পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নিরাপদ সড়কের দাবীতে ঢাকা থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সারাবিশ্বে সাড়া জাগিয়েছে। রাজপথে টানা ৮দিনব্যাপী স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলন নজিরবিহীন। বাস চালকদের রেষারেষি ও প্রতিযোগিতার জেরে ফুটপাতে দাড়িয়ে থাকা রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন শুরু হলেও শেষতক এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাড়ায় দেশের সড়ক নিরাপত্তা এবং সড়ক পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা ও বেআইনী তৎপরতার বিরুদ্ধে। যে কোন বিচারে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু। শিশুরা শুধু একটি সফল আন্দোলনই গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি, আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো তারা জাতির সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। এতদিন যে সব প্রভাবশালী- ভিআইপিরা রাজপথে আইনের তোয়াক্কা না করে গাড়ী চালিয়েছেন তাদেরকেও হাতে নাতে শিক্ষা দিতে সক্ষম হয়েছে তারা।দলমত নির্বিশেষে নাগরিক সমাজ তো বটেই সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও শিশুদের এই আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন প্রকাশ করেছেন। সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী নিজেও শিশু শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবী মেনে নিয়েছেন এবং তা দ্রুত বাস্তবায়নের তথ্যও জানিয়েছেন। এতকিছুর পরও শিশু শিক্ষার্থীরা পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের নির্মম হামলা থেকে রেহাই পায়নি।
নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের শুরুতেই শিশুরা পুলিশি হামলার শিকার হয়েও দমে যায়নি। এরপর সরকারী বাহিনীগুলোকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি সহনশীল ও নমনীয় ভ‚মিকা পালন করতে দেখা গেছে। তবে আন্দোলনের ৬ষ্ঠ ও ৭ম দিনে ঝিগাতলা, মিরপুর, রামপুরাসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ ও পুলিশি হামলার শিকার হওয়ার অভিযোগ ছিল দেশের নাগরিক সমাজের কাছে খুবই অপ্রত্যাশিত। সরকারী দলের সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে এর জন্য ফেইসবুকে ছড়ানো গুজবকে দায়ী করা হলেও শিক্ষার্থীদের উপর নির্মম আক্রমন ও লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাগুলোর দায় সংশ্লিষ্টরা এড়াতে পারেননা। দাবী মেনে নিতে সময় সীমাও বেঁধে দিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। যেহেতু সরকারের পক্ষ থেকেও ৯ দফা দাবীর যৌক্তিকতা স্বীকার করা হয়েছিল এবং মেনে নিয়ে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তাহলে তারা শহরের বিভিন্ন স্থানে আক্রমনের শিকার হল কেন? নিরাপত্তার অজুহাতে মালিক-শ্রমিকদের পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সারাদেশে যাত্রীদের যে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল শিক্ষার্থী ধর্মঘটে সে ধরনের কোন ভোগান্তি হয়নি। তারা লাইসেন্স ও ফিটনেস পরীক্ষার পাশাপাশি পথের নিয়ম-শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় কাজ করেছিল। দাবী মেনে নেয়া এবং পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের সাথে সাথে এমনিতেই শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে যাওয়াই ছিল যুক্তযুক্ত। সেখানে তাদের উপর হামলা আন্দোলনকে শুধু দীর্ঘায়িত করতেই ভ‚মিকা রাখেনি, এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ও সংহতির ধারাবাহিকতায়, নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। ধানমন্ডিতে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা ও লাঞ্ছনার প্রতিবাদে জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঢাকামুখী লংমার্চ পুলিশ ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের হামলায় ভন্ডুল হয়ে গেলেও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের নতুন শক্তি হিসেবে আর্বিভ‚ত হয়েছেন। গত সোমবার বেশ কয়েকটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশি হামলার জেরে এখন দেশের সব বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। অর্থাৎ কিশোর শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে গেলেও তাদের সূচিত আন্দোলন এখনো বন্ধ হয়নি। এহেন বাস্তবতায় আন্দোলনের সাথে জড়িত শিক্ষার্থীরা এখন নানা ধরনের হয়রানিমূলক মামলার শিকার হচ্ছে।
গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ছাত্র বিক্ষোভের জেরে সোমবার ঢাকার তিনটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহবাগ এলাকা রণক্ষেত্রে পরিনত হয়। লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেটে আক্রান্ত হয়েছে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন দমাতে সাঁজোয়া যানও নামানো হয়েছে। সেই সাথে কিশোর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় সংঘটিত অপ্রীতিকর ঘটনায় ইতিমধ্যে ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং সোমবার পর্যন্ত ২২জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করা হচ্ছেনা বলে জানানো হলেও অজ্ঞাতনামা আসামীদের নামে মামলা এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের মারমুখী ভ‚মিকার কারনে দেশের সব শিক্ষাঙ্গণে এক ধরনের আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরী হতে দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের বাস্তবতা শুধু শিক্ষাঙ্গণেই সীমাবদ্ধ থাকবেনা, তা বৃহত্তর নাগরিক সমাজেও বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করবে। শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডেও বিরূপ প্রভাব দেখা দিতে পারে। নিরাপদ সড়কের আন্দোলন ইতিমধ্যে গণদাবীতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ক্ষীন দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। আন্দোলনরত শিশুদের উপর হামলার ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, অভিভাবকমহল ও নাগরিক সমাজের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। শিশুদের আটকে রেখে নির্যাতন করা, কর্তব্যরত সাংবাদিকদের উপর হামলাকারিদের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এদের ধরে বিচারের আওতায় আনার মধ্য দিয়ে ছাত্র, অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের ক্ষোভ প্রশমন সম্ভব হতে পারে। তা না হলে গণরোষ সাময়িকভাবে অবদমিত রাখা সম্ভব হলেও যে কোন ইস্যুকে কেন্দ্র করে তা বার বার প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা রোধ করা যাবে না। জমে থাকা গণরোষের বহি:প্রকাশ একরকম অবশ্যম্ভাবী। মামলা, হামলা, গ্রেফতার ও ভয় দেখিয়ে আন্দোলন দমন বা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সড়ক নিরাপত্তাসহ সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা ও অনিশ্চয়তা নিরসনে সরকারকে তার সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।