পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। যাত্রা শুরু হলো ১৪২৩ সালের। আমাদের জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, নিজস্ব সংস্কৃতি ও অর্থনীতির সাথে এই সনের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বঙ্গাব্দ চালুর সাথেও ইতিহাসের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। অতীতের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হলে বলতে হয় ভারতবর্ষ দীর্ঘদিন ধরেই ইসলামী আইনে পরিচালিত হয়েছে। সে মোতাবেক ভারতবর্ষে ইসলামী পঞ্জিকাই চালু ছিল। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে সুলতানী যুগের অবসান হয়। মোগলরাও ক্ষমতায় এসে তুরস্কের সনদ গ্রহণ করেছিল। সে সময়ে কর আদায় করা হতো ইসলামী বিধান মতে। মোগলরাও তার ব্যত্যয় করেননি। সম্রাট আকবর ক্ষমতাসীন হয়ে কর আদায়ের সাথে ইসলামী পঞ্জিকার সাংঘর্ষিকতা অনুভব কররেন। সে বিবেচনায় তিনি যে ফসলী সন চালু করার সিদ্ধান্ত নেন সেটিই কার্যত এখনকার বাংলা সন। এই তারিখটি তিনি অমর করে রেখেছেন ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে। ভারতবর্ষে হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে হিমু নিজেকে বিক্রমাদিত্য উপাধিতে ভূষিত করে সম্রাট আকবর তথা মোগলদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করলে ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন। এই দিনটিকে স্মরণীয় রাখতে ৯৬৩ হিজরিতে বঙ্গাব্দের চালু করা হয়। তবে এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আগে থেকেই। সম্রাট আকবরের নির্দেশে আমীর ফতেহ উল্লাহ শিরাজী বাংলাসনের উদ্ভাবন করেন। বর্তমানে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রণীত পঞ্জিকা অনুযায়ী নববর্ষ পালিত হয়। ব্রিটিশ যুগে ভারতবর্ষে খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জী চালু করা হয়। সে থেকে এখন পর্যন্ত তিন সনই চালু রয়েছে। সামাজিক রীতি অনুযায়ী, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির ক্ষেত্রে হিজরি সনের ব্যবহার করাহচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতি, জীবনযাত্রা,ফসল বোনা, কাটা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলা সনের কার্যকর ব্যবহার রয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে খ্রিস্টীয় সাল।
আমাদের জাতীয় জীবনে নববর্ষের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাপক ও বিস্তৃত। সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নববর্ষের প্রভাব অনস্বীকার্য। দীর্ঘকাল ধরেই আমাদের ব্যবসায়ীরা পহেলা বৈশাখকে নতুন হিসাব খোলা বা হালখাতার দিন হিসেবে পালন করে আসছে। নববর্ষকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজন শহুরে সভ্যতায় ঘটা করে স্থান করে নিলেও গ্রামীণ সমাজে তা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। এসব মেলাকে কেন্দ্র করে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের প্রস্তুতিও থাকে অনেক দিন থেকে। কারণ, সাধারণত এসব মেলায় এমন কিছু পণ্য বেচা বিক্রি হয় যা বছরে অন্যসময়ে পাওয়া যায় না। এর বাইরেও মিঠাইম-ের আয়োজন তো থাকেই। বিশেষ ধরনের খেলাধুলার আয়োজনও থাকে। গত কয়েক বছর ধরে শহরে সাড়ম্বড়ে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে। এতেও গ্রামীণ জনপদের মতো নানা আয়োজন থাকছে। লক্ষ্যণীয় এবং উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে মেলাকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি তথা বিজাতীয় সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করে তোলার এক ধরনের প্রবণতা কোন কোন মহলে রয়েছে। যদিও এ কথা বলা দরকার বাংলাভাষা হওয়া সত্ত্বেও আমরা এবং ভারতের পশ্চিমবাংলার অধিবাসী বা ভারতের যেসব অংশের নাগরিকরা পহেলা বৈশাখকে বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালন করছে তারা কিন্তু আমাদের পঞ্জিকা অনুসরণ করছে না। তারা শতাব্দের অনুযায়ী বাংলা সনের পঞ্জিকার অনুসরণ করছে। এর ফলে শুনতে অনেকটা একরকম হলেও কার্যত দু’দেশের নববর্ষ পালনের রীতি-নীতি এক হবার কথা নয় এবং তা হচ্ছে না। মূলত হিন্দুরা এটি পালন করে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে। আমরা পালন করি জাতীয় উৎসব হিসেবে। শুধু আমরা নই পৃথিবীর অনেক জাতিই তাদের নববর্ষ পালন করে জাতীয় উৎসব হিসেবে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। নববর্ষ আমাদের জাতীয় উৎসব। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এ দুটোর টিকে থাকার লড়াই এক ও অভিন্ন। আমাদের অন্যতম জাতীয় ইতিহাস ঘাঁটলেও যেভাবে বর্ণবাদ ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতার মধ্যে বেঁচে থাকার সূত্র মিলবে আমাদের নববর্ষের সাথেও তেমনি যুক্ত রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই। সে কারণে বিজাতীয় অপসংস্কৃতি দূরে ঠেলে পালন করতে হবে নববর্ষ।
নববর্ষ যেহেতু আমাদের সার্বজনীন জাতীয় উৎসব সে কারণে ধর্ম গোত্র বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য এটি একটি বড় আকর্ষণ। নববর্ষ পালন এখন আর আমাদের দেশের সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং বিদেশে যেসব বাংলাদেশীরা রয়েছেন তারাও পালন করছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়ায় আমাদের নববর্ষেরও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে। পৃথিবীতে এরকম খুব কম দেশই রয়েছে যাদের মাতৃভাষা এবং নববর্ষ এক সূত্রে গাঁথা। ভারতের জাতীয় ভাষা হিন্দী অথচ তাদের কোন সর্বসম্মত নববর্ষ নেই। সে কারণেই নববর্ষের জাতীয় উৎসবে জাতীয় ইতিহাস দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতি এবং বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতিফলন থাকাই সময়ের দাবি। একটি সুসংহত মার্কিন সমাজ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা থেকে ইমার্সন বলেছিলেন ‘নিজেরা স্বাধীন জাতি হিসেবে দাবি করবো অথচ কৃষ্টি সাহিত্য-সংস্কৃতি বাধা হয়ে থাকবে অন্যের কাছে এভাবে স্বাধীনতা রক্ষা করা যাবে না।’ একথা সকলকেই মনে রাখতে হবে আমাদের ধর্মই আমাদের সংস্কৃতির সূত্র উৎস হিসেবে কাজ করছে। এবারে নববর্ষ পালিত হোক জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। আসুন আগ্রাসী শক্তির হাত থেকে স্বাধীনতা রক্ষার শ্লোগান হোক জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ। এভাবে রুখে দেই আগ্রাসী সংস্কৃতি। পরিশেষে নববর্ষে আমরা দেশবাসীসহ আমাদের পাঠক, সমর্থক, পৃষ্ঠপোষক ও শুভানুধ্যায়ীদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।