Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খালেদা জিয়ার মুক্তিই শেষ কথা

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

বিএনপিকে জাতীয় নির্বাচনে আসার আহবান যে সরকারের মায়াকান্না, সেটা জাতির সামনে অত্যন্ত পরিষ্কার। সরকারের অনেক মন্ত্রীর মুখে শোনা গেছে যে, বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে না এলে মুসলিমলীগ হয়ে যাবে, ন্যাপ হয়ে যাবে ইত্যাদিবিএনপিকে নির্বাচনে আসতে আহবান জানিয়ে বলা হচ্ছে বিভিন্ন মুখরোচক কথাবার্তা। প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে দলীয় সম্মেলনে এমনটিই বলেছিলেন যে, তিনি আর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেখতে চান না। ৫ জানুয়ারির ভোট ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, ঐ নির্বাচন ছিল নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। অন্যদিকে বিদেশিদের নিকটও তিনি অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনে তিনি আশাবাদী। কিন্তু সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা ও বিচারের রায় সংক্রান্ত কিছু অগ্রীম কথাবার্তায় দৃশ্যত এটাই মনে হচ্ছে যে, সরকার বিএনপি ছাড়া আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের দিকেই এগুচ্ছে এবং জোর করেই বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার সকল প্রকার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বিএনপির চেয়ারপার্সনকে কারাবন্দি ও বিভিন্ন মামলায় জামিনের বিষয়টি দীর্ঘায়িত করার পিছনে সরকারের হস্তক্ষেপ এখন দৃশ্যমান। ক্ষমতাসীন নেতা-মন্ত্রীরা অনেক কথাই বলেন যার সাথে বাস্তবতার কোন সামঞ্জস্য নাই বরং সাংর্ঘষিক। যে বাঘ রক্তের স্বাদ পেয়েছে সে শিকারের ঝুঁকি নেবেই। এ সরকার সুস্পষ্টই বুঝতে পেরেছে যে, বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েও একটি গণতান্ত্রিক (সংবিধান মতে) রাষ্ট্র শাসন করা যায়। ফলে আর একটি একতরফা নির্বাচন যদি করা যায় তবে সরকার একদলীয় শাসন ছাড়াও স্থায়ীভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার আইনানুগ সুযোগ পাবে (যদি না ব্যতিক্রম কিছু ঘটে) এবং এটাই যদি হয় তবে ভবিষ্যতে আর নির্বাচনের প্রয়োজন হবে না, বংশানুক্রমে চললেই হবে। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ বিবেক দিয়ে চলে না, তারা ক্ষমতাসীনদের পাশে থেকে নিরাপদ অবস্থানে থাকতে চায়। মানুষ যদি বিবেক দিয়ে চলতো তবে অনেক অনাচার-অবিচারের প্রতিরোধ হতো। কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে তোলার যে অবস্থান সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল তা এখনো দৃশ্যমান নয়। গ্যাসের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি পাচ্ছে, মোবাইল কল রেট বৃদ্ধি পেয়েছে, গণমানুষের ভোটাধিকার নেই, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি লোপাট হচ্ছে কিন্তু গণমানুষের কোন রা নেই বরং বুব্ধিজীবীরা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে সরকারি সুবিধা আদায় করছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা একটি পৈশাচিক ঘটনা। এ ঘটনার বিচার বিএনপি চেয়েছে এবং বিবেকমান সকল মানুষেরই উচিৎ এ ঘটনার নিন্দা প্রকাশ ও বিচার চেয়ে প্রকৃত দোষী ব্যক্তির শাস্তি কামনা করা। বিএনপি সরকার এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের সন্ধান দাতাদের ১ কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল এবং যতটুকু মনে পড়ে, প্রধান অভিযুক্ত মুফতি হান্নানকে বিএনপি সরকারই গ্রেফতার করেছিল। তারপরও রায় ঘোষণার পূর্ব মুহূর্তে তারেক রহমানকে ইঙ্গিত করে জিয়া পরিবারকে দায়ী করে বক্তব্য প্রদান দেশের বর্তমান নিয়ন্ত্রিত বিচার ব্যবস্থাকে প্রভান্বিত করবেই। পৈশাচিক ঘটনা যেমন কেউ সমর্থন করে না, তেমনি প্রভাব খাটিয়ে নির্দোষ কাউকে দোষী সাব্যস্ত করাও সমর্থনীয় হতে পারে না। প্রকৃত দোষী ব্যক্তির সাজা হোক, কিন্তু ক্ষমতার মসনদকে চ্যালেঞ্জ মুক্ত রাখার জন্য কোন কারণেই স্বচ্ছতা যেন কলঙ্কিত হয়ে না পড়ে। যদি হয়, তবে কেউ জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকতে পারবে না, আজ বা কাল হোক।
বিএনপি চেয়ারপার্সনের অংশগ্রহণ ছাড়া দলটি নির্বাচনে যাবে কি না তা আরো পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার দাবি রাখে। চেয়ারপার্সন জামিনে মুক্ত হলেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না, যদি না ফৌজদারী কার্যবিধির ৪২৬ ধারা মোতাবেক তার সাজা উচ্চ আদালত কর্তৃক স্থগিত হয়। অথবা সরকারি কোন সিদ্ধান্তে তার নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়(!)। বিষয়টি এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চেয়ারপার্সনকে বাইরে রেখে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ হবে আত্মঘাতী। তাই বিকল্প গণতান্ত্রিক পন্থা বা পদ্ধতি নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। এ দুটি বিষয় নিয়ে বিএনপিকে একটি স্থির ও সাবলিল সিদ্ধান্তে অবশ্যই পৌঁছাতে হবে। গত ২৮ আগস্ট জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একটি সভা ড. কামাল হোসেনের বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংগঠনের দিক দিয়ে তাদের দল পিছিয়ে থাকলেও রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার কঊণ চঙওঘঞ-এ ছিলেন। ডাক্তার বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব, পরে মন্ত্রী, সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি। বর্তমানে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে শেখ হাসিনা সরকারের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন তারা। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যিনি একজন সম্মুখ যোদ্ধা এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি প্রতিবাদ করে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়ে ছিলেন। আ.স.ম. আব্দুর রব মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনে সম্মুখ সারির ছাত্রনেতা, যিনি স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারী হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন। মাহমুদুর রহমান মান্না ঐতিহ্যবাহী ডাকসুর ভি.পি. জি.এস ছাড়াও তৃতীয় ধারার রাজনীতি চালু করার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অনড় রয়েছেন। তৃণমূল পর্যায়ে তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা না থাকলেও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে যাদের প্রতি জনগণ আস্থা আনতে পারে। এতোদিন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া তথা বিএনপি নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার দাবি তুলেছিলেন, এখন বর্ণিত ব্যক্তিদের আকুণ্ঠ সমর্থনটি আরো জোরদারসহ জনগণের আস্থা অর্জনে সহায়ক ভ‚মিকা রাখতে পারে। এ ঐক্যে সরকারের গাজ্বালা ধরেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সরকারি দলের মুখপাত্র এমনও বলেছেন যে, বিএনপি/জামায়াতের চেয়ে আওয়ামী লীগে ঘাপটি মেরে থাকা শত্রুরা সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে বেশি তৎপর হয়েছে। মনে হচ্ছে, গুটি কয়েক ব্যক্তির বেইলি রোডের মিটিং বেশ নাড়া দিয়েছে, কারণ গণমানুষের ভোটাধিকার আদায়ের দাবি যুক্তিসংগত এবং বর্তমানে এটা গণদাবি। ইসলামপন্থী বড় দলগুলিও এ বিষয়ে অনড় রয়েছে।
বিএনপি একটি উদারপন্থী দল, আরো একটু এগিয়ে বলা যায় অতি উদারপন্থী। এখানে পুরস্কার ও তিরস্কারের অনেক ব্যাপার রয়েছে। আপন পর চেনার অনেক ঘাটতি রয়েছে। যারা দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং যারা দলের জন্য জানজীবন দিয়ে, ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে তাদের সকলকে একই পাল্লায় মূল্যায়ন করা হয়। ধান ও চিটা একই দরে বিক্রি হয়। দেশনেত্রী খালেদা জিয়া অতি উদারপন্থী দলের চেয়ারপার্সন না হয়ে যদি কোন কট্টরপন্থী দলের নেতা হতেন তবে নিশ্চয় তার মুক্তির আন্দোলনের দিনক্ষণ ঠিক করার জন্য ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না। অতি উদারতার কারণে কথিত সংস্কারপন্থীদের বিরুদ্ধে দল কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বিএনপি আইনজীবী সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়বাদী আইনজীবী ফোরাম নেত্রীর সাজা হওয়ার পর একদিনের জন্যও রাজপথে নামেনি এবং এ জন্য কোন জবাবদিহিতাও নেই। এটাই ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। তবে এ অবস্থান থাকবে না। অবশ্যই এর অবসান হতে হবে। কারণ শত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বিএনপি মাঠে নামার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে এবং এতো জোর-জুলুম অত্যাচার করেও সরকার বিএনপিকে ভাঙ্গতে পারেনি। মহিলা নেত্রীরাও জেল খাটছে। তৃণমূল এখনো দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার একক নেতৃত্বের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থাশীল। এতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সরকার অত্যাচার-নির্যাতন করেও বিএনপির মাথা নোয়াতে পারেনি। তবে সরকার একতরফা নির্বাচনের পথ সুগম করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং এ জন্যই ইউনিয়ন ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মী ছাড়াও সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে আইনকে ব্যবহার করে নির্যাতন করছে। তবে তৃণমূল মনে করে, একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য খালেদা জিয়ার মুক্তিই শেষ কথা।
একটি ঘটনার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে সরকারের পরিকল্পনা পরিষ্কার ফুটে উঠে। সোনারগাঁও উপজেলা বিএনপির সভাপতি খোন্দকার আবু জাফরসহ অনেকেই হজ্বে থাকাবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা দেয়া হয়েছে। ২৯ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপার্সনের মুক্তির দাবিতে রূপগঞ্জ উপজেলাধীন যাত্রামুড়া এলাকায় নারায়ণগঞ্জ জেলা ওলেমা দল আয়োজিত একটি সভায় এ নিবন্ধের লেখক যোগদান করার জন্য উপস্থিত হলে পুলিশ সভা শুরু হওয়ার পূর্বেই ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং জেলা ওলেমা দলের সভাপতি শামছুর রহমান খান বেনু, ওলেমা দল নেতা আলাউদ্দিন, আমির হোসেন এবং নাছির মেম্বারকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং ২৮ জনকে আসামী করে কাল্পনিক মামলা রুজু করে। প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের টপ-টু-বটম নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে, অন্যদিকে মামলা এবং গ্রেফতার এড়াতে বিএনপি ঘর থেকেই বেরুতে পারছে না এবং সরকারের দৃষ্টিতে সরকারের মন্ত্রীরা পূর্ব থেকেই বলছেন এটাই লেভেল প্লেইং ফিল্ড(!)। আরো বলে আসছেন, আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় না গেলে রোহিঙ্গা হয়ে যাবে। এমনো বলা হয়েছে যে, বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে তবে সরকার দলীয় নেতারা টাকা পয়সা যা কামাই করেছেন তা ফেলে রেখে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। ফলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, নিজেদের জনসমর্থন সম্পর্কে সরকারের উপলব্ধি হয়েছে। যার জন্য পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনসমর্থন নয় বরং পুলিশ কর্তৃক রুজুকৃত কাল্পনিক মামলা ও নিয়ন্ত্রিত বিচার ব্যবস্থাকে পুঁজি করেই বিএনপির নির্বাচনী যাত্রা পথে সরকার নিজেই ব্যারিকেড সৃষ্টি করছে। যার নিরব ও সরকারঅনুগত দর্শক হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, যারা এখন পর্যন্ত একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের নিশ্চয়তা জাতির সামনে দিতে পারেনি।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

Show all comments
  • মাননান ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ২:৫৯ পিএম says : 0
    বেগম জিয়া সহজে মুক্তি পাবে না নিশ্চিত.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খালেদা জিয়া

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন