Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে সড়ক নৈরাজ্য

রফিকুল ইসলাম সেলিম : | প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

কক্সবাজার থেকে যাত্রীবাহি ‘শাহ গদি’ পরিবহনের বাসটি পটিয়ার বাদামতল আসতেই দু’টি চাকা খুলে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়। প্রায় ৭০ জন যাত্রীসহ বাসটি হঠাৎ প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে মহাসড়কে থেমে যায়। বাসটির যাত্রী অহিদুল্যাহ সিরাজী ওয়াহিদ বলেন, যাত্রীদের মধ্যে কেউ হয়তো আল্লাহর খাস বান্দা ছিলেন এ কারণেই বড় দুর্ঘটনা থেকে সবাই রক্ষা পেয়েছেন। গতকাল (বৃহস্পতিবার) এ দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ওই এলাকায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। পুলিশ বলছে, বাসটি পুরাতন লক্কর-ঝক্কর। নতুন করে রঙ লাগিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে।
সকালে বন্দর নগরীর বাকলিয়া রাহাত্তারপুল এলাকায় আনোয়ারাগামী যাত্রীবাহি বাসের চাপায় অটোরিকশার দুই যাত্রী ঘটনাস্থলে নিহত আরও তিনজন আহত হন। দুর্ঘটনার পরপর বেপরোয়া বাসের চালক ইয়াসিনকে আটক করে পুলিশ। থানার ওসি প্রণব কুমার চৌধুরী বলেন, চালকের কোন লাইসেন্স নেই। বাসটির কোন বৈধ কাগজপত্রও পাওয়া যায়নি। সোমবার সিটি সার্ভিসের ৪ নম্বর রুটের একটি বাস সিটি গেইটের অদূরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কালীর হাটে এক যাত্রীকে পিষে মারে। ভাড়া নিয়ে বাসের ভেতর যাত্রী রেজাউল করিম রনির সাথে কথা কাটাকাটি হয় বাসের সহকারীর। এর জের ধরে বাস থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে তার উপর দিয়ে বাস চালিয়ে এগিয়ে যায় চালক। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক মহাসড়ক অবরোধ করে স্থানীয়রা। বাস চালক দিদারুল আলম ও সহকারী মো. মানিককে আসামি করে হত্যা মামলা হয়েছে। কিন্তু তাদের কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি। দোষীদের সাজার দাবিতে নগরীতে বিক্ষোভ সমাবেশ মানববন্ধন চলছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের সড়ক-মহাসড়কে এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছেই। প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষের আহাজারি। জীবনের তরে পঙ্গুত্ববরণ করছে অনেকে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের পর তড়িঘড়ি করে ১০ দিনব্যাপী ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করা হলেও সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফিরেনি। ঈদের ছুটিতে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল কিছুটা কম থাকায় বিশৃঙ্খলার চিত্র চোখে পড়েনি। ছুটি শেষে সড়কে যানবাহনের চাপ বাড়তেই আবার সেই পুরনো চিত্র ফুটে উঠছে। সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন চালকের বেপরোয়া আচরণ কমেনি। নিষিদ্ধ হওয়ার পরও মহাসড়কে হালকা যানবাহন চলছে আগের নিয়মে।
ট্রাফিক সপ্তাহে চট্টগ্রাম মহানগরীর ১০ দিনে ১১ হাজার ৭১২টি যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আটক করা হয় ৯৪৫টি যানবাহন। ১০ দিনে জরিমানা আদায় হয়েছে ৩৫ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ট্রাফিক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি মামলা করা হয়েছে মোটর সাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে। অটোরিকশার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এক হাজার ৭০৯টি। মোটর সাইকেলের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দুই হাজার ৪৫৮টি। বাস মিনিবাসের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে ৮৩৮টি। আর ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৮৭৮টি। এছাড়াও ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাস ও পিকআপের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৮৯৮টি। জেলা পুলিশের অভিযানেও কয়েক হাজার মামলা এবং কয়েকশ যানবাহন আটক করা হয়। কিন্তু এ ট্রাফিক সপ্তাহের কোন সুফল মিলছে না।
বিআরটিএর হিসেবে, চট্টগ্রামের রাস্তায় হালকা ও মাঝারি ধরনের সোয়া দুই লাখের মতো যানবাহন চলাচল করে। এরমধ্যে এক লাখ ৯৫ হাজার চালকের লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। বাকি প্রায় ৩০ হাজার যানবাহন চালকের কোন লাইসেন্স নেই। অর্থাৎ লাইসেন্স ছাড়াই যানবাহন চালাচ্ছেন ৩০ হাজার চালক। মহানগরীতে গণপরিবহন চালকদের বিরাট অংশের লাইসেন্স নেই। অনেকে মোটরসাইকেল বা অটোরিকশার মতো হালকা যানবাহনের লাইসেন্স নিয়ে বাস ও ট্রাক চালাচ্ছেন। বাস চালকদের বিরাট একটি অংশ চালকের সহকারী। টেম্পু ও হিউম্যান হলার এবং ব্যাটারিচালিত টমটম চালকদের বেশিরভাগই শিশু এবং কিশোর। মহানগর এবং জেলায় বেশিরভাগ মোটরসাইকেলের বৈধ কাগজপত্র নেই। চালকদেরও নেই কোন সনদ। সড়কে নৈরাজ্যের জন্য এসব মোটরসাইকেল চালকরাই অনেকাংশে দায়ী।
ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ট্রাফিক সপ্তাহের পরও যানবাহনের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। গতকাল নগরীর টাইগার পাসসহ কয়েকটি এলাকায় বিআরটিএর উদ্যোগে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করা হয়। ট্রাফিক পুলিশের উদ্যোগে নিয়মিত অভিযানেও যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা এবং জরিমানা করা হচ্ছে। মামলা করার পরও সংশ্লিষ্ট চালকরা নিজেদের লাইসেন্স নিচ্ছেন না আবার যানবাহনেরও ফিটনেস সার্টিফিকেট নিচ্ছে না। এতে করে একেকটি পরিবহনকে একাধিক মামলা দেয়া হচ্ছে। পুলিশ মামলা দিয়েই দায় শেষ করছে। আর পরিবহন চালকেরা জরিমানা দিয়ে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চালানো অব্যাহত রেখেছে। ফলে সড়কে শৃঙ্খলা আসছে না।
পুলিশের অভিযানের মুখে বিআরটিএতে ফিটনেস সনদ ও লাইসেন্স তৈরির জন্য ভিড় বাড়ছে। নতুন লাইসেন্স পুরনো লাইসেন্স নবায়ন, ফিটনেস সনদ ডিজিটাল নাম্বার প্লেট তৈরির আবেদন স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে। তবে নতুন করে লাইসেন্স গ্রহণের জন্য আবেদনের সংখ্যা তেমন বাড়েনি। বিআরটিএর হিসেবে, চট্টগ্রামে লাইসেন্সধারী এক লাখ ৯৫ হাজার চালকের মধ্যে এক লাখ আট হাজার ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল চালক। বাস্তবে মোটরসাইকেল চালকের লাইসেন্সধারীদের অনেকে ভারী যানবাহন চালাচ্ছেন। অনেকে শিক্ষানবিশ লাইসেন্স দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। অদক্ষ চালক আর ফিটনেসবিহীন যানবাহনের পাশাপাশি সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য দায়ি ছোট গাড়ির জোয়ার। মহাসড়কে ছোট যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও তা কেউ মানছে না। চালকদের বেপরোয়া আচরণ আর ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতার কারণে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ