচার করতে হবে। গতকাল তাকে সাধারণ ইউনিট থেকে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক ডা. পার্থ শংকর পাল জানান, তার হাতটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অবস্থা পর্যালোচনা করে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এদিকে ব্যাংকার শামীম বলেন, চিকিৎসা শেষে হাসানকে জীবন ধারণের জন্য তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় একটি দোকান করে দেওয়া হবে।



 

Show all comments
  • অর্ণব ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৩:৪৯ এএম says : 0
    এই চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক
    Total Reply(0) Reply
  • আজগর ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৩:৫০ এএম says : 0
    নিউজটি করায় ইনকিলাবকে ধন্যবাদ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অমানবিক

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮
৮ জুন, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ