পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর লাগাতার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। ক্ষমতার দাপটে ছাত্রলীগ এতটাই বেসামাল যে কোনটা যৌক্তিক দাবি আর কোনটা অযৌক্তিক দাবি তাও অনুধাবন করতে পারছে না। ঐতিহ্যবাহী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের একটি গৌরবজ্জ্বল অতীত আছে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা ও ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান,৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখা সংগঠনটি এখন সকল অপকর্মের হোতা হিসেবে সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। প্রতিনিয়ত তাদের নানা ধরনের আপত্তিকর কর্মকাÐ ছাত্র রাজনীতির সুনামকে নস্যাৎ করে দিলেও প্রতিরোধে ক্ষমতাসীন দলের তেমন কোন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। পত্রিকার পাতায় যখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার দৃশ্য দেখেছি তখন মনের অজান্তেই বিশ্বজিৎতের কথা মনে পড়ে গেল। বিশ্বজিৎতকে যেভাবে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ঠিক একই কায়দায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে। বিশ্বৎজিত হয়তো বেঁচে থাকলে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বলতেন, ভাই কোটার দরকার নেই, আগে জীবন বাঁচান।
গত ১৭ ফেব্রæয়ারি থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা দেশব্যাপী আন্দোলন করে আসছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৯ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করে ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করে আন্দোলকারীরা। গত ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে সব কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। আন্দোলনকারীরা এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আনন্দ মিছিল করে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রজ্ঞাপন অদ্যাবধি জারি হয়নি। প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ডাকে সারাদেশে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি চলছিল। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রায় তিন মাস পার হলেও প্রজ্ঞাপন জারি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় নতুন করে আন্দোলনের প্রস্তুতির জন্য ৩০ জুন শনিবার বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে সাংবাদিক সম্মেলন শুরুর আগেই ছাত্রলীগ তাদের উপর নির্মম-নিষ্ঠুর হামলা চালায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই সমাজ ও রাষ্ট্রে হাজারো অন্যায়-অবিচার-জুলুম চললেও কেউ টু-শব্দ করতে পারবে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা সামান্য একটা সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি কেন নিল এই অপরাধে তাদের উপর হামলা করা হয়েছে। এদিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সারাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে বাধা দেয় পুলিশ। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর যে অত্যাচার চলছে, তাতে আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার মাথা নত হয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, এজন্য কী মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, কথা বলার অধিকার নাই। এ লজ্জা রাখবো কোথায়!
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়েছে এটা তো অস্বীকার করার সুযোগ নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে। কোটাবিরোধীদের ওপর ছাত্রলীগের এ ধরনের অমানবিক নিষ্ঠুর হামলা বেদনাদায়ক। সবারই মনে রাখা প্রয়োজন, কাউকে মাটিতে ফেলে লাথি মারা কোনো সভ্য মানুষের কাজ নয়! ছাত্রলীগের হামলাকারীদের হাত থেকে ছাত্রীরা পর্যন্ত রেহাই পায়নি। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেত্রী, স্পীকার নারী সেই দেশে একজন নারীকে ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে রাজপথে পিটিয়ে আহত করলেও নারীবাদী সংগঠনের নেত্রীরা টু-শব্দ পর্যন্ত করেনি। এমনকি মানবাধিকার সংগঠন, নাগরিক সমাজ ও টিআইবির কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। নারীর জীবন ও ইজ্জত লুণ্ঠনকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় যা-ই থাকুক তারা কোন সভ্য সমাজের মানুষ হতে পারে না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর নারকীয় হামলা চালানো হলেও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হচ্ছে। কিন্তু ঐ দিন ছাত্রলীগের কর্মীবাহিনী কী করছে সেটি অনুধাবন করার জন্যে কয়েকটি পত্রিকার শিরোনামের দিকে চোখ বুলালেই বোঝা যাবে। প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম, খুঁজে খুঁজে মারল ছাত্রলীগ। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের শিরোনাম, Quota Movement: BCL swoops on reformists. বাংলাদেশ প্রতিদিনের শিরোনাম, আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা। দৈনিক যুগান্তের শিরোনাম, কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা। দৈনিক নয়া দিগন্তের শিরোনাম, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের দফায় দফায় হামলা। দৈনিক ইনকিলাবের শিরোনাম, কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর দফায় দফায় হামলা। পাঠক, একবার ভাবুন তো, ওই সব পত্রিকার পাতায় যদি শিবির অথবা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের সন্ত্রাসী কর্মকাÐের ছবি মুদ্রিত হতো তাহলে গ্রেফতার কত হাজার হতো। অথচ প্রকাশ্যে দিবালোকে যারা কাÐজ্ঞানহীন কাজ করছে তাদের কাউকে আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী গ্রেফতার তো দূরের কথা একটু ধমকও দিতে পারেনি। উল্টো কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহŸায়ক মুহাম্মদ রাশেদ খানের বিরুদ্ধে করা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি(আইসিটি) আইনের মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই কোটা আন্দোলনকারী ছাত্রলীগ হয়ে যায় ছাত্রশিবির। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ছাত্রলীগসংশ্লিষ্ট। মতের মিল না হওয়ায় ছাত্র শিবির বলে তাদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধনী-গরিব বা সাদা-কালো নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক! কিন্তু কোনো একটি গোষ্ঠীর জন্য শুধুমাত্র অধিকার সংরক্ষন করা হলে সামাজিক বৈষ্যম বাড়বে। ছেলেমেয়েরা উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার সম্পত্তি পেতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় সুবিধা পেতে পারে না। বাংলাদেশের প্রতিটি ছেলেমেয়েই অন্যান্য ছেলেমেয়ের মতোই সমান অধিকার পাওয়ার যোগ্য। এই অধিকার প্রয়োগে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী বাছবিচারের বিষয় হতে পারে না। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা রয়েছে। ভারতে মোট ৪ ধরনের কোটা পদ্ধতি চালু আছে। যেমন উপজাতি কোটা, বিভিন্ন জাতভিত্তিক কোটা, অন্যান্য অনগ্রসরদের জন্য কোটা এবং বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘু কোটা। তবে কোটা পদ্ধতি থাকলেও ভারতে কোটার জন্য একটি সুষ্ঠু নীতিমালা রয়েছে। একটি পরিবারের মাত্র একজনই কোটাসুবিধা গ্রহণ করতে পারবে এবং যদি কেউ উচ্চ শিক্ষার জন্য কোটা গ্রহণ করে তবে সে চাকরিতে কোটাসুবিধা পাবে না। আমাদের সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হবে। মুক্তিযোদ্ধারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা কেউ সন্তানের চাকরি কিংবা ভাতা পাবার আশায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান রক্ষার্থে যোগ্য প্রার্থীদের সর্বক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু যখন দেখি সরকারের একাধিক সচিবের বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর অভিযোগ সংবাদ মাধ্যমে মুদ্রিত হয় তখন সত্যিই মনে দাগ কাটে।
মেধাবীদেরকে বঞ্চিত করে পৃথিবীর কোনো দেশই উন্নয়নের উচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারেনি এটা যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য যে, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, অন্যায়ের প্রশয় দিয়ে ক্ষমতাসীনরা বেশি দিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। সমাজ বা রাষ্ট্রের দায়িত্বভার যখন অযোগ্য লোকদের হাতে ন্যস্ত হয়ে পড়ে তখন সেখানে আইনের শাসন ভুলন্ঠিত হয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ভাবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে নিজেদের লোক বসালেই তার সুফল পাবে। কিন্তু এই নীতি যে ভ্রান্ত তা ইতিহাসে প্রমাণিত হলেও ক্ষমতাসীন দল এই নীতি থেকে সরেনি। স্বাধীনতার পর তৎকালীন বিডিআর-এর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান। তিনি তার কাছ থেকে দেখা ১৯৭৩-৭৫ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, ১৯৭৮ সালের গোড়াতে আমি আওয়ামী লীগে যোগদান করি এবং বেশ সক্রিয়ভাবে রাজনীতি শুরু করি। সে নির্বাচনে জেনারেল ওসমানী রাষ্ট্রপতি পদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ঐক্যজোটের প্রার্থী ছিলেন। তাঁর নির্বাচনী প্রচার অভিযানে চলেছি ভোলায়, তোফায়েল সাহেবের এলাকায় জনসভা হবে। আমরা ওরই মেহমান। লঞ্চে বসে গল্প। আমি, তোফায়েল ও রাজ্জাক। কথা হচ্ছিল জিয়াউর রহমানের আমলে জেল খাটার সময়ে তাঁরা দুজন কেমন লাঞ্ছনা ভোগ করেছেন এবং কার হাতে। সেদিন একটা দামি কথা বলেছিলেন তোফায়েল সাহেব। বলেছিলেন ভাই, সবচাইতে বেশি খারাপ ব্যবহার পেয়েছি ওইসব অফিসারের কাছ থেকে, যাদের আমি নিজের হাতে ভর্তি করেছিলাম ১৯৭২ সালে। এরা আমাদের মনোভাবপন্ন এটাই ছিল তাদের যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি। তাদের চাইতে শিক্ষাগত ও মেধাগত দিক থেকে বেশি যোগ্য কিন্তু আমাদের চিন্তাধারার অনুসারী নয় এমন অনেক প্রার্থীকে বাদ দেওয়া হয়। কাজটা বোধ হয় ভুল হয়েছে খলিল ভাই, তাই না? আমি হেসেই বলেছিলাম, ‘মারাত্মক ভুল হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে অযোগ্য লোকের কোনও নীতি বা আদর্শ থাকে না। থাকলেও চাকরি রক্ষার্থে তা বিসর্জন দিতে তার একমিনিটও সময় লাগে না। ক্ষমতাসীন শাসকদের এটা অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, সত্যিকার অর্থে যারা যোগ্য তাদের হাতে শত্রæরাও নিরাপদ। রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের কোটার ভিত্তিতে বসানো সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ, এটা বোধ হয় নতুন করে কাউকে বুঝানোর প্রয়োজন নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।