পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০০৯ সালের মার্চে বলেছিলেন, তাঁর দেশের বিদ্যালয়গুলোর কর্মদিবস বৃদ্ধি করা প্রয়োজন কারণ সেখানে বিদ্যালয়গুলোতে অন্যান্য দেশের চেয়ে তুলনামূলক কম কর্মদিবস রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়ার ছেলেমেয়েদের চেয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা এক মাস কম সময় বিদ্যালয়ে কাটায়।’ উল্লেখ্য, বিশ্বের কোথাও এর থেকে কম আর কোন দেশে বিদ্যালয় কর্মদিবস আছে কিনা সেটি জানা নেই, তবে বাংলাদেশের বিদ্যালয় কর্মদিবস অন্য যেকোন দেশের থেকে বেশি।
বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশে বার্ষিক কর্মদিবস মোট ২৪৭ দিন (এনসিটিবি-২০১৫)। আক্ষরিকভাবে বিদ্যালয়ের এমন কর্মদিবস আমাদের মনের শান্তির খোঁরাক দেয়। কিন্তু এ কথা এখানেই শেষ হলে আর নতুন করে কথা বলার প্রয়োজন থাকত না। এই ২৪৭ দিনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বিভিন্ন দিবস উদযাপন দিবস এবং পাবলিক ও সাময়িক পরীক্ষা গ্রহণ দিবস। উদযাপন দিবস বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত থাকে কিন্তু শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকে।
বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে দুটি অভ্যন্তরীন পরীক্ষা চালু রয়েছে যাতে করে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এইসব পরীক্ষার জন্য মোট ১২টি বিষয়ের জন্য ১২ দিন করে ২৪ দিন ব্যয় হয় যখন কোন শ্রেণি কার্যক্রম চলে না। এটি এখানেও থেমে নেই, নবম-দশম শ্রেণি ছাড়াও অন্য তিনটি ক্লাসের পরীক্ষা গ্রহণ করার জন্য সমন্বয় করে সকাল-বিকেল শিফট করা হলেও পরীক্ষা চলাকালীন সময় বিভিন্ন বিষয়ের আগে-পরে এক বা একাধিক দিন নির্দিষ্ট শ্রেণির পরীক্ষা গ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়। এ সময় শ্রেণি কার্যক্রমও বন্ধ থাকে। তাই বলা যায়, দুটি সাময়িক পরীক্ষার পেছনে ২৪ দিন নয় বরং আরো ২ সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় পেরিয়ে যায়।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বার্ষিক কর্মদিবস নিয়ে কথা বলতে গেলে এই পর্যায়ে গৃহীত পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। ‘সার্ক’ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সব থেকে বেশি পাবলিক পরীক্ষায় অংশ করতে হয় বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এসব শিশু-কিশোরদের মোট ৪টি পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হয়। পঞ্চম শ্রেণিতে প্রাথমিক/ইবতেদায়ি সমাপনী, অষ্টম শ্রেণিতে জুনিয়র মাধ্যমিক/দাখিল সার্টিফিকেট, দশম শ্রেণিতে মাধ্যমিক/দাখিল সার্টিফিকেট এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে উচ্চমাধ্যমিক/আলিম সার্টিফিকেট পরীক্ষা।
শিক্ষাবর্ষ ও বার্ষিক বিদ্যালয় কর্মদিবস প্রণয়নে কোন নির্দিষ্ট দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ে আলোচনা অন্যতম প্রধান বিষয়। প্রত্যেকটি দেশের আবহাওয়া বিবেচনায় নিয়ে বছরের একেক সময় থেকে একেক সময় পর্যন্ত, শিক্ষাবর্ষ গণনা করা হয়। যেমন কানাডাতে সেপ্টেম্বর-জুন, ইংল্যান্ডে সেপ্টেম্বর-জুলাই, জাপানে এপ্রিল-মার্চ, দক্ষিণ আফ্রিকায় জানুয়ারি-ডিসেম্বর, সুইডেনে ১৫ অক্টোবর-১৫ আগস্ট, নিউজিল্যান্ডে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বর ইত্যাদি। বাংলাদেশে সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর হিসেবে শিক্ষাবর্ষ গণনা করা হয়। কিন্তু এর পেছনে কী ধরনের ব্যাখ্যা আছে সেটি স্পষ্ট নয়। প্রতিবেশী ভারতের ক্যালেন্ডারে চোখ রাখলে দেখি তাঁদের শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় ১ জুন এবং শেষ হয় ৩১ মে।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশের আবহাওয়া বিবেচনায় নিলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ধরে রাখার মতো তুলনামূলকভাবে বেশি উপযুক্ত সময় হলো নভেম্বর, ডিসেম্বর জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাস। অন্যান্য মাসে প্রায় সময়ই ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি না একটি লেগেই থাকে। এতে হয়ত শহরের ছেলেমেয়েদের তেমন সমস্যায় পড়তে হয় না তবে গ্রামের চিত্র অন্য রকম। বৃষ্টিতে যেমন এক গ্রামের সাথে অন্য গ্রামের যোগাযোগ কার্যত বন্ধ থাকে তেমনি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতিও কমে যায়। এমন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে যেগুলোতে স্বাভাবিক আবহাওয়ায় শিক্ষার্থীদের দাঁড়িয়ে ক্লাস করতে হয় যদি উপস্থিতি ভালো থাকে, কিন্তু বৃষ্টি-বাদলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের বই রাখার জায়গা ঠিকভাবে পায় না। উপরে ছাদের পরিবর্তে জীর্ণ টিনের চালা থাকার কারণে শ্রেণিকক্ষে পানি পড়ে। আবার গ্রীষ্মের সময়ও দাবদাহ সহ্য করতে হয় যা শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার অনুপযুক্ত।
বিষয় হল, যে সময় শিক্ষার্থীরা ক্লাসে মন দেয়ার উপযুক্ত আবহাওয়া পায় তখন তাঁরা থাকে বিভিন্ন রকম কো-কারিকুলার কার্যক্রমে ব্যস্ত না হয় পরীক্ষা নিয়ে। আর যে সময় বৈরী আবহাওয়া থাকে, ক্যালেন্ডারে তখন শ্রেণি কার্যক্রম। আমাদের শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় জানুয়ারি মাসে, এ মাসে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন রকম বিদ্যালয়ের ও বিদ্যালয়ের বাইরে নানান সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমে জড়িত থাকে, ফেব্রুয়ারি থাকে মাধ্যমিকের পাবলিক পরীক্ষা, কখনও এটি মার্চ মাসে গিয়েও ঠেকে। এপ্রিলের শুরু থেকে মে মাসের অর্ধেকটা চলে যায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা যা বিদ্যালয়ের শ্রেণি কর্মদিবস আরো কমিয়ে দেয়।
অনেকেই হয়ত বলবেন, পাবলিক পরীক্ষার সময়তো শুধু কেন্দ্র বা ভেন্যুগুলোতে শ্রেণি কার্যক্রম চালানোতে সমস্যা হবে কিন্তু অন্য প্রতিষ্ঠান তো মুক্ত। তাছাড়া যেদিন পরীক্ষা থাকে না সেদিন ক্লাস নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। বাস্তব চিত্র হল এর বিপরিত। এ বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার কেন্দ্র সংখ্যা ৩ হাজার ৪১২টি এবং উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষায় মোট কেন্দ্র গিয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৪১টিতে। অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে সিংহভাগ বেঞ্চ নিয়ে যাওয়া হয় ওইসব কেন্দ্র ও ভেন্যুতে। নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষককেও পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করার জন্য যেতে হয় যাতে সত্যিকার অর্থেই শ্রেণিকার্যক্রম চালানো অসম্ভব হয়ে যায়। আমাদের দেশের অভিভাবক, শিক্ষার্থী এবং যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন বা ভাবেন তাঁরা নিশ্চয়ই এর সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন না, বিশ্বাস করি তাঁরাও এ নিয়ে উদ্বিগ্ন।
আমরা ৩৬৫ দিনের বেশি একটি শিক্ষাবর্ষে পেতে পারি না তাই দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাবর্ষ বছরের শুরুর দিক থেকে গণনার চেয়ে বছরের মাঝামাঝি এমন কোন একটি মাস বা সময় থেকে করা হোক যখন থেকে গণনা করলে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি উপযুক্ত সময়গুলোসহ শিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম বা পরীক্ষার মধ্যে হারিয়ে যাবে না। এ বিষয়ের ওপর অনেক শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, শিক্ষাবিদ বা শিক্ষা গবেষকদের মত রয়েছে। আর পাবলিক পরীক্ষাসমূহ কমিয়ে কিংবা এর দৈর্ঘ্য ছোট করে ফেলা যায় কিনা সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কেননা প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি সত্যিকার অর্থে সৃজনশীল হলে সেখানে ৩ ঘণ্টার পরীক্ষা অনেকাংশে নিষ্প্রয়োজন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের পাবলিক পরীক্ষা একই সাথে সকাল-বিকাল করে নেওয়া হলেও আমাদের শিক্ষাবর্ষ থেকে আরো ৩০ দিন বাঁচানো যাবে। বেশি ভালো হয় যদি পাবলিক পরীক্ষার চেয়ে অভ্যন্তরীন পরীক্ষাগুলোতে গুরুত্ব বেশই দেয়া হয় যেমন হয়ে থাকে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।