পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। আকাশযানের বদৌলতে সকালে লন্ডন থেকে রওয়ানা দিলে দুপুরে ঢাকায় খাবার খাওয়া যায়। গ্লোবালাইজেশনের যুগে দেশে দেশে নেতায় নেতায় সম্পর্ক স্বাভাবিক বিষয়। নেতানেত্রীরা যতই দেশ-বিদেশ ঘুরবেন ততই অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। কিন্তু বাংলাদেশের নেতানেত্রীদের কেউ ভারত গেলেই শুরু হয় তোলপাড়। হৈচৈ হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে। নেতানেত্রীরা ইংল্যান্ড, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, জাপান, ইউরোপের দেশগুলো সফর করছেন। তা নিয়ে কোনো বিতর্ক উঠে না। দিল্লি গেলেই বিতর্ক! প্রশ্ন হলো কেন এই বিতর্ক-হৈচৈ? বিতর্কের কারণ হলো আমাদের নেতানেত্রীদের দিল্লির প্রতি নতজানু মানসিকতা। তাদের বিশ্বাস দেশের জনগণ নয়; দিল্লির অনুকম্পা ক্ষমতায় আরোহণের উৎস। কথাবার্তা ও আচরণে সেটাই প্রকাশ করেন। ১৯৭৪-৭৯ লেন্দুপদর্জি দিল্লি সফরে গেলে সিমিকের নাগরিকেরা যেমন হৈচৈ করতেন; ঢাকার নেতানেত্রীরা দিল্লি গেলে দেশের মানুষের মধ্যে একই অবস্থার উদ্রেগ হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে বর্তমানে দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে যে দিল্লিমুখিতা; ৫ বছর আগেও দেখা যায়নি এমন চিত্র।
হিন্দুত্ববাদী ভারত চানক্যনীতিতে অভ্যস্ত। বৃহৎ পুঁজির দেশটির আগ্রাসী চরিত্রের কারণে বাংলাদেশ ছাড়া প্রতিবেশি কোনো দেশেই সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই। বৈরিতাই যেন দেশটির মূলনীতি। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। সংবিধান সংশোধন ইস্যুতে ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপ নেপালের জনগণ মেনে নেয়নি। ডোকা লা মালভূমিতে রাস্তা নির্মাণে চীনের সঙ্গে বিরোধে ভারতের পাশে দাঁড়ায়নি ভুটান। ভারতের একান্ত অনুগত নয় শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপও। প্রতিবেশি এই দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতাদের আত্মসম্মানবোধ ও দৃঢ়তার কারণেই ভারত এখন সমীহ করতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র। ঢাকায় কর্মরত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলাকে দেখলে আমাদের মন্ত্রী-এমপিরা লাফ দিয়ে উঠে চেয়ার ছেড়ে দেন। নেতানেত্রীরা ভারতের একজন সাধারণ কর্মচারীকে যেভাবে সমীহ করেন তাতে মনে হয় ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পিন্ডির জিঞ্জির ছিঁয়ে ফেলে এখন দিল্লির শিকলে আটকে যাচ্ছি।
সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সম্প্রতি দিল্লি সফর নিয়ে দেশে চলছে হৈচৈ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন ইস্যুতে ভারতের ওই সময়ের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এর বক্তব্য নিয়ে এরশাদ হাটেহাড়ি ভেঙ্গে দিলে দিল্লি তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এখন তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে এরশাদ ভারত গিয়ে কী দিল্লির বরফ গলাতে পেরেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায় ঢাকায় ফিরে এরশাদের সংবাদ সম্মেলনের কাহিনী। দিল্লি সফরের সাফল্যগাঁথা তুলে ধরতে নিজের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে এরশাদ নিজেই সেখানে হাজির হননি। আর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দিল্লি সফরে গেলেও তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এমনকি প্রেসিডেন্ট রাম নাথ কোবিন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাননি। এরশাদকে দিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং, পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোলাভালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফিরে আসতে হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ দিল্লি গিয়ে যাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন; এদেশের ইউনিয়ন পরিষদের কোনো চেয়ারম্যান দিল্লি গেলে অনায়াসে তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। এমনকি ঢাকার সাংবাদিক ও সাংস্কৃতির ব্যাক্তিত্বরা প্রায়ই দিল্লি গিয়ে সে দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে খানাপিনা করেন। এক সময়ের বিশ্বের প্রভাবশালী রাজনীতিক এইচ এম এরশাদের এই করুণ পরিণতির নেপথ্য কারণ কী? কারণ হলো তার রাজনৈতিক দৈন্যতা, নেতৃত্বের দেউলিয়ানা, পাপেট রাজনীতি চর্চা, পরনির্ভরশীলতা, অন্যের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা।
এরশাদ দীর্ঘ ৯ বছর দেশ শাসন করেছেন। বিশ্ব রাজনীতিতে যারা প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত তাদের অনেকের সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধুত্ব। বিশ্বের অনেক বরেণ্য নেতার সঙ্গে ছিল এরশাদের ব্যাক্তিগত সম্পর্ক। এমনকি ’৯০ এর ক্ষমতা হারানোর পরও সউদী আরব, আমেরিকা, কানাডা, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লিবিয়া, তুরস্ক, ভারত, মিশর, মালয়েশিয়া, চীন, জাপান, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, ফিলিস্তিন, মালদ্বীপ, ইংলান্ডসহ অনেক দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক অটুট ছিল। মুসলিম দেশের নেতা এবং সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজন করায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শাসক ও প্রভাবশালী ধনী পরিবারগুলো এরশাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। বন্দী এরশাদের মুক্তির জন্য বিশ্বের বহু প্রভাবশালী নেতা দূতিয়ালী করেছেন। বিশ্ব রাজনীতির সেই দাপুটে এরশাদ দিল্লি গিয়ে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাননি। কারণ বিদেশীরা মনে করছেন এরশাদ এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বহীন ব্যাক্তি; হাসির খোরাক বটে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে ভেল্কিবাজী এবং পরবর্তীতে জাতীয় পার্টির সুবিধাবাদী ভূমিকা, একদিকে মাঝে মাঝে মন্ত্রি সভা থেকে পদত্যাগের ঘোষণা; অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুকম্পা পাওয়ার চেষ্টা রাজনীতিক হিসেবে তাকে বিতর্কিত করে তুলেছে। স্ববিরোধী কথাবার্তা, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, স্ত্রীর মুখাপেক্ষী রাজনীতি, জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের ভূমিকায় অবতীর্ণ করা, আওয়ামী লীগ যেমনে নাচায় তেমনে নাচা এবং নজীরবিহীন ভাবে একসঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকা ইত্যাদি কারণে দেশ-বিদেশে এরশাদ নিজেকে গুরুত্বহীন এবং হাসির পাত্রে পরিণত করেছেন। দেশে যেমন ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি এখন প্রার্থী করার লোক খুঁজে পান না; তেমনি বিদেশীদের কাছেও হয়ে গেছে অপাংয়েতেয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে সুষমা স্বরাজ তাচ্ছিল্যের সুরে এরশাদকে বলেন, বিরল দৃষ্টান্ত-জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে থেকেও সরকারের সাথে দায়িত্ব পালন করছে!
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের দিল্লি সফরের পর এরশাদ দেশবাসীকে বার্তা দিতে চেয়েছিলেন তিনিও দিল্লির কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ নন। কিন্তু দিল্লি দর্শন করতে গিয়ে তিনি যে ভাবে অবহেলিত হয়েছেন; সেই দুঃখে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেও নিজেই হাজির হননি।
এই রাজনৈতিক দৈন্যতা শুধু কী এরশাদের! ভারত অখুশি হতে পারেন এমন শব্দ আমাদের নেতাদের কেউ উচ্চারণ করেন না। বরং নেতাদের মধ্যে চলছে দিল্লিকে খুশি করার প্রতিযোগিতা। এপ্রিল মাসে ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে ঢাকা সফর করেন। আওয়ামী লীগের থিঙ্কট্যাঙ্করা তাকে সুতাজা সিং এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি জানিয়ে দেন, দিল্লির বার্তা হলো কোনো দল নয় ভারত দুই দেশের ‘পিপলস টু পিপলস’ সম্পর্ক গড়ার নীতিতে অটল। দিল্লি চায় সব দলের অংশগ্রহণে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার।
দিল্লির সাউথ ব্লকের এই মনোভাবের মধ্যে গত ১৭ এপ্রিল দিল্লি সফর করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, ডা দিপু মনির নের্তৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। জুন মাসে ২০ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে দিল্লি সফরে করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দিল্লি যাতে আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভুতিশীল হয় তারা সে প্রস্তাবনা দেন। একই সঙ্গে বিএনপির বিরুদ্ধে বিয়োদগার করেন। তারা ফিরে আসার পর জুন মাসেই দিল্লি সফরে যান বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও হুমায়ুন কবির। তারা ভারতের নীতি নির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশে জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার প্রস্তাব দেন। বিএনপি নেতাদের ভাষায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র না থাকলে ভারতও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বিএনপির নেতাদের দিল্লি সফর নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয় তোলপাড়। আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবী, কিছু মিডিয়া এবং কিছু সাংবাদিক এমন বিতর্ক করেন যে বিএনপি নেতাদের দিল্লি সফর করার যেন অধিকার নেই। দিল্লির সঙ্গে কেবল মাত্র আওয়ামী লীগ সম্পর্ক রাখবে। বিএনপির নেতাদের দেশে ফেরার পর দিল্লি যান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। ভারতের থিঙ্কট্যাঙ্কদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, তিস্তার পানির প্রয়োজন নেই। বিএনপি পাকিস্তানপন্থী দল। বিএনপিকে বিশ্বাস করা ভারতের উচিত হবে না। তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে দেশ-বিদেশে তীব্র বিতর্ক হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের যারাই দিল্লি গেছেন তাদের সকলকেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে ভারত চায় বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন।
নেতানেত্রীদের দৌঁড়ঝাপের মধ্যেও ভারত পিপলস টু পিপলস সম্পর্ক গড়ার নীতিতে অটল থাকায় নেতাদের কথাবার্তায় কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে। যারা এতোদিন মনে করতেন জনগণ নয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার চাবি দিল্লির হাতে। তাদের কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, ‘দিল্লি কাউকে এদেশের ক্ষমতায় বসাবে না’। আমাদের নেতানেত্রীদের মানসিকতার এই পরিবর্তন অব্যাহত থাকুক এটাই সবার প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।