পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
এখন সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলছে। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন, নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র। রাজনীতিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ এতটাই কঠোর যে, স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারা বলতে যা বোঝায়, তা নেই বললেই চলে। এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। দেশের চালচিত্র তুলে ধরে গত সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের আয়োজনে এক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ক্ষোভের সঙ্গে মন্তব্য করেন, ‘দেশে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজমান। বঙ্গবন্ধুর দেশে চলছে পুলিশ প্রহরায় আওয়ামী লীগের গুণ্ডাতন্ত্র। কোথাও গণতন্ত্র, আইনের শাসন নেই। আমি এই গুণ্ডাতন্ত্রের মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই না। আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়া হোক। আমাদের গুলি করে মারা হোক।’ দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে কতটা অসহনীয় ও আশঙ্কাজনক তা তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। অনেক বিশ্লেষক এ পরিস্থিতিকে, একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরশাসনের সাথে তুলনা করছেন। অবশ্য ক্ষমতাসীন দল তা মানতে নারাজ। সে মনে করছে, দেশে পরিপূর্ণ গণতন্ত্র বজায় রয়েছে। এটা বুঝতে চায় না কিংবা চাচ্ছে না, গণতন্ত্রে বাকস্বাধীনতা, বিরোধী দলের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড অতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পড়ে ত্রাহি অবস্থার মধ্যে রয়েছে। দেশি-বিদেশি সংস্থা ও পর্যবেক্ষকরা এ পরিস্থিতিকে অগণতান্ত্রিক বললেও সরকার তাতে কান দিতে চায় না। সে মনে করছে, এভাবেই দেশ চলবে। কে কি বলল, তাতে কিছু যায় আসে না। অনুমাণ করতে কষ্ট হয় না, জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, সরকার ততই কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে এবং রাজনীতির স্বাভাবিক ধারা ফিরিয়ে একটি সহনশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য দেশের রাজনৈতিক দলসহ নাগরিক সমাজ বহুদিন থেকেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার তাকিদ দিয়ে আসছেন। সমস্যা হচ্ছে, সংলাপের কথা আসলেই ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে একবাক্যে না করে দেয়া হয়। সংলাপের কোনো প্রয়োজন নেই বলে উড়িয়ে দেয়। তবে মাঝে মাঝে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ অন্যান্য নেতাদের মুখ থেকে সংলাপ হতে পারে বলে শোনা যায়। গত মাসে হঠাৎ করেই যেন সংলাপের বিষয়টি রাজনীতিতে আলোচিত হয়ে উঠে। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির সাথে আনুষ্ঠানিক সংলাপের প্রয়োজন নেই, তবে দলটির সঙ্গে দূরত্ব ঘোচাতে চান। তিনি বলেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে ফোনে কথা বললে দূরত্ব অনেকটা কমে আসতে পারে। রাজনীতিতে ওয়ার্কিং আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের জন্য বিএনপির নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা হতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ওবায়দুল কাদেরের এ বক্তব্যকে রাজনীতিতে যে ডেডলক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা খোলার একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচনা করছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেছেন, তারা ফোন করলে আমরা ফোন করবো। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসার জন্য একটু একটু করে যে সংলাপের বিষয়টি উঠছে, তাতে সচেতন মহল কিছুটা হলেও আশাবাদী হয়ে উঠছে। আক্ষরিক অর্থে দেশের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তা কোনোভাবেই স্বস্তিদায়ক নয়। বরং প্রচ্ছন্নভাবে একটা ভয়াবহ সংঘাতময় পরিস্থিতির আশঙ্কা রয়েছে। নির্বাচনের আগে তা বিস্ফোরিত হবে নাকি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করবে, তা বলা মুশকিল। এ কারণেই ক্ষমতাসীন দল বাদে সচেতন মহল প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির তাকিদ দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, আগামী জাতীয় নির্বাচন কীভাবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করা যায়, তাই নিয়েই এ সংলাপের আহ্বান জানানো হচ্ছে।
দুই.
আগামী দিনগুলোতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি কি হবে, কোন দিকে যাবে, তা ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। তবে পরিস্থিতির সহসা উন্নতি ও শান্তিময় হয়ে উঠবে সচেতন মহলকে এমন আশা করতে দেখা যাচ্ছে না। তারা উপলব্ধি করছেন, ক্ষমতাসীন দল যে কোনো উপায়ে পুনরায় ক্ষমতায় থাকতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এজন্য প্রশাসনিক সব ধরনের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে রাখা হয়েছে। যেভাবে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনগুলো প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আপাত দৃষ্টিতে শান্তিপূর্ণ দেখানো হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনটিও যে তারা এভাবে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে করতে চায়, তারই এক ধরনের রিহার্সেল করা হয়েছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ কি! তবে প্রধান বিরোধী দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল সরকারের এ উদ্দেশ্য কতটা বাস্তবায়ন করতে দেবে, তাই এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে? যদি তারা বুঝে থাকে, তবে তা করতে দেয়া উচিত হবে না। যখনই করতে দেবে না, তখনই রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। এ পরিস্থিতি উত্তরণের জন্যই সংলাপের বিষয়টি এখন জোরেসোরে উচ্চারিত হচ্ছে। সংলাপের ব্যাপারে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর আহ্বানের অনেক আগে থেকেই দেশের নাগরিক সমাজ এবং সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। একবাক্যে সবাই বলেছেন, চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট এবং সংঘাতময় পরিস্থিতির নিরসন হতে পারে একমাত্র সংলাপের মাধ্যমে। ক্ষমতাসীন দল তাদের এ আহ্বান উড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে অনেকে আক্ষেপের সাথে বলছেন, পারস্পরিক কথা-বার্তা, আলাপ-আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে যদি সঙ্কট নিরসন হয়, তবে সরকার উদ্যোগ নিলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে? সংলাপ মানে তো আর সরকার পতন হয়ে যাওয়া নয়। তাহলে সমস্যা কোথায়? তাদের এ আক্ষেপ যে দেয়ালে মাথা ঠোকার বিষয়ে পরিণত হয়েছে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। সরকার সংলাপের পরিবর্তে প্রশাসনিক শক্তির ওপরই পুরোপুরি নির্ভর করছে এবং মনে করছে, প্রশাসন যতক্ষণ হাতে আছে, ততক্ষণ কোনো শক্তি তাদের ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে না। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দল আন্দোলন করতে চাইলে অতীতের মতোই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা তা নিয়ন্ত্রণ ও দমন করা হবে। সরকারের এ ধরনের আচরণ যে আগামী দিনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতপূর্ণ করে তুলবে, তাতে সন্দেহ নেই। সরকার অতীতের মতোই রাজনৈতিক আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আখ্যা দিয়ে দমননীতি অবলম্বন করতে পারে। বলা বাহুল্য, আমাদের দেশে রাজনৈতিক আন্দোলনকে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বরাবরই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড আখ্যা দিয়ে দমনের চেষ্টা করা হয়েছে। তাতে কোন কাজ হয়নি। ক্ষমতাসীন দলকে রাজনৈতিকভাবেই তার সমাধান করতে হয়েছে। তবে এ সময়ে বিরোধী দলের রাজনৈতিক শক্তি কতটা, তার ওপরই নির্ভর করছে ক্ষমতাসীন দলের অবস্থানের পরিবর্তন। ক্ষমতাসীন দল নিশ্চিতভাবেই জানে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে এমনভাবে কোনঠাসা করা হয়েছে যে, তার পক্ষে সরকারবিরোধী জোরালো কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ফলে সে নির্ভার রয়েছে এবং মাঝে মাঝে লোক দেখানো সংলাপের কথা বলে।
তিন.
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আশঙ্কামূলক রাজনৈতিক সংঘাতময় পরিস্থিতিতে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা কি হতে পারে, তা নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। বিগত কয়েক বছর ধরে জাতিসংঘ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এবং বিভিন্ন প্রভাবশালী দাতা ও মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া হয়েছে। বর্হিবিশ্ব থেকে এসব বক্তব্য-বিবৃতি আসা অসম্মান ও অকাম্য হলেও, তাই ঘটে চলেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন সবদলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে। এমনকি ভারতের কাছ থেকেও নাকি সরকারকে বার্তা দেয়া হয়েছে, সব দলের অংশগ্রহণ এবং জনগণের ভোটে নির্বাচন করতে হবে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল কঠোর অবস্থানে রয়েছে। দুঃখের বিষয়, যেখানে ক্ষমতাসীন দল নিজ উদ্যোগে বিরোধী দলের সাথে আলাপ-আলোচনা করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারে, সেখানে বাইরের শক্তিকে তা করার জন্য চাপ দিতে হচ্ছে। সমস্যা নিরসনে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে তাদের চাপ সইতে হচ্ছে। এটা মোটেই স্বাধীন দেশের জন্য মর্যাদার নয়। অবশ্য গেøাভাল ভিলেজের যুগে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও সাহায্য নির্ভর উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এবং যাদের স্বার্থ আমাদের দেশে রয়েছে, তাদের মতামতের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া যায় না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক হিংসা-প্রতিহিংসা, অনৈক্যই বিদেশিদের নাক গলানোর সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র আত্মশ্লাগা আছে, তা মনে হয় না। বরং কোন প্রভাবশালী দেশ রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে রয়েছে, এটা নিয়ে বড়াই করতে দেখা যায়। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বলা হয়, ওমুক দেশ তাদের সমর্থন দিয়েছে। কাজেই আমাদের আর চিন্তার কিছু নাই। এ কথা তাদের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেয়। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট দেশের বক্তব্য বা বিবৃতি বিপক্ষে গেলেই চুপসে যায়। কিছুদিন ধরে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে ধর্না দেয়ার প্রয়োজন নেই। এ নিয়ে বিএনপিকে তিরস্কার করে এ জাতীয় কথা বলতে শোনা গেছে। সে এ কথা বলে না, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচনের আগে ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার যেভাবে হস্তক্ষেপ করেছে, তাতে পুনরায় তাদের ক্ষমতায় বসতে ব্যাপক সহায়তা করেছে। বিষয়টি এমন হয়ে যাচ্ছে, নিজে করলে সিদ্ধ, অন্যে করলে অসিদ্ধ। যেভাবেই বলা হোক না কেন, আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্নদের কাছে এ ধরনের প্রবণতা কাম্য হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোর বিদেশি রাষ্ট্রের তোষণনীতির দ্বারা সাধারণ মানুষের প্রভাবিত হওয়া স্বাভাবিক। কারণ তাদের অধিকাংশ সক্রিয়ভাবে কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য না হলেও তারা রাজনীতির বাইরে নয়। রাজনীতির উত্তাপ তাদেরও ছুঁয়ে যায়। রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত ও কর্মকান্ড তাদের ভাবায়। রাজনৈতিক সঙ্কটকালে কোন দেশের পক্ষ থেকে কি বক্তব্য আসে এবং তা কার পক্ষে গেল, এদিকেও তাদের তীক্ষè নজর থাকে। যার যার অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করে এবং তর্কে লিপ্ত হয়। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ বরবারই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘ প্রধান দু’দলকে মতপার্থক্য দূর করতে বলেছে। বিরোধী দলকে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশ করার অনুমতি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ প্রকাশ ও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সুযোগ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। ভারত বলেছে, বাংলাদেশ নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে সক্ষম এবং তারা প্রকাশ্যে কোন দলকে সমর্থন দেবে না। এসব বক্তব্য-বিবৃতি নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে জোর আলোচনা চলছে। অনেকে বলছেন, ভারত যদি গত জাতীয় নির্বাচনের মতো সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে নিরপেক্ষ অবস্থানও নেয়, তাতে ক্ষমতাসীন দলের চেয়ে বিএনপি জোটের সুবিধা বেশি। তারা এ কথাও বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র গত বছর ভারতের জন্য সুবিধা করতে পারেনি। এটা তারা সহজে ভুলবে না। এবার তারা সেকেন্ড টাইম ব্যর্থ হতে চাইবে না। আর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বাইরে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ তার মিত্ররাষ্ট্রগুলোও যাবে না। ফলে এখন পর্যন্ত বিদেশি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান তা সরকারের জন্য অনুকূল নয়। আর সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কট নিরসনের যে আহ্বান জানানো হচ্ছে এবং সরকার তা উড়িয়ে দেয়ায় নিশ্চয়ই বিদেশি রাষ্ট্রগুলো ভালোভাবে নেবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। এই মতবিরোধ চিরস্থায়ীভাবে চলতে থাকবে, তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোর যদি লক্ষ্যই হয়ে থাকে ক্ষমতায় গিয়ে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি এগিয়ে নেবে, তাহলে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের বিকল্প নেই। যতই মতবিরোধ থাকুক না কেন, দেশ ও জনগণের সামষ্টিক স্বার্থে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতা সবসময়ই থাকা উচিত। আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলগুলো একে অপরকে শত্রæ মনে করে। এই শত্রæভাবাপন্ন মানসিকতার কারণে দেশে বরাবরই একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করে। জনসাধারণও এক ধরনের শঙ্কাজনক পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করে। বলা বাহুল্য, রাজনৈতিক সংঘাত ও অনিশ্চয়তা নিয়ে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারে না। উন্নতির প্রথম শর্তই হচ্ছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, যেখানে জনসাধারণের মধ্যে কোনো শঙ্কা থাকবে না। এজন্য ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শুধু নির্বাচন কেন্দ্রিক সংলাপ ও সমঝোতা নয়, সবসময়ই তা বলবৎ থাকা উচিত। দেশের উন্নয়নে পারস্পরিক সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশে আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন। বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের সমালোচনা ও বিরোধিতা করা স্বাভাবিক। ক্ষমতাসীন দল যদি তাদের মতের সাথে একমত পোষণ নাও করে, তারপরও তাদের মতকে গুরুত্ব দিয়ে চলা প্রয়োজন। বিরোধীদলগুলোর সাথে আলাপ বা সংলাপের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া। তাকেই সবার আগে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আমরা আশা করব, ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাথে অনানুষ্ঠানিকভাবে টেলিফোনে কথা বলার যে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তা এক সময় আলোর মুখ দেখবে এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হবে।
চার.
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একটি কথা বেশ জোরেসোরে বলছেন, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তার প্রবল প্রতিপক্ষ আন্দোলনরত বিএনপিকে কোনো ধরনের সুযোগ দিতে চাচ্ছে না। বহু আগে থেকেই বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠনের অপবাদ দিয়ে তার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে চলেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ এ কাজ করতে গিয়ে প্রকারন্তরে নিজের সর্বনাশই করছে। বিএনপি’র মতো একটি বৃহৎ এবং ব্যাপক সমর্থকভিত্তিক দলের বিরুদ্ধে এই অপবাদ এবং নির্মূল করার প্রক্রিয়া দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিশ্বাস করে না। বিপুল সংখ্যক এই মানুষের বিশ্বাসই আওয়ামী লীগ ও তার জোটের দাবী ভিত্তিহীন করে দিচ্ছে। তারা মনে করে, যে দলটি শ্বৈরসাশক এরশাদের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, নির্বাচিত হয়ে একাধিকবার দেশ পরিচালনা করেছে এবং দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছে, সে দল সন্ত্রাসী সংগঠন, তা বিশ্বাস করার কোন কারণ থাকতে পারে না। সাধারণ মানুষ এ প্রশ্নও তুলেছে, বিএনপি যদি সন্ত্রাসী দলই হতো, তবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে এই আওয়ামী লীগ কী করে বিএনপি’র সাথে যুগপৎ আন্দোলন এবং তিন জোটের রূপরেখায় অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের মধ্যে এ প্রশ্নও গুঞ্জরিত হচ্ছে, প্রতিপক্ষের প্রতি এই অপবাদ একটা সময় আওয়ামী লীগের দিকে ফিরে আসবে না, তার নিশ্চয়তা কি? এখন সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় তার অঙ্গ সংগঠনের মাধ্যমে যেভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হামলা চালাচ্ছে, তাতে কি তার এই বল প্রয়োগ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে? পাচ্ছে না। বরং সাধারণ মানুষ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে শত কষ্টের মধ্যেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন দিয়েছে। তারা এটা মনে করছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় যেভাবে হামলা চালিয়েছে, তা সন্ত্রাসী কার্যক্রমেরই শামিল। অনেকে মন্তব্য করেছেন, ক্ষমতায় কেউ চিরদিন থাকে না। যারা প্রতিপক্ষ দমন ও ন্যায্য দাবীর আন্দোলন দমিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়, তার বিদায় ঘন্টা দ্রæত বাজার নজির বিশ্বের অনেক দেশেই রয়েছে। চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে গুজব, গুঞ্জণ ছড়িয়ে পড়েছে, সাধারণ মানুষ তার দ্রæত অবসান চায়। এ পরিস্থিতি উত্তরণে তারা সংলাপের উপর জোর তাকিদ দিয়েছেন। যত দ্রæত সম্ভব ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ শুরু করা দরকার। দেশের সামগ্রিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে কোন অজুহাতে বা গোয়ার্তুমি করে তা উড়িয়ে দেয়া কাম্য হতে পারে না। সরকার সংলাপ করবে না বলে যে যুক্তিই দেখাক না কেন, সংলাপ না হলে যে দেশ বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভ করবে না, তা ইতোমধ্যে জনসাধারণ মনে করতে শুরু করেছে। কাজেই ক্ষমতাসীন দলের উচিত হবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের আয়োজন করা।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।