পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মত প্রকাশের অধিকার যদি না থাকে কিংবা সংকুচিত করে দেয়া হয়, অথবা সংবাদপত্রসহ মেইন স্ট্রিম মিডিয়া যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে তবে সোস্যাল মিডিয়া বা বিদেশী মিডিয়ার ওপর নির্ভরতা বেড়ে যায়। এটা আমাদের দেশেও আমরা বিভিন্ন সময় প্রত্যক্ষ করেছি। ১৯৭৫ সালে যখন চারটি সরকারনিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র রেখে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন তথ্যের জন্য, খবরের জন্য এ দেশের মানুষকে বিদেশী মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়। অনুরূপভাবে এরশাদ সরকারের আমলে সংবাদপত্রের ওপর ঘোষিত-অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হলে দেশের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার ওপর মানুষকে নির্ভর করতে দেখা যায়। এখন মিডিয়ার সংখ্যা বেড়েছে। বিকল্প মিডিয়াও অনেক এসেছে। বলা যায়, সোস্যাল মিডিয়ার যুগ শুরু হয়েছে। এর প্রভাব ও প্রাধান্য দিন দিনই বাড়ছে। সোস্যাল মিডিয়া কোনো সুশৃংখল মিডিয়া নয়। এর দায়বদ্ধতাও কম। তারপরও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন কি আমাদের দেশেও নানা ঘটনা ও ইস্যুতে এর ইতিবাচক ভূমিকা লক্ষ্য করা গেছে। নেতিবাচক ভূমিকাও অবশ্য দূর্লক্ষ্য নয়। মেইন স্ট্রিম মিডিয়া যদি মত প্রকাশের অধিকার ভোগ করে, তবে সোস্যাল মিডিয়ার ওপর ভরসা করার কোনো কারণ থাকে না। যখনই এর ব্যত্যয় ঘটে তখনই সোস্যাল মিডিয়া প্রাধান্যে চলে আসে এবং তার ওপর নির্ভরতা দেখা দেয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, বর্তমানে আমাদের দেশে কি সংবাদপত্রসহ মেইন স্ট্রিম মিডিয়া মত প্রকাশের অধিকার পুরোপুরি ভোগ করছে কিংবা যথাযথ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই দেখতে হবে, মানুষ এই মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার ওপর কতটা আস্থা বা বিশ্বাস রাখে। বলাই বাহুল্য, মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার ওপর আস্থা ও নির্ভরতা এখন দারুনভাবে কমে গেছে। তথ্যপ্রবাহের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও কার্যত অনেক ক্ষেত্রেই এর প্রমাণ মিলছেনা। নানা রকমের নিয়ন্ত্রণমূলক আইন-কানুনের কারণে এ মিডিয়া প্রত্যাশিত ভূমিকা ও দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন করতে পারছে না। তার পরিবেশিত তথ্য-খবর অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না মানুষের কাছে, ফলে তারা ক্রমাগত ঝুঁকে পড়েছে সোস্যাল মিডিয়ার ওপর। এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি বাস্তবতা।
অনিয়ন্ত্রিত ও দায়বদ্ধতাহীন সোস্যাল মিডিয়ার ওপর বিশ্বাস ও নির্ভরতার ফল অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে উঠতে পারে ভয়ংকর। এখানে দুরভিসন্ধিমূলক বিকৃত তথ্যের যেমন উপস্থাপন হতে পারে, তেমনি নানা গুজবও ছড়িয়ে দেয়া হতে পারে, যাতে হিতে বিপরীত হওয়ার সমূহ আশংকা থাকে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে কিশোর শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে, প্রকৃত তথ্যের পাশাপাশি বিকৃত তথ্য বা গুজবও বিস্তার লাভ করছে। সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই মর্মে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, আওয়ামী লীগের ধানমন্ডী কার্যালয়ে চারজন ছাত্রীকে আটকে রাখা হয়েছে ও একজন ছাত্রের চোখ তুলে নেয়া হয়েছে। এটা ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট মিথ্যা তথ্য। এর প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি দল ওই কার্যালয়ে হামলা চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে পুলিশ আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের সেখানে নিয়ে যায়। দেখা যায়, এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। একজন অভিনেত্রী তার ফেসবুকে জানান, জিগাতলায় শিক্ষার্থীদের একজনের চোখ তুলে নেয়া হয়েছে এবং চারজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। এই মিথ্যা তথ্য দেয়ার জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, তিনি কারো কাছ থেকে শুনে এ তথ্য পরিবেশন করেছেন। অন্য এক খবরে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে গুজব ছড়ানো ও উস্কানি দেয়ার অভিযোগে ২৮টি সাইটের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি এ্যাÐ ক্রাইম বিভাগ বাদী হয়ে রমনা থানার এ মামলা করেছে। মামলার এজহারে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবাদে ও সড়ক ব্যবস্থাপনার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ভিন্ন পথে চালিত করার জন্য একটি স্বার্থানেষী চক্র ফেসবুক ও টুইটারের ২৮টি আইডিতে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক পোস্ট ও তথ্য দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গুজব সৃষ্টিকারী ও উস্কানিদাতাদের ধরার জন্য অভিযান চালানো হবে।
গুজব, মিথ্যা তথ্য ও উস্কানি মারাত্মক অঘটনের জন্ম দিতে পারে। সেক্ষেত্রে গুজবসৃষ্টিকারী, মিথ্যা তথ্য পরিবেশনকারী এবং উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার আবশ্যকতা অস্বীকার করা যায় না। তবে এটাই সমাধানের একমাত্র উপায় নয়। বলার অপেক্ষা রাখেনা, তথ্যর প্রবাহ যদি অবাধ থাকে, প্রকৃত তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে মেইন স্ট্রিম মিডিয়া যদি কোনো চাপ, বাধা ও নিয়ন্ত্রণের সম্মুখীন না হয় এবং যদি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সকল তথ্য ও খবর পরিবেশন করতে পারে তাহলে মিথ্য তথ্য ও গুজব আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে যাবে। অতএব মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার জন্য এমন অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে যাতে তার পক্ষে পেশাগত দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন সহজ হয়। সরকারকেই এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে মেইন স্ট্রিম মিডিয়াকেও ‘সাংবাদিক বিবেকে’র পরিচয় উর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। তথ্য গোপন বা পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে হবে। জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে হবে। তথ্য পাওয়া জনগণের অধিকার। এ অধিকারের কথা বিবেচনায় রেখেই তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। পুনর্বার আমরা একথাই বলতে চাই যে, সংবাদপত্রসহ মেইন স্ট্রিম মিডিয়ায় নির্বাধে মত প্রকাশ ও তথ্য পরিবেশনের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং মিডিয়াকেও এ অধিকার দায়িত্বশীলতার সঙ্গে, সুবিবেচনার সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই তার ওপর গণমানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরতা প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন আর সোস্যাল মিডিয়ার ওপর কেউ নির্ভর করবে না, বিশ্বাস স্থাপন করবে না। আর তখন মিথ্যা ও বিভ্রান্তকর তথ্য ও গুজব সৃষ্টিরও অবকাশ থাকবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।