Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বন্দরে মুসলিম নারীর সাথে ঘৃণ্য ও অপমানকর আচরণ

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৫ আগস্ট, ২০১৮, ৭:২৫ পিএম
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছাত্রী ও ওয়েবসাইট জয়নাব রাইটস-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক জয়নাব মার্চেন্ট বোস্টন থেকে ওয়াশিংটন ডি.সি.তে ভ্রমণের ব্যাপারে এমনিতেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। একজন মুসলিম নারী হিসেবে ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ভীতিকর পদ্ধতির ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। তবে ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর অধিবাসী জয়নাব জানতেন তার জন্য কি প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি জানতেন, বিমান ভ্রমণের জন্য উড্ডয়ন সময়ের দু’ঘন্টা আগে পৌঁছার নিয়ম থাকলও সে সময়ের আরো অনেক আগেই যেতে হবে। তিনি আরো জানতেন, বিমান বন্দরে পৌঁছার পর পরিবহন নিরাপত্তা প্রশাসন (টিএসএ) এজেন্টরা তাকে একপাশে টেনে নেবে, তার ব্যাগগুলো তল্লাশি করবে। শুধু তাই নয়, তার দেহে কোনো অস্ত্র লুকানো আছে কিনা তাও পরীক্ষা করবে। জয়নাব বলেন, গত দু’বছর যাবত এটা তার কাছে নতুন স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তিনি যা জানতেন না তা হল নিরাপত্তা চেক পয়েন্টের এক টিএসএ কর্মকর্তা তার উরুসন্ধির অংশ আরো ভালো করে দেখা প্রয়োজন বলে অন্য এজেন্টদেরকে নির্দেশ দেবেন। 
হাফপোস্টকে জয়নাব বলেন, তিনি দু’জন টিএসএ অফিসারকে জানান যে তার মাসিক চলছে এবং সে কারণে তিনি মাসিক প্যাড পরে আছেন। তার সে কথা তারা শোনেনি। তিনি তখন জোর দিয়ে বলেন যে তাকে অতিরিক্ত তল্লাশি করা হলে তা সবার সামনে করা হোক। কারণ তিনি ভয় করছিলেন যে কোনো সাক্ষী ছাড়া তাকে কোনো গোপন স্থানে নেয়া হলে আরো খারাপ কিছু ঘটতে পারে।
কিন্তু জয়নাব জানান, টিএসএ অফিসাররা তার দাবি প্রত্যাখ্যান করে এবং তাকে ভয় দেখায় যে তিনি যদি তাদের কথা না শোনেন তাহলে কর্তব্যরত স্টেট ট্রুপারদের কাছে তাকে তুলে দেয়া হবে। গোপন পরীক্ষার জন্য চাপের মুখে তিনি গোপন কক্ষে যেতে বাধ্য হন। তিনি তার আইনজীবীর সাথে কথা বলতে চাইলেও সে সুযোগ দেয়া হয়নি। গোপন কক্ষে নিয়ে যাওয়ার পর টিএসএ অফিসাররা তার প্যান্ট ও আন্ডারওয়ার খুলে ফেলার নির্দেশ দেয়। 
আতংকিত ও একা জয়নাব তাদের নির্দেশ মত রক্তভেজা মাসিক প্যাড খুলে তাদের দেখান। এ ঘৃণ্য ও অপমানজনক কাজ করতে বাধ্য হওয়ার পর তিনি অফিসারদের নাম ও তাদের ব্যাজ নম্বর জানতে চান। টিএসএ অফিসাররা হাত দিয়ে তাদের ব্যাজ ঢেকে রেখেছিল। তারা তা না জানিয়েই চলে যায়। 
২৭ বছর বয়স্কা জয়নাব মার্চেন্ট বলেন, গত দু’ বছর ধরে তিনি যে হয়রানি ও অত্যধিক তল্লাশির সম্মুখীন হয়েছেন, এ বিরক্তিকর ঘটনা তারই একটি। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে তিনি বারবার এসব ঘটনার শিকার হন যাকে আমেরিকার নাগরিক স্বাধীনতা ইউনিয়ন (এসিএলইউ) হয়রানিমূলক ,অপমানজনক তল্লাশি বলে আখ্যায়িত করেছে। তা এমনভাবে করা হয় যা দ্বৈততাপূর্ণ  ও অকারণ। তিনি যতবার বিমানে আরোহণ এবং বাইরে থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পুনঃপ্রবেশ করেছেন প্রতিবার তার এ তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। 
এ সপ্তাহে এসিএলইউ তার পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে  (ডিএইচএস) আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করেছে। অভিযোগে বিমান ভ্রমণের সময় তাকে যাতে হয়রানি না করা হয় সে আহবান জানানো হয়েছে। এসিএলইউ মনে করে যে তাকে সরকারের নজরদারি তালিকাভুক্ত করার কারণেই তাকে বারবার ও অকারণ তল্লাশি করা হয়। 
জয়নাব বলেন, প্রত্যেকবারই আমাকে অত্যধিক তল্লাশির শিকার হতে হয়। প্রত্যেকবারই এই ঘটনা ঘটে। তৃতীয় বার যখন ঘটল তখন আমি উপলব্ধি করি যে এটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। এটা নিশ্চিতই একটি পদ্ধতিমাফিক বিষয় এবং আমি এমন এক ধরনের তালিকাভুক্ত যাতে আমাকে বারবার এর শিকার হতে হয়। 
এসিএলইউতে জয়নাবের মামলা যিনি পরিচালনা করছেন সেই সিনিয়র স্টাফ এটর্নি হিউ হ্যান্ডিসাইড স্বাক্ষরিত অভিযোগে বলা হয়েছে, কমপক্ষে ১০ বার তিনি বিমান বন্দরে প্রবেশকালে, অন্য যাত্রীদের সামনে গেটে এমনকি অন্য বিমানের জন্য অপেক্ষাকালীন সময়েও বিমান বন্দর কর্মকর্তাদের দ্বারা অত্যধিক তল্লাশির শিকার হয়েছেন। অভিযোগে সময়ের উল্লেখ করে বলা হয় যে কয়েক মিনিট আগেই তাকে ক্লিয়ারেন্স দেয়া সত্তে¡ও টিএসএ একটি বিস্ফোরক ইউনিট ডেকে তাকে ও তার পরিবারকে ফের তল্লাশি করেছে। আরেকবার টিএসএ কর্মীরা তাকে ও তার ব্যাগগুলো তল্লাশির জন্য ডগ স্কোয়াডকে ডেকে আনে। 
সীমান্ত কর্মকর্তারা তার ধর্মবিশ^াস, তিনি শিয়া না সুন্নি, ইসলামিক স্টেট (আইএস) সম্পর্কে তার চিন্তাভাবনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। তারা তার ওয়েবসাইট দেখেছে এবং জিজ্ঞাসা করেছে কেন তিনি মার্কিন নীতির সমালোচনা করেন। এসিএলইউর অভিযোগে বলা হয়, এ সবই গুরুতর প্রথম সংশোধনী সংশ্লিষ্ট। 
২০১৪ সালে দি ইন্টারসেপ্ট কর্তৃক সংগ্রহীত গোপনীয় সরকারী নথি থেকে জানা যায় যে সরকারী নজরদারি টেরোরিস্ট স্ক্রিনিং ডাটাবেসে ৭ লাখেরও বেশি আমেরিকানকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ঐ তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের অনেকেই মুসলিম অথবা মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাথে যোগসূত্র রয়েছে । কোনো সন্ত্রাসী গ্রæপের সাথে তারা সংশি,øষ্ট নয়। তাদের বোর্ডিং পাসের উপর এসএসএসএস Ñ ‘‘সেকেন্ডারি সিকিউরিটি স্ক্রিনিং সিলেক্টি’’ এবং সিল লাগিয়ে দেয়া হয় এবং নিরাপত্তা কর্মীরা বারবার তাদেরকে তল্লাশি করে। 
হ্যান্ডিসাইড হাফপোস্টকে বলেন, আমাদের এ কথা বিশ^াস করার প্রতিটি কারণ আছে যে তারা এটা শুধু জয়নাবের একার সাথে করছে না। আমরা অন্য লোকদের কাছেও এ ধরনের অভিযোগ শুনেছি। এটা মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্য, আরব অথবা মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সম্প্রদায়গুলোর সদস্যদের জন্য বিরাট উদ্বেগের বিষয়। 
নজরদারির তালিকায় নাম ওঠা মানে কোনো মুসলিমের জন্য অব্যাহত আতংকের বিষয়। গত বছর হাফপোস্ট ৩ জন আমেরিকান মুসলমানের অভিজ্ঞতা দলিলায়ন করে। তারা একটি সরকারী তালিকার অন্তর্ভুক্ত। তারা সে তালিকা থেকে তাদের নাম অপসারণে জটিলতার কথা জানান। 
জয়নাব যখন ক্যাম্পাসে থাকেন না তখন অরল্যান্ডোতে স্বামী ও তিন সন্তানের সাথে থাকেন। তিনি জানার চেষ্টা করেন যে কেন তার নাম নজরদারি তালিকাভুক্ত হল এবং তার নাম অপসারণ করার জন্য তাকে কি করতে হবে। তিনি কংগ্রেস সদস্যদের কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখেছেন।  কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি ডিএইচএস-র ট্রাভেলার্স রিড্রেস ইনকোয়ারি প্রোগ্রামের (টিআরআইপি) কাছে বারবার অনুরোধ জানিয়েছেন। যেসব ব্যক্তি অত্যাধিক তল্লাশির জন্য বারবার চিহ্নিত হয়েছেন এবং ডিএইচএস পদ্ধতির ভুল তথ্যের সংশোধন চান, তাদের জন্যই এ বিভাগ চালু করা হয়েছে। 
কিন্তু তিনি কোনো কেন্দ্রীয় নজরদারি তালিকায় আছেন কিনা তার জবাব পাওয়ার পরিবর্তে তিনি ডিএইচএস-র কাছ থেকে ‘এটা নিশ্চিত করা বা প্রত্যাখ্যান করা নয়’ মর্মে একটি ফর্ম লেটার পান। তিনি অনুমোদিত ভ্রমণকারীর জন্য ছাড়পত্র ত্বরান্বিতকারী শুল্ক ও সীমান্ত রক্ষা (সিবিপি) কর্মসূচি গেøাবাল এন্ট্রির জন্য আবেদন করেন। তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। 
হাফপোস্ট টিএসএর সাথে কথা বললে একজন মুখপাত্র জয়নাবকে যা বলা হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি করেন। মুখপাত্র বলেন, জয়নাব টিআরআইপি ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু জয়নাব সে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
সিবিপি-র এক মাত্র হাপপোস্টকে বলেন, সংস্থা কোনো স্থগিত মামলা সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারে না। কিন্তু সংস্থা সকল অভিযোগ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে এবং সকল আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তদন্ত করে। 
এসিএলইউ টিএসএ ও সিবিপি অফিসারদের আচরণ তদন্ত এবং জয়নাবের মামলার সংশ্লিষ্ট রেকর্ড প্রকাশের আহান জানিয়েছে। হ্যান্ডিসাইড বলেন, এগুলো জনগণের বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, আদালতের বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সরকারের বোঝার জন্য গুরুতা¦পূর্ণ যে  সরকার যখন কারো সাথে বারবার এটা করে , যখন কাউকে চিহ্নিত করে ফেলে, যখন সকলের সামনে তার সব কিছু তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করে এবং আবার তা যখন  গেটে র সহযাত্রীদের সামনে করা হয় তখন সরকার তার উপর প্রকৃতপক্ষেই মনস্তাত্তি¡ক ও মানসিক নির্যাতন চালায়।  সরকার এসব লোককে ভীষণ অপমানজনক অভিজ্ঞতার শিকার করছে।
জয়নাব বলেন, কথা বলার জন্য তাকে শাসিÍ দেয়া হচ্ছে। তা করার পর থেকে তার পরিবারের কয়েক সদস্য ও বন্ধু তার ও তার পরিবার থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে, অন্যরা সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন করেছে। তিনি বলেন, সরকার কেন তার ব্যাপারে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন মনে করেছে, সে জন্য তারা তার ব্যাপারে সন্দেহ পরায়ণ উঠেছে। তারা সরকারের টার্গেট হতে চান না। 
তবে জয়নাব আশাবাদী যে তিনি ন্যায়বিচার পাবেন এবং তার নাম ঐ কুখ্যত তালিকা থেকে বাদ যাবে। তিনি বলেন, আমি আশা করি একদিন তারা আমাদের কথা শুনবে। আমি আমার আধিকারের লড়াই বন্ধ করব না। এটা এখন রোজই আমাতের ক্ষতি করছে। যাই হোক না কেন, আমি হার স্বীকার করব না। আমি তাদের কাছে জবাব চাই যে কেন এসব ঘটছে এবং কিভাবে তা বন্ধ করা যেতে পারে। আমি তো কোনো খারাপ কাজ করিনি। আমি আমার প্রশ্নের জবাব চাই।


 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যুক্তরাষ্ট্রের


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ