পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিশ্বের বসবাস-অযোগ্য নগরীর তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা রানার্স-আপের মর্যাদা লাভ করেছে। চ্যাম্পিয়নের তকমা লাভ করেছে সিরিয়ার রাজধানী যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরী দামেস্ক। যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের প্রকাশিত বিশ্বের ১৪০টি নগরীর তালিকায় ঢাকাকে রাখা হয়েছে ১৩৯তম স্থানে। অবকাঠামোগত অবস্থা, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা, সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তির মান বিবেচনা করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বর্ণিত নিকৃষ্ট ১০টি নগরীর ৬টি আফ্রিকার, ৩টি এশিয়ার ও ১টি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ পাপুয়া নিউগিনির। দামেস্ক ও ঢাকা ছাড়া শীর্ষ বসবাস-অযোগ্য তালিকায় এশিয়ার অন্য যে নগরীর নাম স্থান পেয়েছে তা হলো পাকিস্তানের বৃহত্তম নগরী করাচি। আফ্রিকার নগরীগুলোর মধ্যে নাইজেরিয়ার লাগোস, জিম্বাবুয়ের হারারে, লিবিয়ার ত্রিপোলি, ক্যামেরুনের দুয়ালা, আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স ও সেনেগালের ডাকার রয়েছে। সিরিয়ার রাজধানী বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠার পেছনে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা মূলত দায়ী। কিন্তু রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রে সে ধরনের সমস্যা না থাকলেও দ্বিতীয় শীর্ষ অযোগ্য নগরীতে পরিণত হওয়ার বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। প্রতিবেদনে স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে ১০০ পয়েন্টের মধ্যে ঢাকা পেয়েছে ৫০, স্বাস্থ্যসেবায় ২৯ দশমিক ২, শিক্ষায় ৪১ দশমিক ৭, অবকাঠামোয় ২৬ দশমিক ৮ এবং সংস্কৃতি ও পরিবেশে ৪০ দশমিক ৫ পয়েন্ট। সার্বিকভাবে ঢাকার অর্জিত পয়েন্ট ১০০-এর মধ্যে ৩৮। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তালিকায় সবচেয়ে নিচে থাকা নগরীগুলোয় জীবনযাত্রার বেশির ভাগ সুবিধাই পাওয়া যায় না। তালিকায় সবচেয়ে ভালো নগরীর মর্যাদা পেয়েছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। এরপর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, জাপানের ওসাকা, কানাডার ক্যালগেরি, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, কানাডার ভ্যানকুভার ও টরন্টো, জাপানের টোকিও, ডেনমার্কের কোপেন হেগেন ও অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড। স্বাধীনতার আগে রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৭ লাখের মতো, বর্তমানে তা পৌনে ২ কোটিতে পৌঁছেছে। যানজটে অচল ঢাকা মহানগরী বাড়তি জনসংখ্যার ধকলে প্রতিনিয়ত ধুঁকছে।
ঢাকাকে বসবাসের যোগ্য নগরীতে পরিণত করতে হলে প্রয়োজন সমন্বিত প্রয়াস। কিন্তু সে ক্ষেত্রে রয়েছে মারাত্মক ঘাটতি। বসবাসের যোগ্য নগরী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তুলতে হলে এসব সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের উদ্যোগ নিতে হবে। অযোগ্য নগরীর লজ্জা কাটিয়ে উঠতে সরকার, সিটি করপোরেশন ও নাগরিকদের একাট্টা হতে হবে। ঢাকার এই বসবাস অযোগ্যতার নানা কারণের মধ্যে দূষণ, জলাবদ্ধতা ও যানজট অন্যতম। রাজধানীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা রীতিমতো অচল হয়ে পড়েছে। ফলে নিম্নাঞ্চলগুলো সামান্য বৃষ্টিতেই পানিতে তলিয়ে যায়। এখনো ঢাকার চারপাশের নদীগুলো ভরে যায়নি। পানি দেরিতে হলেও নামতে পারছে। ভরা বর্ষায় নদীগুলো যখন কানায় কানায় পূর্ণ থাকবে কিংবা উপচে পানি ঢুকবে তখন এই মহানগরীর অবস্থা কী হবে, এমন ভাবনা অনেকেরই ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ঢাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার এই দুরবস্থা আজ থেকে নয়। দুর্নীতির আখড়া হিসেবে খ্যাত ঢাকা ওয়াসার কাছে নাগরিক দুর্ভোগ কোনো মূল্য পায় না। রাজধানীর খাল উদ্ধারের নামে সংস্থাটি অতীতে খাল ভরাটে কৃতিত্ব দেখিয়েছে। বর্ষায় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে বরাবরই নাগরিক দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। তাদের কার্যক্রমে নজরদারি বাড়িয়ে দ্রুত এই জলাবদ্ধতা নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে।
বিশ্বে বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান নগরবাসীর জন্য পীড়াদায়ক বৈকি। কিন্তু বাস্তবতাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। ঢাকাকে বলা হয় বস্তির শহর, কংক্রিটের নগর, যানজট, জনজট স্বাভাবিক তার জীবনজুড়ে, কোলাহলে পূর্ণ তথা শব্দদূষণের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে বায়ুদূষণ পরিবেশদূষণ, বর্জ্যদূষণ মিলিয়ে এক নারকীয় অবস্থা বৈকি। বসবাসের অযোগ্য হিসেবে বিশ্বের মধ্যে প্রথম সারির তালিকায় থাকা ঢাকা নাগরিক সুযোগ সুবিধাগুলোর বিধান না রেখেই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। তার নগরায়ন হচ্ছে জঞ্জালপূর্ণতায়। তিলোত্তমা নগরীর স্বপ্ন তবু এরই মাঝে দেখানো হয়, শেখানো হয়। কিন্তু আদতে দুঃস্বপ্নের ভারে ডাস্টবিনের গন্ধে ভরপুর থাকে নগরী। ঢাকা এখন শিল্প-বাণিজ্য, প্রশাসনিক ও শিক্ষার শহর হিসেবেও খ্যাত। কিন্তু নগরীর পুরনো অংশ তার ঐহিহ্য ধরে রাখতে পারেনি। ঘিঞ্জি অবস্থা আর অধিক জনসংখ্যার চাপে পুরান ঢাকা আধুনিকতার স্পর্শে রঞ্জিত হয়ে উঠতে পারছে না। ছোট ছোট শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠায় একটা দূষিত পরিবেশ বিরাজ করছে। রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা থেকে বিষাক্ত গ্যাস যেমন ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে, তেমনি অগ্নিকান্ডের ঘটনাও কম নয়।
স্বাধীনতাপূর্বকালে ঢাকা শহরে যে সাত লাখ মানুষ বসবাস করত, তাদের চাহিদানুপাতেও পানি, বিদ্যুতের সরবরাহ করা সম্ভব হতো না। একুশ শতকে এসে লোকসংখ্যা প্রায় দু’কোটি। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দূরে থাক, স্বাভাবিক চাহিদাটুকু মেটানোও সম্ভব হয় না, এই বিপুল জনসংখ্যার জন্য। তাই দেখা যায় আবাসিক এলাকাগুলো বাণিজ্যিক অঞ্চলে পরিণত হতে। রাস্তাঘাটে মানুষ আর মানুষ। তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে হরেক কিসিমের যানবাহন। সবখানেই হাট-বাজার এমনকি ফুটপাত ও প্রধান সড়কজুড়ে দোকানপাট আর বিপণিবিতানে সয়লাব। আবাসিক ভবনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কারখানা পর্যন্ত চলছে। পোশাকশিল্প, খুচরা যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানার সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। বাসাবাড়িতে বিষাক্ত রাসায়নিক গুদাম, চামড়ার কারখানা, বর্জ্যের ডিপো, গুদামঘর। যেখানে সেখানে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন, যেখানে নেই গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা।
জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ রাজধানী ঢাকার সঙ্কট নানাদিকে পূর্ণ, সড়ক দখল করে ভবন নির্মাণ হয় যে শহরে, ফুটপাতগুলো পথচারীদের চলাচলের অযোগ্য, খানাখন্দপূর্ণ সড়ক আর ধুলোবালির সম্প্রসারণ স্বাভাবিক বিষয়। ঢাকাকে ঢেলে সাজানোর মতো অবস্থা আজ সুদূরপরাহত। বাসযোগ্য যদি না হয় রাজধানী তবে তো বিপদ বাড়ে। রাজধানীকে রাজধানীর মর্যাদা দিতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সব ধরনের শিল্পকারখানা পর্যায়ক্রমে সরিয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে নেয়া। বিশেষ করে চামড়া ও চামড়া প্রক্রিয়াজাত শিল্প, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা নির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত বা অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থানান্তর করা প্রয়োজন। এছাড়া রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের খালবিল ও নিম্নভূমি জলাধার সংরক্ষণের লক্ষ্যে জরুরীভিত্তিতে পরিকল্পিত ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত আবশ্যক। এসব স্থানান্তর হলে শহরে জনসংখ্যার চাপ যেমন কমবে, তেমনি একে কেন্দ্র করে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা স্থাপনাসমূহও দূরীভূত হবে। জনগণের জন্য বসবাসোপযোগী হোক ঢাকা- এমন প্রত্যাশা চিরকালের।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টা ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।