Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পশ্চিমবঙ্গে চীনের সম্ভাব্য বিনিয়োগ হেলায় হারালেন মমতা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৬ এএম

পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি শেষ মুহূর্তে তার নির্ধারিত চীন সফর বাতিল করে ভারতীয় রাজনীতির বিব্রতকর বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছেন। তার মুখপাত্র বলেছেন, চীনের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চূড়ান্ত করতে ব্যর্থ হওয়ায় সফর বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু চীনের ব্যাবসায়ী চেম্বারের সাথে মমতার বৈঠক চূড়ান্ত করা হয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় নিযুক্ত চীনা কনস্যুলেটও আশাবাদ জানিয়েছেন যে, পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ আসতে যাচ্ছে। যেটা চূড়ান্ত হয়নি সেটা হলো কোন পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা তার সাথে বৈঠক করবেন। বেইজিং ও সাংহাইয়ে অবস্থানকালে চায়নিজ কমিউনিস্ট পার্টির সিনিয়র নেতাদের সাথে বৈঠকের আগ্রহ ছিল মমতার। দুই জায়গাতেই তার বেশ কিছু অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার কথা ছিল। আট দিনের এই সফরে চীনের বাণিজ্যিক রাজধানীতে বিনিয়োগকারীদের সাথে বৈঠকেরও কথা ছিল তার।
২০১৫ সালের নভেম্বরে চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট লি ইউয়ানশাও কলকাতায় তার সাথে বৈঠক করেন এবং তাকে ভারতের ‘সবচেয়ে সৎ রাজনীতিবিদ’ আখ্যা দেন। তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, চীনে প্রথমবারের মতো সফরকালে ওই পর্যায়ের নেতাদের সাথে বৈঠকের প্রত্যাশা করেছিলেন মমতা।
ভারত সফরের শুরুতে কলকাতায় আসা এবং মমতার সাথে বৈঠক করার মধ্য দিয়ে চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট লি ইউয়ানশাও সূক্ষè একটা বার্তা দিয়েছিলেন। মোদি সরকার যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি হওয়ার কারণে নয়াদিল্লীর সাথে বেইজিংয়ের যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল, সে রকম একটা পরিস্থিতিতে মমতার সাথে উষ্ণ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করেছিল চীন। দিল্লী বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি এবং গত বছর প্রথম যখন মমতা চীন সফরের আমন্ত্রণ পান, তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে চীন সফরে না যাওয়ার উপদেশ দিয়েছিল। অনিচ্ছার সাথে মমতা সেটা মেনে নিয়েছিলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এছাড়া বিজেপি বিষয়টি নিয়ে খেলবে এবং তাকে দেশদ্রোহী হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করবে। পাকিস্তান দূত আব্দুল বাসিতকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয়ায় এরইমধ্যে সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে গেরুয়া শিবিরের লোকজন। তারা এটাকে মুসলিমদের তুষ্ট করার রাজনীতি হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু এ বছর যখন চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগ থেকে আমন্ত্রণ পান মমতা, তখন পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ততদিনে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে শিয়াওমেনে ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে বৈঠক করেছেন এবং উহানে অনানুষ্ঠানিক সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মমতা ব্যানার্জি এক টুইটে জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ মার্চে তাকে সুপারিশ করেছেন যাতে এক্সচেঞ্জ কর্মসূচির অধীনে প্রতিনিধি দল নিয়ে তিনি চীন সফরে যান। এরপরই তিনি চীন সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গে চীনা বিনিয়োগ নিয়ে আসা এবং সাংহাইতে এক বিজনেস সেমিনারে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগকারীদের সাথে তার বৈঠকেরও কথা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের বেইজিংয়ের চীনা কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে আলাদাভাবে বৈঠকের কথা ছিল।
সিপিসির কাছে লেখা এক চিঠিতে ব্যানার্জি বলেছেন, ‘উপযুক্ত পর্যায়ে’র প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক আয়োজন করতে না পারায় সফল বাতিল করা হয়েছে। মূল কর্মসূচি অনুযায়ী সিপিসির আন্তর্জাতিক ডিপার্টমেন্টের মন্ত্রীর সাথে বৈঠকের কথা ছিল মমতা ব্যানার্জির। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে তার অবস্থানের কথা চিন্তা করে ভারতীয় পক্ষ শীর্ষ চীনা নেতাদের সাথে বৈঠকের চেষ্টা করেছিল। বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
ভারতীয় পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল যাতে ভাইস-প্রেসিডেন্ট পর্যায়ের সিপিসির সাত সদস্যের স্ট্যান্ডিং কমিটির কারো সাথে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বেইজিংয়ের ভারতীয় কর্মকর্তারা ভারতীয় রাজনীতিতে ব্যানার্জির অবস্থান সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু চীনা পক্ষকে রাজি করানো সম্ভব হয়নি।
সিপিসিকে লেখা চিঠিতে ব্যানার্জি লিখেছেন, “সবকিছুই ভালোভাবে চলছিল, কিন্তু দুঃখজনকভাবে চীনা পক্ষ উপযুক্ত পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বৈঠকের ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে পারেনি, যেমনটা আমাদের রাষ্ট্রদূত তাদেরকে জানিয়েছিলেন”। গত শুক্রবার ওই চিঠিটি প্রকাশ করা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, “এ কারণে এক্সচেঞ্জ কর্মসূচির অধীনে চীনের প্রতিনিধি দলের সাথে আমার যে বৈঠকের কথা রয়েছে, সেটা কোন কাজে আসবে না”।
ব্যানার্জি লিখেছেন, “শেষ মুহূর্তে রাজনৈতিক বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় দুঃখজনকভাবে আমাদেরকে এই সফর বাতিল করতে হচ্ছে”।
এটা এখন স্পষ্ট হয়েছে যে, এই সফরের রাজনৈতিক অর্জনটি মমতার কাছে অর্থনৈতিক অর্জনের চেয়ে বড় ছিল। সিপিসির সিনিয়র নেতারা যদি মমতার সাথে দেখা করতেন, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে তার প্রতিপক্ষ কমিউনিস্টদের দমনের জন্য সেটাকে তিনি ব্যবহার করতে পারতেন। তার সমর্থকরা এরইমধ্যে প্রচারণা শুরু করেছিল যে, ব্যানার্জির চীন সফর থেকেই প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, ভারতীয় কমিউনিস্টদের চীনের কাছে আর সেই গুরুত্ব নেই। কারণ চীনই হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় কমিউনিস্ট শক্তি।
মমতা ব্যানার্জির সাথে এর আগে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনসহ অন্যান্য বিশ্ব নেতারা বৈঠক করেছেন। কিন্তু সব বৈঠকই হয়েছে যখন তারা কলকাতা এসেছেন, সে সময়। চীনারা সাধারণত তাদের প্রটোকলের ব্যাপারে খুবই অনড় এবং সিপিসির শীর্ষ নেতারা সাধারণত কোন দেশের আঞ্চলিক নেতাদের সাথে বৈঠক করেন না, তা তারা নিজ দেশের জাতীয় রাজনীতিতে যত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই হোন না কেন। পরলোকগত জ্যোতি বসুর সাথে সিনিয়র সিপিসি নেতারা বৈঠক করেছিলেন, কিন্তু সেটা ভারতের সিনিয়র একজন কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে। যারাই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট রাজনীতির গতিপ্রকৃতির খবর রাখেন, তাদের জন্য এটা বোঝা কঠিন কিছু নয়।
কিন্তু মমতার নিজস্ব স্থানীয় অগ্রাধিকার রয়েছে এবং গুরুত্বের একটা ধারণা রয়েছে তার। সে কারণে হয়তো নির্দিষ্ট সফরের এক দিন আগে সফর বাতিল করেছেন তিনি। এখন শুধু এটাই প্রত্যাশা করা যেতে পারে যে, তার এই উদ্ধত সিদ্ধান্তের কারণে সম্ভাব্য চীনা বিনিয়োগ থেকে পশ্চিম বঙ্গ আবার বঞ্চিত না হয়ে যায়।
কলকাতায় নিযুক্ত চীনের কনসাল জেনারেল মা ঝানউ এর আগে মিডিয়াকে বলেছিলেন যে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সরকারের কর্তাব্যক্তি, ব্যবসায়ী নেতা এবং শিল্প চেম্বারের প্রতিনিধিদের সাথে একাধিক বৈঠকের পরিকল্পনা নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। মা এটাও জানিয়েছিলেন যে, এই সফরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরেরও পরিকল্পনা ছিল।
এখন আশা করতে হবে যাতে সবকিছু যাতে সচল থাকে যদিও চীনা বিনিয়োগকারী এবং সেদেশের কর্মকর্তারা কোন বাউন্ডুলে রাজনীতিকের ব্যাপারে অতটা আগ্রহী নন, যারা নীতির মধ্যে থেকে কাজ করেন না। সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মমতা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ