পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জির খসড়া তালিকা থেকে সেখানে বসবাসকারী ৪০ লাখের বেশি লোক বাদ পড়েছে। এই বাদ পড়া লোকদের হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ সবাই রয়েছে। এসব মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে এবং এদেরকে বাঙ্গালী বলে অভিহিত করা হয়েছে। বাদ পড়া এসব মানুষ বহু বছর ধরে আসামে বসবাস করে আসছে। এটা কিন্তু কোনভাবেই শুভ লক্ষণ নয় এবং কারো জন্যই কল্যাণকর নয়। এটা নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদ পড়া লোকদের জন্য যেমন কল্যাণকর নয়, ঠিক তেমনি আসাম সরকারের জন্যও কল্যাণকর নয়। একইভাবে আসামের প্রতিবেশী রাজ্য এবং রাষ্ট্রের জন্যও কোন শুভ লক্ষণ নয়। এখানে মানবতার বিপর্যয় হবে, মানুষের মধ্যে বিভক্তি হবে এবং এটা মানবতার জন্যই ক্ষতিকর। ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি কখনোই মানবতার জন্য কল্যাণ বয়ে আনেনি। এটা মানুষের মধ্যকার ঐক্য এবং সম্প্রীতিকে নষ্ঠ করে বিভক্তি সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করে হানাহানি, মারামারি, অনৈক্য এবং বৈষম্য। এটা কখনোই শান্তি এবং সমৃদ্ধির পথে সহায়ক হয়নি। বরং মানুষের মাঝে ঐক্য, সম্প্রীতি এবং ভালোবাসাই একটি শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয় এবং দেশকে উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আসাম এবং কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই নাগরিকত্ব তালিকা তৈরির উদ্যোক্তা। অবৈধ অভিবাসীদের আসাম থেকে বের করে দেয়া হবে এই ঘোষণা দিয়ে ২০১৬ সালের নির্বাচনে আসামের ক্ষমতায় আসে বিজেপি সরকার। সে সময় আসাম থেকে তথাকথিত বাংলাদেশি অভিবাসীদের বের করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল বিজেপি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে অনেক বাংলাদেশি ভারতের আসাম রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল, যারা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আবার নিজ দেশে ফেরত আসে। কিন্তু আসাম রাজ্য সরকারের মতে, নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষগুলো হচ্ছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থী এবং তাদের বংশধর। সে জন্য এই তালিকা তৈরির সময় সেখানকার মানুষদের ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে থেকে বসবাসের প্রমাণ দিতে বলা হয়েছে। তাই যে সমস্ত মানুষ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে থেকে বংশানুক্রমিকভাবে আসামে বসবাসের অকাট্য প্রমাণ দিতে পেরেছে তারাই কেবল আসামের নাগরিকদের এই খসড়া তালিকায় স্থান পেয়েছে। নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে আসামের ৩ কোটি ২৯ লাখ ৯১ হাজার ৩৮৪ জন মানুষ আবেদন ফরম তুলেছিল। তারমধ্যে প্রশ্নাতীতভাবে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে পেরেছেন ২ কোটি ৮৯ লাখ ৮৩ হাজার ৬৭৭ জন। স্বাভাবিকভাবেই বাদ পড়েছে ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭ শত ৭ জন মানুষ। বাদ পড়া এসব ব্যক্তি ৩০ আগস্ট থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক মাসের মধ্যে আপিলের সুযোগ পাবে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে যারা নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে পারবে, তাদের নাম নাগরিক তালিকায় অর্ন্তভুক্ত হবে। অর্থাৎ তারা আসামের নাগরিকত্ব লাভ করবে। এখানে যারা নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হবে তারা এসংক্রান্ত ট্রাইবুনালে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবে। যারা নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ট্রাইবুনালেও ব্যর্থ হবে তারা আদালতে আবেদন করতে পারবে এবং আদালতেও যারা ব্যর্থ হবে তারা নাগরিকত্ব হারাবে এবং রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। অর্থাৎ তারা উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের তত্ত¡াবধানে আসামের নাগরিকদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। প্রকাশিত খসড়া তালিকাটি অসংখ্য ভুলে ভরা এবং শুরুতেই এটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। আসামের অনেক নামীদামি ব্যক্তি, যারা যুগের পর যুগ ধরে আসামে বসবাস করছেন এবং ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাদেরও অনেকের নাম এই নাগরিক তালিকায় ওঠেনি। এমনকি ভারতের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবার পরিজনদের অনেকের নাম এই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ, যিনি ১৯৭৪ সালের ২৪ আগস্ট থেকে ১৯৭৭ সালের ১১ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তার পরিবারের অনেকেই এই নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। এ রকম আরো অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের লোকজন এই নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।
আসাম রাজ্যটি বাংলাদেশের সিলেট সীমান্ত সংলগ্ন। আসামের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই মুসলমান। এরা বাংলা ভাষায় কথা বলে। আসামের বিজেপি সরকারের অভিযোগ এদের বিরাট একটি অংশ বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রেবশ করেছে। সুতরাং এরা ভারতের নাগরিক নয়। ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে একমাত্র আসামেই এই নাগরিক তালিকা তৈরির কাজ চলছে। আসামের এই উদ্যোগ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ ১৯৮২ সালে এইভাবে মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত রোহিঙ্গারা ভোট দিতে পারত এবং তারা প্রতিনিধি নির্বাচন করে দেশটির সংসদে পাঠাত। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৮২ সালের ১৫ অক্টোবর ‘বার্মিজ সিটিজেনশিপ ল’ নামে একটি আইন পাশ করে এবং এতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। ২০১৪ সালের আদম শুমারিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাদ দেয়া হয়। মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য মতে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী নয়। মিয়ানমারের নাগরিকত্ব হারানো রোহিঙ্গারাই আজকে বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হিসেবে বসবাস করছে। বর্তমানে দশ লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছে, যা বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং এ সমস্যা দীর্ঘমেয়াদী সংকটে পরিণত হয়েছে। এখন বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী অভিহিত করে আসাম থেকে যদি আরো লাখ লাখ মানুষকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে এবং বাংলাদেশের জন্য কী পরিমাণ সংকট তৈরি করবে তাতো সহজেই অনুমেয়। আর সেক্ষেত্রে এসব মানুষদের জীবনেও যে রোহিঙ্গাদের মতই ভয়াবহ একটি বিপর্যয় নেমে আসবে, তা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আমরা আশা করব, ভারত এবং আসাম সরকার যে কোন ধরনের নেতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে। ভারত এবং আসাম সরকার এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যাতে করে বর্তমানে আসামে বসবাসকারী সকল ধর্মের, সকল বর্ণের এবং সকল ভাষার মানুষ যেভাবে বছরের পর বছর ধরে মিলেমিশে বসবাস করছে, ঠিক তেমনি আগামী দিনেও সবাই একসাথে মিলিমিশে বসবাস করতে পারে। এর মাধ্যমেই আসামের জনগণের ঐক্য, সম্প্রীতি এবং সংহতি প্রতিষ্ঠা পাবে, যা আসামের শান্তি এবং উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। তা না হলে আসামেও বিশৃংখলা নেমে আসবে এবং সমাজে স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। যে সমস্ত মানুষ নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদ পড়েছে, তারা সেখানে বছরের পর বছর ধরে বসবাস করছে। তারা সেখানকার বিদ্যমান সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা সেখানে বাড়ির মালিক, জমি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাদের ছেলে মেয়েরা সেখানে পড়াশোনা করছে, তারা সেখানে চাকরি করছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। তাদের বিয়েসাদী সেখানে, আত্মীয়তাও সেখানে, অর্থাৎ তারা সেই সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যারা নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়বে তারা কিন্তু অটোমেটিক্যালি ভোটাধিকার থেকে শুরু করে অনেকগুলো অধিকার হারাবে। তারা জমি কেনার অধিকার হারাবে, চাকরি করার অধিকার হারাবে, ব্যবসা করার অধিকার হারাবে এবং আরো অনেক অধিকার হারাবে। ফলে এসব মানুষ একটি রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে এবং উদ্বাস্তু হিসাবেই তাদের জীবন-যাপন করতে হবে। নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষ যদি আসামের অভ্যন্তরেও উদ্বাস্তু হিসেবে বসবাস করে, তখনো এসব মানুষের কর্মদক্ষতা আসামের কাজে আসবে না। ফলে তা আসামের শান্তি এবং উন্নয়নকে পিছিয়ে দেবে। এদিকে এই ইস্যুতে সোচ্চার হয়েছেন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি আসামের এই উদ্যোগের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এই ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গের সাথে আসামের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে, যা ভারতের জন্য মোটেই কল্যাণকর নয়।
লেখক: প্রকৌশলী ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।