পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত ১২ আগস্ট একই সময়ে দু’জন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তির মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেল। যারা তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক হয়েও সমকালীন বিশ্বব্যবস্থা ও সংস্কৃতিকে যথেষ্ট প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এদের একজন মিশরীয় চিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ প্রফেসর সামির আমিন, অন্যজন ভারতীয় বংশোদ্ভুত ত্রিনিদাদিয়ান নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক ভিএস (ভিদিয়াধর সূর্যপ্রসাদ) নাইপল। আমরা তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। এই দুই কীর্তিমান পুরুষের মৃত্যুর সংবাদ তাদের সৃষ্টিশীলতা সমকালীন ও চিরকালীন বিশ্ববাস্তবতা সম্পর্কে চিন্তাধারা সম্পর্কে সমাকালীন বাস্তবতার অনুসঙ্গ হিসেবেই তাদের মূল্যায়ণে আমাদের বিবেককে তাড়িত করে, বাধ্য করে। ভারতীয় উপমহাদেশ, আরব বিশ্ব এবং পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার চলমান সাংর্ঘষিক অবস্থানের কারণেই সদ্য প্রয়াত দুই চিন্তাগুরুর চিন্তা ও সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে আমাদের সাধারণ পাঠকদের কাছে তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। যদিও সাহিত্য ও চিন্তার জগতে ভিএস নাইপল এবং সামির আমিনের তুলনামূলক মূল্যায়ণ এই নিবন্ধের লক্ষ্য নয়, তথাপি এটুকু বলা চলে চিন্তার পরিধি, বিশ্বব্যবস্থার অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ এবং শোষণমুক্ত ও বৈষম্যমুক্ত বিশ্ব গড়ার লড়াইয়ে ভিএস নাইপলের চেয়ে সামির আমিন অনেক বেশী সৃষ্টিশীল ও অগ্রসর। ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে(১৯৩২-২০১৮) জন্মগ্রহণকারী নাইপলের পড়ালেখা ও কর্মতৎপরতা লন্ডনভিত্তিক হলেও ভারত বা তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলোর বিদ্যমান অর্থনীতি ও সমাজবাস্তবতায় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অস্তিত্বের সংগ্রাম, সুযোগ সন্ধান ও বিশ্বাসের মনস্তাত্তি¡ক লড়াই তার গল্প ও উপন্যাসের নিগূঢ় বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে এসেছে। ইউরোপের নোবেল কমিটি নতুন সহশ্রাব্দের প্রথম বছরের(২০০১) নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে ভ‚ষিত করার বহু আগেই নাইপল বুকার সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। নাইপলের বিখ্যাত উপন্যাসগুলো পঞ্চাশ থেকে আশির দশকের মধ্যেই লেখা হয়েছিল। অ্যা হাউজ ফর মি: বিশ্বাস, ইন অ্যা ফ্রি স্টেট, অ্যা বেন্ড ইন দি রিভার ইত্যাদি তার বিখ্যাত রচনাগুলোর মূল বিষয়ই হচ্ছে ভাগ্য সন্ধানী ও অস্তিত্বের সংকটে পড়া মধ্যবিত্ত পরিবারের মনস্তাত্তি¡ক সংগ্রাম।সুদীর্ঘ ৮৫ বছরের জীবনে নাইপলের সাহিত্যে মানুষের জীবন সংগ্রাম, ইতিহাস ও সমাজবাস্তবতার বহুমাত্রিক প্রতিফলন থাকা স্বাভাবিক। সেখানে ত্রিনিদাদ এবং ভারতের সমাজবাস্তবতার সবচে কদাকার দিক বর্ণবাদের মানবিক সংকট যেমন উঠে এসেছে, পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শক্তি এবং ইসলামের প্রভাব সম্পর্কেও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। তবে ভারতীয় সমাজে ইসলামের আগমন ও প্রভাব সম্পকে নাইপল যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন তা পশ্চিমা ইতিহাস গবেষক ও সমাজতাত্তি¡করাও সঠিক বলে মেনে নিতে পারেননি। ইতিহাস গবেষক রিচার্ড ইটন এবং বার্টন স্টেইন নাইপলের দৃষ্টিভঙ্গির ভ্রান্তি খন্ডন করে দেখিয়েছেন ভারতের স্থানীয় রাজারা কিভাবে ইসলামী সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি, সমরকৌশল স্বেচ্ছায় গ্রহণ ও আয়ত্ব করেছিলেন। এসব ইতিহাস গবেষকগণ দেখিয়েছেন, দাক্ষিনাত্বের সুলতানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্থানীয় রাজারা শুধু যে ইসলামের অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন তা নয়, এমনকি সুলতানদের পক্ষ হয়ে অন্য স্থানীয় রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছেন। পরিবর্তনশীল ভারতীয় সমাজব্যবস্থা যখন পশ্চিমা অর্থনীতি ও সা¤্রাজ্যবাদী নীতির দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত। তখন ভারতে হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থানের ইতিহাস সম্পর্কে ভিএস নাইপলের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ বা ইসলামোফোবিয়ার প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। নাইপলের লেখায় এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনের কারণেই সম্ভবত: একটি অত্যন্ত তাৎপর্য্যময় সময়ে তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। তথাকথিত নয়া বিশ্বব্যবস্থ্রা আলোকে মধ্যপ্রাচ্যসহ তৃতীয় বিশ্বকে আমূল বদলে বদলে ফেলার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মিশন নিয়েই শুরু হয়েছিল পশ্চিমাদের ওয়ার অন টেরর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এগার সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী বিমান হামলার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার তিন মাসের মাথায় ২০০১ সালের ডিসেম্বরে নাইপলকে নোবেল পুরস্ক্রা দেয়া হয়। সে সময়ে নাইপলের নোবেল পুরস্কার ইসলাম সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি নতুন করে আলোচনার বিষয়ে পরিনত হয়। তকে সাহিত্য সমালোচকরা তার মানসিক গঠনের নেপথ্য অভিজ্ঞতাগুলোকেও বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। সেখানে ভারত থেকে একটি দরিদ্র হিন্দু পরিবারের ভৃত্য হিসেবে ত্রিনিদাদে গমন এবং শিশু নাইপলের বেড়ে ওঠার মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতার আশ্রয় রয়েছে। নিজের তামাটে বর্ণের চামড়ার ভেতর তিনি লন্ডনে পুরোপুরি স্বেতাঙ্গশ্রেণীর অনুরূপ হয়ে গড়ে উঠেছিলেন। সেখানে ভারত বা পশ্চিমা দুনিয়ায় ইসলামি সংস্কৃতি ও জীবনবোধের অস্তিত্বের বিপক্ষে তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখাবলী ছিল সত্যের অপলাপ। নিজের হিন্দু ভারতীয় ব্যাকগ্রাউন্ডকে তিনি সযতেœ এড়িয়ে চলতে চেয়েছেন এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির স্তাবকতা করে স্বীকৃতি ও সমর্থন লাভের চেষ্টায় নাইপল অনেকটাই সফল হয়েছেন। আদতে নাইপলের নিজস্ব কোন রাষ্ট্র বা সমাজ ছিলনা, যে সমাজকে নিজের মত সাজানোর স্বপ্ন দেখতে বা দেখাতে পারতেন। ভারত বা ত্রিনিদাদ নিয়ে তার তেমন কোন ইচ্ছার প্রতিফলন দেখা যায়নি।
মিশরীয় পিতা এবং ফরাসী বংশোদ্ভুত মায়ের গর্ভে কায়রোতে(১৯৩১-২০১৮) জন্মগ্রহনকারী সামির আমিনের শিক্ষা জীবন প্যারিসে, রাজনৈতিক দর্শনে মার্ক্সবাদী ও কর্মজীবন ইউরোপ-আফ্রিকায় পরিব্যপ্ত হলেও নিজের জন্মভ‚মি মুসলমান হিসেবে ইসলাম ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের বিষয়গুলো তুলে এনেছেন গত ৬ দশকের পরিনত পর্যবেক্ষণ ও গবেষনা কর্মে। নাইপল ও সামির আমিন সমসাময়িক বিশ্¦ের দুই জীবন্ত কিংবদন্তি। তুলনামূলক বিচারে বিশ্বব্যবস্থার নানা অনুসঙ্গে সামির আমিনের রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও কর্মময় জীবন অনেক বেশী বৈচিত্র্যময়। তবে তার ভাগ্যে বৃটিশদের নাইট -স্যার উপাধি, বুকার বা নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির যোগ না ঘটার মূল কারণ হচ্ছে পশ্চিমা অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদের প্রতি তার সচেতন বিরোধিতা ও নিরলস রাজনৈতিক সংগ্রাম। মার্ক্সবাদী চিন্তাধারা, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের সম্পদ লুন্ঠন, বশংবদ শাসকদের দ্বারা সাধারণ মানুষের শোষণ বঞ্চনার ইতিহাসকে তিনি অত্যন্ত বাস্তব ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। ডাক্তার দম্পতির সন্তান সামির আমিন পঞ্চাশের দশকে প্যারিসভিত্তিক কমিউনিস্ট পার্টিতে সক্রিয় হওয়া থেকে শুরু করে সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্ত পর্যন্ত অধিকাংশ রচনাই লিখেছেন বিশ্বের অর্থনৈতিক সমস্যা ও সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। তা কখনো মার্ক্সবাদ, কখনো মাওবাদ আবার কখনো ধর্মীয় গোঁড়ামি উৎরে ইসলামি সমাজব্যবস্থার প্রতি যৌক্তিক-উদার সমর্থক। সেখানে ধর্ম নয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তন ও উত্তরণের রূপরেখাই ছিল তার লক্ষ্য। সামির আমিনের লেখা প্রকাশিত অর্ধশতাধিক গ্রন্থের অধিকাংশই ফরাসী ভাষায়। তবে তিনি কখনোই আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাক্রম থেকে নিজের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেননি। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক শোষণ, পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক বিবর্তন ও পালাবদলের ইতিহাসকে তিনি নির্মোহভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করার পাশাপাশি উত্তরণের সীমারেখাও বাতলে দিয়েছেন। চলমান বিশ্বব্যবস্থার দ্বারা নিস্পেষিত মানবাত্মার মুক্তির জন্য তিনি একযুগ আগে যে রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন এখন তার বাস্তবায়ণের পথ খুলে যেতে দেখা যাচ্ছে। তিনি মূলত ইউরোপকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত হওয়ার পথরেখা অঙ্কন করেছেন, ২০০৬ সালে সামির আমিন লিখেছিলেন, প্যারিস, বার্লিন, মস্কোর মধ্যে একটি কৌশলগত মৈত্রী স্থাপিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। মার্কিনীদের সামরিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সম্ভব হলে বেইজিং এবং দিল্লীকেও এর সাথে অর্ন্তভুক্ত করা যেতে পারে। আমেরিকার ভ্রান্ত, উচ্চাভিলাসি ও দুর্বৃত্তায়িত পরিকল্পনার জবাবে এটা অপরিহার্য বলে মনে করেন সামির আমিন। সামির আমিনের বিশ্ববীক্ষা ইতিমধ্যে অভ্রান্ত বলে প্রমানীত হয়েছে এবং স্বাভাবিক নিয়মেই তা বাস্তবায়িত হতে চলেছে। বিশেষত: ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মার্কিনীদের পশ্চাদপসারণ বা বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমন্বিত উদ্যোগ থেকে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মস্কো, বার্লিন ও বেইজিংয়ের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মেরুকরণ ঘটে চলেছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি, টিপিপি, ইরাণের সাথে ৬ জাতির পারমানবিক চুক্তি থেকে ওয়াশিংটন নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার পর অবশিষ্ট্য পক্ষগুলোর মধ্যকার বোঝাপড়ায় কোন ঘাটতি তো হয়ইনি বরং তাদের মধ্যে সংহতি আরো বেড়েছে। তবে মার্কিনীদের হেজিমনিক ডিজাইন অনেকটা নাজি জার্মানীর অনুরূপ এবং তা মোকাবেলায় ই¦উরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা যর্থাথ নয় বলেও মত প্রকাশ করেছিলেন সামির আমিন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বশংবদ মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যকে বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যা ও সংকটের পাদপীঠে পরিনত করেছে। মিশর, সিরিয়া, ইরাক ও ইরানের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সংকটের পেছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক হেজিমনিক ডিজাইন। প্রায় দুই দশকের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ ও সামরিক আগ্রাসনের পর এখন এই যুদ্ধ আরো ব্যাপকভিত্তিক সামরিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যযুদ্ধে রূপ নিতে চলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মস্কো, বেইজিংসহ সব পরাশক্তি এখন এই হুমকির সম্মুখীন। বিশেষত: ইরানের বিরুদ্ধে অব্যাহত সামরিক হুমকি, ব্যাপক ভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা তথা অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক অবরোধের ঘোষনা, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর রফতানী পণ্যের উপর হাজার হাজার কোটি ডলারের ট্যারিঢ ঘোষনার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যবস্থায় একক মোড়লিপনার স্বাক্ষর রাখছে। ¯œায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের নয়া আগ্রাসনের শুরু থেকেই সামির আমিন বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিনির্মানের তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। পাঁচ-ছয় বছর আগে সৃষ্ট আরব বষন্ত নিয়ে সামির আমিনের বিশ্লেষণটি এখনো স্মরনীয়। তিনি তখনো এই আন্দোলনের ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। আরব বষন্তকে মধ্যপ্রাচ্যে বিদ্যমান সামাজিক-রাজনৈতিক অসন্তোষের বাস্তব প্রতিক্রিয়া হিসেবে গণ্য করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এই আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করবে বলে তিনি যে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন পরবর্তিতে তাই দেখা গেছে। প্রখর ধীসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্তি¡ক সামির আমিন মধ্যপ্রাচ্যসহ পশ্চিমা প্রেসক্রিপশনের গা ভাসিয়ে দেয়া তৃতীয় বিশ্বের তথাকথিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের নেপথ্যে পশ্চিমা কর্পোরেট মিডিয়ার মিথ্যা প্রচারনা এবং বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ’র জিডিপি প্রবৃদ্ধির সার্টিফিকেট ও ফাঁপা বুলির স্বরুপ বার বার তুলে ধরেছেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি মিশরে জামাল আবদেল নাসেরের সময়ের সাথে আনোয়ার সাদাত ও হোসনি মোবারকের শাসনকালের একটি তুলনামূলক বিচার করেছেন। তিনি বলেছেন, নাসেরের সময় মিসরে একটি স্থিতিশীল সংগতিপূর্ণ অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল। আন্তর্জাতিক উপনিবেশবাদের খপ্পর থেকে মিশরকে বে করে আনতে নাসের শিল্পায়নের কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। উপনিবেশবাদী চেয়েছিল মিসর শুধু তুলা রফতানী নির্ভর কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতেই আবদ্ধ থাকুক। মিসরে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের এই ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটেছিল ১৯৫৬ ও ১৯৬৭ সালে ইসরাইলী সামরিক আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে। আনোয়ার সাদাত ও হোসনি মোবারক নাসেরের শিল্পায়ন কর্মসূচি বাদ দিয়ে দিয়ে অনুৎপাদনশীল মুনাফাসন্ধানী অর্থনীতির অনুগামী হয়ে উঠার পর বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ’র মত প্রতিষ্ঠানগুলো মিসরের উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও তাদের এই প্রশংসাকে ভাঁওতাবাজি বলে মনে করেন সামির আমিন। মূলত মিসরের উন্নয়ন- অর্থনীতিকে পরনির্ভরশীল করে রাখাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। বৈশ্বিক মন্দা দেখা দেয়ার সাথে সাথে মিসরের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ার মধ্য দিয়ে তা প্রমানীত হয়েছে। কর্মহীন যুবকদের বেকারত্ব, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও সাধারণ মানুষের পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ স্বরূপ এক যুবকের প্রকাশ্য রাজপথে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক জইন উদ্দিন বেন আলীর বিরুদ্ধে যে গণবিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল সেই বিদ্রোগের ঢেউ মিসর, লিবিয়াসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ার পর রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা তার নাম দিয়েছিল আরব বষন্ত। আরব বষন্ত থেকে মধ্যপ্রাচ্যের গণতন্ত্রকামী জনগণ যে পরিবর্তন প্রত্যাশা করেছিল তাকে ভিন্নখাতে ঠেলে দিয়ে সেখানে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরী করা হয়েছে। ইরাক, লিবিয়া ও মিসরে রিজিম চেঞ্জের পর সিরিয়ায় ব্যর্থতা ঢাকতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে একটি মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়েছে। সামিরের দেখানো সমাজতান্ত্রিক উদার গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদি সমাজব্যবস্থার মধ্যেই বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ-নির্দেশ রয়েছে। পুঁজিবাদী পশ্চিমাবিশ্বের নিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপট ও পরিবর্তনের রূপরেখা হতে পারে সামির আমিনের দেখানো পথ। তার লেখা অর্ধ শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে অ্যা ক্রিটিক থিউরী অব আন্ডার ডেভেলপমেন্ট, অ্যা ক্রিটিক থিউরী অব ইউরোসেন্ট্রিজম অ্যান্ড কালচারালিজম: মর্ডানিটি, রিলিজিয়ন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি ইন দ্য এইজ অব গেøাবালাইজেশন বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক সংকটগুলো বুঝতে অগ্রসর পাঠকদের জন্য সহায়ক হতে পারে।
পশ্চিমা বশংবদ সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের ফাঁকা বুলি ও বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ’র সার্টিফিকেট ও উন্নয়ন অংশিদারিত্বের দেউলিয়াপনার মুখোশ বিশ্বখ্যাত দার্শনিক- অর্থনীতিবিদ সামির আমিন অনেক আগেই খুলে দিয়েছিলেন। বুকার পুরস্কার, নোবেল পুরস্কার বা স্যার উপাধির মত সম্মান তা ভাগ্যে জোটেনি। ফরাসী ও ইংরেজী ভাষায় অর্ধশতাধিক গুরুত্বপূর্ণ গবেষনামূলক বই প্রকাশিত হলেও এসব রচনা পশ্চিমা পুঁজিবাদী এস্টাবলিশমেন্টের মুখোশ খুলে দেয়ার কাজটি করেছিলেন বলেই স্বদেশে বা বিদেশে তিনি তার যোগ্য স্বীকৃতি পাননি। তৃতীয় বিশ্বের লেখক-চিন্তাবিদদের আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননার জন্য তাদের কাছ থেকে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলো যে ধরনের মানসিকতা ও স্বীকৃতি প্রত্যাশা করে সামির আমিন সে ধরনের কেউ ছিলেননা। তাঁর বড় ব্যত্যয় হচ্ছে তিনি মার্ক্সবাদী সমাজতাত্তি¡ক ছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই তিনি পশ্চিমা পুঁজিবাদী লুণ্ঠন ও হেজিমনির বিরুদ্ধে নিজের চিন্তা, যুক্তিনিষ্ঠ কলম দিয়ে লড়ে গেছেন। সেই স্তালিনের যুগ থেকেই সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সমালোচকদেরকে নোবেল পুরস্কারের জন্য বেছে নিয়েছে পশ্চিমারা। পঞ্চাশের দশকে(১৯৫৮) বরিস পাস্তেরনাক এবং নব্বইয়ের দশকে চীনা ভিন্নমতাবলম্বি সাহিত্যিকদের নোবেল পুরস্কারে ভ‚ষিত করার মোজেজা এখানেই। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিক্লাসিফাইড ডুকমেন্টে ড. জিভাগো উপন্যাসের জন্য বরিস পাস্তেরনাককে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য বৃটিশ ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার নেপথ্য ভ‚মিকার কথা জানা যায়। ভিএস নাইপলের গদ্যে চমৎকারিত্ব আছে, অভিবাসি সমাজের মনস্তত্ব ব্যাখ্যা করতে তিনি যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার বাইরের কোন ব্যক্তির নোবেল পুরস্কারের জন্য এটুকুই যথেষ্ট নয়। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের সম্ভাব্য তালিকায় ৮৮ বছর বয়েসী সিরীয় কবি আলী আহমেদ সাইদ এডোনিসের নাম গত ২৫ বছর ধরে ছাপা হচ্ছে। ইতিমধ্যে যে সব আরব নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তাদের মধ্যে মিসরের আনোয়ার সাদাত, নাগিব মাহফুজ, ইরানের শিরিন এবাদি, ইয়েমেনের নারীবাদী সংবাদিক তাওয়াক্কুল কারমানসহ প্রায় সকলেই কোন না কোনভাবে পশ্চিমা স্বার্থের সাথে আপস করেছেন। আনোয়ার সাদাতকে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির জন্য ১৯৭৮ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হলেও এই চুক্তি ফিলিস্তিনী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিল। চুক্তিতে জাতিসংঘ বা পিএলও’র কোন অংশগ্রহণ এবং ফিলিস্তিনীদের আবাসভ’মি ফিরে পাওয়ার কোন স্বীকৃতি ছিলনা। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির প্রথম দফাতেই গাজা ও পশ্চিম তীরের নাগরিকদের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেয়া হলেও ইসরাইলীরা কোন চুক্তি বা কনভেনশনই মানেনা। তারা সেখানে দুর্ভেদ্য অবরোধ ও সামরিক আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বকে নতুন করে যে সব সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন সামির আমীন অনেক আগেই তার ভবিষ্যদ্বানী করে ইউরোপসহ বাকি দুনিয়াকে প্রস্তুতি নিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বের অনেক রাজনৈতিক নেতা রোল মডেল হিসেবে স্বীকার করলেও জীবদ্দশায় পশ্চিমারা তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য মনে করেনি। ভিএস নাইপল এবং সামির আমিনের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। রাজনৈতিক-অর্থনীতি ও সামাজিক সংকট মোকাবেলায় সাহিত্য ও চিন্তাধারায় বিশেষ অবদানের জন্য বিংশ শতকের এই দুই সৃষ্টিশীল মানুষের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। bari [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।