Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পানি বণ্টন নিয়ে পররাষ্ট্র সচিবের দিল্লী সফর

প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার অভিন্ন নদ-নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি সুরাহা করার জন্য গঠিত যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি)-এর বৈঠক দীর্ঘ পাঁচ বছরেও হয়নি। জেআরসি’র মন্ত্রী পর্যায়ের সর্বশেষ বৈঠকটি হয়েছিল ২০১০ সালের মার্চে দিল্লীতে। এটি ছিল ৩৭তম বৈঠক। ৩৮তম বৈঠকটি হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সারের ১৮-১৯ জুন ঢাকায়। বৈঠকের সব আয়োজন চূড়ান্ত করা হলেও শেষ পর্যন্ত দিল্লীর পক্ষ থেকে বাতিল করা হয়। কেন ও কী কারণে বৈঠকটি বাতিল করা হয়েছিল তা দিল্লী জানায়ওনি। সে সময় ভারতে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় ছিল। পরবর্তীতে বিজেপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী বৈঠকের জন্য দিল্লীকে চিঠি দিলেও ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রী সংসদে বাজেট অধিবেশন চলছে এ অজুহাতে পরবর্তীতে বৈঠক হবে বলে জানান। প্রায় তিন বছর হয়ে গেলেও এই বৈঠক আর হয়নি। অবশেষে আগামী ২ ফেব্রুয়ারি তিস্তার পানি ভাগাভাগিসহ অভিন্ন নদ-নদীর সমস্যা তুলে ধরতে তিন দিনের সফরে দিল্লী যাচ্ছেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক। সেখানে তিনি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যৌথ নদী কমিশন-এর বৈঠক ডাকার ব্যাপারে ভারতকে তাকিদ দেবেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জেআরসি বৈঠকের ব্যাপারে আগ্রহ দেখানো এবং তাকিদ দিলেও ভারতের অনীহা ও নানা টালবাহানায় জেআরসি’র বৈঠক দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে আছে। যৌথ নদ-নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারত যেন কোনো কথা বলতে চাচ্ছে না। এর ফলে পানির অভাবে বাংলাদেশের নদ-নদী শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। কৃষিকাজ ব্যাহত, মরুকরণ প্রক্রিয়াসহ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর ধরে অভিন্ন নদ-নদীর পানি ভারতের একতরফাভাবে প্রত্যাহারের বিষয়টি নতুন নয়। এ নিয়ে বহু দেন-দরবার করেও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো ভারত পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখে এবং আশ্বাস দিয়ে বাংলাদেশের কাছে তার যত দাবী-দাওয়া তার সবই আদায় করে নিয়েছে। ট্রানজিট সুবিধাসহ বাংলাদেশের উপর দিয়ে খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য পণ্য অনেকটা বিনা শুল্কে পরিবহনের সুবিধা পেয়েছে। বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। আমরা কেবল দিয়েই গিয়েছি। আমাদের জীবনমরণ সমস্যা হয়ে থাকা অভিন্ন নদ-নদীর পানি নিয়ে হাহাকার অবস্থার সৃষ্টি হলেও ভারত তাতে বিন্দুমাত্র সাড়া দিচ্ছে না। তার আচরণ দেখে দেশের মানুষের মনে এই ধারণা এখন বদ্ধমূল, ভারত আমাদের শুকিয়ে মারার সব ব্যবস্থা করছে। সে তার ইচ্ছামতো অভিন্ন নদ-নদীতে বাঁধ, গ্রোয়েন নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো স্বাভাবিক নাব্য হারিয়ে প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। অসংখ্য নদী মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ প্রায় সব নদ-নদীর নৌ-পথ ড্রেজিং করে কোনো রকমে সচল রাখা হয়েছে। গড়াই, ফেনী, মুহুরি, সুরমা, কুশিয়ারা ও তিস্তার অবস্থা শোচনীয়। এসব নদ-নদী নির্ভর সেচ প্রকল্পগুলো পানির অভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ইতোমধ্যে পানির অভাবে তিস্তা, জিকে, মেঘনা-ধনাগোদা, মুহুরি সেচপ্রকল্পে সেচযোগ্য জমির পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ইতোমধ্যে তিস্তা প্রকল্পের সেচযোগ্য জমির পরিমাণ কমিয়ে ১০ হাজার হেক্টরে নামিয়ে এনেছে। অথচ তিস্তায় স্বাভাবিক পানি প্রবাহ থাকলে এই জমির পরিমাণ দাঁড়াতো ৬৬ হাজার হেক্টর। অন্যান্য সেচ প্রকল্পেও সেচযোগ্য জমির পরিমাণ কমিয়ে আনা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত জেআরসি বৈঠক না হওয়া এবং তিস্তা চুক্তি না থাকার কারণে এই মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মার্চে তিস্তার পানি সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করলে কী অবস্থার সৃষ্টি হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। পরিস্থিতির এই ভয়াবহতা নিরূপণে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় একেবারেই ব্যর্থ বলে তারা মত দিয়েছেন। ভারত শুধু পানি প্রত্যাহারই করছে না, তার সাথে যে সাড়ে ৪শ’ কিলোমিটার নদী সীমান্ত রয়েছে, সেখানে নদী ভাঙন ঠেকাতেও বাংলাদেশকে বাধা দেয়া হচ্ছে। বলা যায়, বাংলাদেশ এখন উভয় সংকটে পড়েছে। সীমান্ত নদী ভাঙনে যেমন ভূমি হারাচ্ছে, তেমনি পানির অভাবে শুকিয়ে মরছে। এসব বিষয় সমাধানে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে না। বলাবাহুল্য, এক্ষেত্রে ভারতের চরম বৈরি আচরণ মুখ্য হলেও, এ থেকে বের হয়ে আসার জোরালো উদ্যোগও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভারতকে তার চাহিদা মতো সব দিয়ে দিলেও, একটিমাত্র তিস্তা চুক্তি সরকার আদায় করতে পারেনি। পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট লেনদেনের ক্ষেত্রে এমন একতরফা দাবী পূরণ বিশ্বের আর কোনো দেশে দেখা যায় না। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ কি পেয়েছে? এমন প্রশ্ন যদি করা হয় তবে দেখা যাবে, কেবল আশ্বাস নামক অনিশ্চয়তা ছাড়া আর কিছুই পায়নি।
সরকারের পক্ষ থেকে আমরা এন্তার উন্নতির কথা শুনি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন নিয়ে গর্ব করতে দেখি। সরকার কি একবার ভেবে দেখেছে, পানির অভাবে কৃষি জমির পরিমাণ কমে গেলে এ স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখা যাবে কিনা? ইতোমধ্যে সেচযোগ্য জমির পরিমাণ যেভাবে কমছে, তাতে যে টান ধরবে, তা কি সামাল দিতে পারবে? আমরা মনে করি, এ বিষয়গুলো সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে ভাবতে হবে। ভারতের বৈরি আচরণ নিরসনে যেমন উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনি নদ-নদীর নাব্য ধরে রাখতে ড্রেজিংসহ কার্যকর নদী শাসন নিয়মিত করতে হবে। আমরা দেখতে চাই, পররাষ্ট্র সচিব অভিন্ন নদ-নদীর পানি সমস্যা তুলে ধরতে দিল্লী গিয়ে কী সাফল্য লাভ করেন। দেশবাসীকে কী সুখবর দেন। দেশবাসী এখন আর আশ্বাসের মধ্যে থাকতে চায় না। তারা বাস্তব ফলাফল দেখতে চায়। আমরা আশা করব, পররাষ্ট্র সচিব দিল্লী থেকে ফিরে বৈঠকের বিষয়বস্তু জনগণকে অবহিত করবেন। দেশের মানুষকে সুখবর দেবেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পানি বণ্টন নিয়ে পররাষ্ট্র সচিবের দিল্লী সফর
আরও পড়ুন