পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্টের নারকীয় বর্বরতার কথা মানুষ আজও ভুলতে পারেনি। এর পর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর, কিন্তু চলছে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার। আক্ষরিক অর্থেই এই মৃহৃর্তেও মৃত্যুবরণ করছে, পঙ্গু হচ্ছে, স্বাভাবিক জীবন ধারণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে শত শত মানুষ। নতুন যুদ্ধ শুরু হওয়ার উপাদান ছড়িয়ে আছে চীন সাগর থেকে বঙ্গোপসাগর বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোতে। এতে জড়িয়ে পড়তে পারে মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো, যারা কেউ পরমাণু শক্তিধর, কেউ বা অঘোষিত পরমাণু শক্তির অধিকারী। তামাম বিশ্বের সাধারণ মানুষ যারা একান্ত অজান্তেই কামানের খোরাক হন তারা ছাড়াও জীবিকার দায়ে যাদের যুদ্ধকে পেশা হিসাবে নিতে হয়, তারা কেউ যুদ্ধ চান না। বিজ্ঞানী যারা নতুন নতুন সমরাস্ত্র উদ্ভাবনের সঙ্গে নিযুক্ত রয়েছেন, তাদের সংখ্যাধিক অংশ যুদ্ধকে ঘৃণা করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে ৬ আগস্ট জপানের হিরোশিমা শহরে সংঘটিত হয়েছিল মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্যতম অপরাদ। এর তিনদিনের মাথায় জাপানেরই নাগাসাকি শহরে স্পর্ধিত যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র আমেরিকা আর তার সহযোগীরা আবারও পারমাণবিক বোমার হামলা চালিয়েছিল। মূর্তিমান মৃত্যুদূতের মতো ‘লিটলবয়’ ও ‘ফ্যাটম্যান’ নামে দুটো ইউরেনিয়াম ও প্লটোনিয়াম বোমা নিক্ষিপ্ত হয়ে চারপাশের তাপমাত্রা চার হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে তুলে দিয়েছিল। আগুনে পুড়ে, তাপে ঝলসে, তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ ও আঘাতজনিত কারণে হিরোশিমাতে ষাট হাজার ও নাগাসাকিতে চল্লিশ হাজার মানুষ সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাসের মধ্যে নিহত হন প্রায় দুই লক্ষ মানুষ। পরমাণু বোমার তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ বেঁচে থাকা মানুষের দেহে এমন অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি করে যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আজও বয়ে চলছে। এই বীভৎসতা দেখে সারা বিশ্বের সংবেদশীল মানুষ বিশেষত বিজ্ঞানী, চিন্তানায়ক, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরাও উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। এঁরা ভাবিত হয়েছিলেন, মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে, প্রশ্ন তুলেছিলেন, যে বিজ্ঞানের আবিষ্কার মানবজাতিকে চিরকালের জন্য শক্তির জোগান দিতে পারে সেই আবিষ্কারই কেন মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ব্যবহৃত হয়?
যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যবনিকা পতন হয়েছিল হিরোশিমা ও নাগাসাকির বীভৎসতার মধ্যে দিয়ে, তার কারণ কী ছিল? মানব সমাজের ইতিহাসে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দেখায়, যে দিন থেকে মানব সমাজ শ্রেণি বিভক্ত হয়েছে এবং জমি তথা সম্পদের ইপর কবজা টিকিয়ে রাখার জন্য মালিকশ্রেণি রাষ্ট্র তৈরি করেছে, সেদিন থেকে যুদ্ধের বিরাম নেই। শুধু রাজায় রাজায় হানাদারি যুদ্ধ নয়, প্রজাকে শাসনে রাখার জন্য তাদের উপরও যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আধুনিক পুঁজিবাদী যুগে এই যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধ রূপে উর্ত্তীণ হয়েছিল, কারণ পুঁজিবাদ ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী বৃহৎ একচেটিয়া কোম্পানিগুলোর জন্ম দিয়েছে, যারা বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে কবজা করে নিয়েছে। বৃহৎ পুঁজিগোষ্টীগুলো অধিকৃত রাষ্ট্রগুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজ নিজ কাঁচামাল, শ্রমশক্তি, ব্যবসার ক্ষেত্রের উপর দখলও বৃদ্ধির নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যায়। একের অধিকৃত জমি অন্যের দখলের অপচেষ্টার অনিবার্যতা হিসাবে চলে আসে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ, নারকীয় বীভৎসতা।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলো হিটলার, মুসোলিনি বা তোজোর মতো রাষ্ট্রনেতাদের মঞ্চে হাজির করেছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দখলে থাকা বিশ্বের আশি শতাংশ উপনিবেশগুলোকে নিজেদের কর্তৃত্বে নিয়ে আসতে। অন্যদিকে, আমেরিকা নিজেকে গণতন্ত্রের অন্ত্রাগার ঘোষণা করে দু‘পক্ষের যুদ্ধ প্রস্তুতির ফায়দা নিয়ে অস্ত্র, যুদ্ধসরঞ্জাম ইত্যাদির বাজার কবজা করে। শুরু হয়ে যায় উপনিবেশ লুণ্ঠনের, বাজার দখলের, কাঁচামালের উৎস দখলের বিশ্বযুদ্ধ। পরবর্তী সময়ে আমেরিকা যুদ্ধে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের পক্ষভুক্ত হয়ে যোগদান করে নতুন ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা স্থাপন করার অর্থাৎ নিজেকে উপনিবেশগুলোর কর্তৃত্বকারী অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করার শর্তে। এটা স্পষ্ট যে একচেটিয়া কোম্পানিগুলো তাদের বিশ্বব্যাপী কারবারের মুনাফা বজায় রাখা ও বাড়িয়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে যুদ্ধে নামিয়ে সাধারণ জনগণের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল ও বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের সকল উৎকর্ষকে মানবজাতির স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। ঐ সময় একমাত্র ব্যতিক্রমী ভূমিকায় ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। নিজেকে ও বিশ্বকে এই যুদ্ধ থেকে বাঁচাবার প্রয়াস সত্তে¡ও সা¤্রাজ্যবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর আত্মরক্ষার্থে শ্রমিক শ্রেণির যুদ্ধ আহ্বান করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পট পরিবর্তনে এই ঘটনা ব্যাপক ও গভীর তাৎপর্যবাহী।
মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সখেদে বলেছিলেন, ‘পরমাণু বোমা মানুষের চিন্তা পদ্ধতিকে ছাড়া আর সবকিছুই পাল্টে দিয়েছে। এর সমাধান রয়েছে মানবজাতির হৃদয়ের মধ্যে। এটা যদি আগে জানতাম তাহলে আমি ঘড়ি নির্মাতা হতাম। কার হৃদয় পরিবর্তনের কথা এই মহান বিজ্ঞানী বলেছিলেন, তা জানা নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটেই এই মন্তব্য করেছিলেন। তিনি কি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সেই সাধারণ মানুষের কথা বলতে চেয়েছিলেন, যাদের ৮৭ শতাংশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষ শক্তি ও মিত্র শক্তির হাজারো প্ররোচণা সত্তে¡ও জাপানকে ধ্বংস করে দেবার বিপক্ষে মতামত দেন? তিনি হয়তো ট্রুম্যান, চার্চিল, হিটলার-মুসোলিনি, তোজো তথা তাঁদের নীতি রূপায়ণকারীদের কথাই বলতে চেয়েছিলেন, যুদ্ধ এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধের বোতামটা যাদের হাতে থাকে। ঘটনা এটাই বিশ্ববাসীর জনমত উপেক্ষা করে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয় জনগণের উপর। কখনও সভ্যতার সংঘাতে নামে, কখনও ধর্মযুদ্ধের নামে, কখনও শাসন পরিবর্তনের নামে অসহায় মানুষকে হত্যা করা হয় যুদ্ধে। আজ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে যে যুদ্ধ চলছে, তার কোনোটাতে যেমন রাষ্ট্রগুলো সরাসরি জড়িত আবার কোনোটাতে ধর্মের নামে সংঘটিত সশস্ত্র গ্রæপগুলি প্রকাশ্যে নেতৃত্বে আছে। কিন্তু যারা আগ্রাসী যুদ্ধনীতি প্রণয়ন করে, কূটনৈতিক মারপ্যাঁচের মাধ্যমে যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যায়, ঠেলে দেয় দেশ ও জাতিকে তাদের বধিরত্ব ঘোচান যায় কীভাবে সেটাই আসল প্রশ্ন।
প্রশ্ন আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম পর্যায়ে যখন জার্মানি আত্মসমর্পণ করেছে, জাপানের আত্মসমর্পণ শুধু সময়ের অপেক্ষা, তখন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও কানাডার যৌথ উদ্যোগে, প্রস্তুত পরমাণু বোমার প্রয়োগের কী দরকার ছিল? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের নির্দেশে গঠিত টার্গেট সিলেকশন গ্রæপের বক্তব্য থেকে এর উত্তর পাওয়া যায়। এ-থেকে জানা যায়, জাপানের উপর মনস্তাত্তি¡ক বিজয়ের জন্য এবং পরমাণু বোমার ‘দৃষ্টিনন্দন’ ধ্বংস ক্ষমতা সম্পর্কে বিশ্বের জনগণকে জানান দেয়ার জন্য এটা করা হয়। স্পষ্টত যুদ্ধ পরবর্তী ফয়সালা অনুযায়ী সা¤্রাজ্যবাদীদের নতুন উপনিবেশিক ব্যবস্থার নতুন মোড়ল হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমেরিকা এই কান্ড ঘটিয়েছিল।
পৃথিবী আজও পরমাণু যুদ্ধের বিপদ থেকে মুক্ত নয়, বরং বহু রাষ্ট্রই গোপনে বা প্রকাশ্যে পরমাণু বোমা বানানো হচ্ছে ও সফল পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে অন্য রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। আর বিশ্ব যুদ্ধ সংগঠিত না-হলেও যুদ্ধ অনবরত জারী আছে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়। যুদ্ধে বিজয়ের জন্য যেহেতু সকল পন্থাই ‘বৈধ’ ফলে চলমান ‘চিরাচরিত’ হাতিয়ারের যুদ্ধে কখন ‘অচিরাচরিত’ হাতিয়ারের যুদ্ধের পরিণতি লাভ করেছে বা করবে তা কেউ বলতে পারে না। এজন্য মাঝেমধ্যেই রাসায়নিক বা জীবাণু অস্ত্রের ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে। যাই হোক, বিগত সময়ে পরমাণু যুদ্ধ, রাসায়নিক যুদ্ধ সর্বোপরি বিশ্বযুদ্ধ একচেটিয়া পুঁজিপতিদের জন্যও বিপদ ডেকে এনেছে। এর একটা কারণ, এই যুদ্ধগুলো ব্যাপক জনগণকে নিজের নিজের দেশের রাষ্ট্রশক্তির যুদ্ধপ্রয়াসের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ ও সংগঠিত করেছে। কিন্তু ঘটনা থেকে দেখা যায় জণগণের যুদ্ধবিরোধী প্রবণতা রাষ্ট্রগুলোকে তথা তাদের নিয়ন্ত্রক একচেটিয়া পুঁজিগোষ্ঠীগুলোকে যুদ্ধ থেকে বিরত করতে পারেনি। আজকের দুনিয়ার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা তার অভ্যন্তরীণ নিয়মের এখন বিরোধের জন্ম দিচ্ছে যা রাষ্ট্রগুলোকে অনিবার্যভাবেই যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।