Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে কত দিনে

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ১৬ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০২ এএম

জনগণের এ অভিযোগ অনেক দিনের। কিন্তু এর সুরাহা হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। গত মঙ্গলবার দৈনিক ইনকিলাব-এর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রধান সংবাদ প্রতিবেদনের পাঁচ কলাম-দীর্ঘ শিরোনামে উঠে এসেছে বিষয়টি : ‘শৃংখলা ফেরেনি সড়কে’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ছাত্র আন্দোলনের মুখে তড়িঘড়ি করে পুলিশ ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু করলেও রাজধানীসহ সারা দেশে সড়ক ও মহাসড়কের চিত্র পাল্টায়নি। সড়কে আগের মতই চলছে নৈরাজ্য বিশৃংখলা। দীর্ঘ যানজট, অহরহ ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, যত্রতত্র পার্কিং, যেখানে সেখানে গাড়ী থামিয়ে যাত্রী উঠানো নামানো, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে ইচ্ছা মতো রাস্তা পারাপারও আগের মতোই রয়েছে। আইন না মেনে যে যার মতো সেই ফ্রি স্টাইলেই চলছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বন্ধ হয়নি নছিমন-করিমনের মত ছোট যান চলাচল। ৪ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগছে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। ঢাকা-ময়মনসিংহসহ অন্যন্য মহাসড়কের অবস্থা আগের মতোই। মাইলের পর মাইল যানজট লেগেই থাকছে। সড়কের দুই পাশে ট্্রাকের স্ট্যান্ড বসানো হয়েছে। এতে যানজট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে : কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে সারা দেশেই গবাদি পশুর হাট বসার প্রস্তুতি চলছে। ঈদের আগে শহর থেকে সাধারণ মানুষ যখন গ্রামের দিকে ছুটবেন, তখন ভয়াবহ যানজটের আশংকা রয়েছে। এমন কি ট্রাফিক সপ্তাহের মধ্যেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর মত প্রভাবশালী ব্যক্তিকেও দুর্ঘটনায় পড়তে হয়েছে। এর বাইরে প্রতিদিন অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেও পুলিশের পক্ষ থেকে দাবী করা হচ্ছে: ট্রাফিক সপ্তাহ সফল। কিন্তু রাস্তায় সেই সফলতার চিহ্ন মাত্র নেই। গত ১১ আগস্ট বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আরো ৩ দিন বাড়ানো হয়। সারাদেশে চলা বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহে পুলিশের হাতে যানবাহন চালকের হয়রানির অভিযোগ রয়েছে অনেক। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর ৯৮ ভাগ যানবাহন এখন ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও আত্মীয়দের নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া আন্ত:জেলা রুটেও এ চিত্র ৬০ ভাগের বেশী। এ প্রেক্ষাপটে সড়ক দুর্ঘটনা বা ট্্রাফিক আইন না মানার ক্ষেত্রে দÐ দেয়া হলে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা মেয়র, চেয়ারম্যান, কমিশনার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মালিকানায় বেশির ভাগ পরিবহন। এমন কি পুলিশ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাংবাদিকরাও পরিবহন ব্যবসার সাথে জড়িত।
বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন এরকম অরাজকতা হতে বেরিয়ে আসতে হলে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এবং যারা আইন প্রয়োগ করেন সকলকেই আইন মান্য করতে হবে। সকলের সমন্বয়ের মাধ্যমে রাস্তাসহ সর্বত্র আইনের প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। অন্যথায় পরিবহন সেক্টরের মত সর্বত্রই আইন অমান্য করার প্রতিযোগিতা চলতে থাকবে।
মহাসড়কে ফিটনেসহীন যানবাহন ঠেকানোর ঘোষণা দিয়েছেন পুলিশ প্রধান ড. আবেদ পাটোয়ারী। গত সোমবার পুলিশ সদর দপ্তরে এক বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ঘরমুখো মানুষের ঈদ যাত্রা নির্বিঘœ করতে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। ঈদযাত্রা নির্বিঘœ করতে মহাসড়কে ফিটনেসহীন গাড়ী চালাতে পারবে না। গত ১১ আগস্ট ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, বিদেশে যেখানে ৯৮ শতাংশ মানুষ আইন মানে, বাংলাদেশে সেখানে ৯০ ভাগ মানুষ আইন মানেনা। এ ৯০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া আইন শৃংখলা বাহিনীর জন্য সবচেয়ে কঠিন অসম্ভব।
গত সোমবার রাজধানীর মহাখালী, ধানমন্ডি, বিমানবন্দর সড়ক, মালিবাগ, শাহবাগ ও মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নির্ধারিত স্ট্যান্ডের বাইরে যত্রতত্র ওঠানামা চলছে যাত্রীদের। বাসের দরজায় ঝুলে আছে যাত্রীরা। সুযোগ পেলেই উল্টোপথে ছুটছে গাড়ী, ফুটপাতে উঠছে মোরটসাইকেল। পথচারী সেতু ব্যবহার না করে চলেছে রাস্তা পারাপারে। কিছু কিছু জায়গায় দেখাগেছে, ট্রাফিক পুলিশদের হাল ছেড়ে দেয়ার দৃশ্য। চালকের কানে মোবাইল। অনেক পথচারী কানে মোবাইল লাগিয়ে রাস্তার মাঝখান দিয়ে দিচ্ছেন ভোঁ দৌড়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের দেশে আইন না মানার প্রবণতা বহু দিন ধরেই চলে আসছে। এটা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
মহাখালীতে হাবিব নামের এক ট্রাফিক সদস্য বলেন, সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছি সড়কে শৃংখলা আনতে। এক দিকে সামাল দিলে অন্য দিক দিয়ে ট্রাফিক সিগন্যাল অর্থ্যাৎ আইন অমান্য করে চলে যায়। কেউ আইন মানতে চায় না।
পল্টন মোড়ে দীর্ঘ সময় অবস্থান করে দেখা যায় সব সময় এ এলাকায় যানজট লেগেই থাকে। এক কর্তব্যরত ট্রাফিক ইনন্সেপ্টর নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, অনেকে ট্রাফিক সিগন্যাল মানতে চায় না। মালিবাগে বাস চালক সিরাজুল ইসলাম জানান, রেসিং এর মধ্য দিয়েই বাস চালাতে হচ্ছে। সিরিয়ালের গাড়ী হলেও অন্য গাড়ীকে পিছনে ফেলতে না পারলে অতিরিক্ত টাকা রোজগার করা যায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নূরুল আমিন বেপারী বলেন, শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে যানবাহনের ত্রæটির পাশাপাশি রাষ্ট্রর অব্যবস্থাগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তারা যদি এই অব্যবস্থাগুলো দূর করতে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তা হলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে। আইন অমান্য করার সর্বনাশা প্রবণতাও কেটে যেতে পারে। আসলে দেশের মধ্যে আইন অমান্য করার প্রবণতা যে কোন মূল্যে দূর করতে না পারলে চলমান পরিস্থিতির উন্নতি আশা করা হবে এক অবাস্তব ব্যাপার।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে এ ব্যাপারে জানানো হয়েছে যে, গত ৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া ট্রাফিক সপ্তাহে যাদের আইন অমান্যর কারণে আটক করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন যাতে তার নিজস্ব পথে চলে তার নিশ্চয়তা বিধানের চেষ্টা চলছে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, দুই শিক্ষার্থীর নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারা দেশে যে আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল তা আমাদের দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার অনেক দুর্বল দিক দিনের আলোকে আনার ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করেছে। যেমন আমাদের দেশের অনেকেই আইন মান্য করাকে বিশেষ মূল্য দিতে চায় না। আবার অনেকের মধ্যে এমন প্রবণতা রয়েছে, যারা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং তাদের পক্ষে আইন মেনে চলতে সচেষ্ট হওয়া বিশেষ জরুরী নয়। বিশেষ করে যারা সরকারে অধিষ্ঠিত, যেহেতু তাদের নেতৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে, তাই রাষ্ট্রীয় আইনের খুটিনাটি মেনে চলা তাদের জন্য জরুরী নয়। বলে তারা মনে করেন। এই অনাকাঙ্খিত প্রবণতা সরকারী নেতাদের মধ্যে বিরাজ করা ঠিক নয় এর ফলে সরকারের অধিষ্ঠিত দলের নেতা কর্মীদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব ছড়িয়ে পড়ায় তাদের সাথে সাধারণ মানুষদের পার্থক্য প্রকট হয়ে পড়তে পারে। এবং দেশের জনগণের মধ্যে বৈষম্য চিন্তা প্রকট হয়ে পড়তে পারে। এর ফলে দেশে সামগ্রিক উন্নতির জন্য একান্ত অপরিহার্য জাতীয় সংহতি-বোধ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
বর্তমানে যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন, তারা যদি অবিলম্বে এ বিষয়ে তাদের যথাকর্তব্য পালনে মনযোগী না হন, তাহলে দেশে অতি প্রয়োজনীয় শান্তি ফিরে না আসার আশংকা রয়েছে। তাই দেশের বৃহত্তর মঙ্গলের স্বার্থে দেশের বর্তমান কর্নধারদের যথাশীঘ্র তাদের নিজ নিজ কর্তব্য পালনের ব্যাপারে মনযোগী হতে হবে। নইলে জনগণের মধ্যে যে ব্যাপক অনৈক্য ও ভুলবোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে, তা জাতিকে দ্রæত গভীরতর সংকটের মুখে ঠেলে দিতে পারে। দেশ আজ যে দু:খজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, তা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অপরিহার্য দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে তারা সামান্যতম ত্রæটি করলে জাতির ভাগ্যে যে সর্বনাশ নেমে আসবে, তার জন্য ইতিহাস তাদের কখনও ক্ষমা করবে না।



 

Show all comments
  • Mir Irfan Hossain ১৬ আগস্ট, ২০১৮, ২:৫২ পিএম says : 0
    পুলিশকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিবহন ব্যবসা ছাড়তে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়কে শৃঙ্খলা
আরও পড়ুন