পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
হক ও বাতিল এবং ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে ইসলামের প্রথম যুদ্ধ ছিল ‘বদর’ যুদ্ধ। এতে শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল মক্কার কাফের-মোশরেকদের। এ পরাজয়ের গøানি ভুলতে না পেরে বিশাল প্রস্তুতি নিয়ে পরবর্তী বছর ঐ পরাজিত শক্তি ‘ওহোদ’ যুদ্ধ সংঘটিত করে, যার বিশদ বিবরণ সীরাত গ্রন্থগুলোতে রয়েছে। এখানে আমরা ‘ওহোদ’ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দুইজন জাঁহাবাজ মোজাহেদের দুইটি ব্যতিক্রম ধর্মী বিস্ময়কর ঘটনার উল্লেখ করতে চাই, যাদের একজনের নাম ‘আমর ইবনে জুমুহ’ (বৃদ্ধ খোঁড়া), যিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রসূলুল্লাহ (সা.) এর অনুমতি লাভ করেছিলেন এবং দ্বিতীয় জন ‘ওছাইরাম’, যিনি ইসলাম গ্রহণের পর এক ওয়াক্ত নামাজও পড়ার সুযোগ পাননি। নি¤েœ দুইটি কাহিনী আলাদাভাবে বর্ণিত হল।
বৃদ্ধ খোঁড়া আমর ইবনে জুমুহ: ওহোদ যুদ্ধের জন্য মহানবী (সা.) সাহাবাদের প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। আগের বছর বদর যুদ্ধে যারা ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও যোগদান করতে পারেননি, অন্যদের সঙ্গে তারাও বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ওহোদ যুদ্ধে গাজী কিংবা শহীদ হওয়ার জন্য প্রত্যেকেই হযরতের দরবারে উপস্থিত হতে লাগলেন এবং যুুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করতে লাগলেন। মদিনার উপকণ্ঠ হতে দলে দলে যুবকেরা এসেও তাদের আত্মত্যাগের প্রতিশ্রæতি দিতে লাগলেন। তাদের এই জিহাদি মনোভাব দেখে হযরত মুগ্ধ হলেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সকল শ্রেণীর লোকই উপস্থিত। আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা কেউ বাদ নেই। বিধর্মী কোরেশদের সাথে যুদ্ধের জন্য পাগলপারা মুসলমানদের এই প্রতিযোগিতামূলক যোগদান এক অভ‚তপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করে।
সত্যের জন্য আত্মত্যাগের কী বিচিত্র উদাহরণ! এই সময় একজন খোঁড়া বৃদ্ধ লাঠিতে ভর করে মহানবী (সা.) এর দরবারে দন্ডয়মান। সঙ্গে তাঁর চারজন যুবক পুত্রও। এই খোঁড়া বৃদ্ধের যুবক পুত্ররা হুজুর (সা.) কে জানালো যে, তারা চারজনই ওহোদ যুদ্ধে যোগদানের জন্য প্রস্তুত, হুজুর (সা.) এর অনুমতি চাই। তাদের নাম তালিকাভুক্ত করতে হবে। তাদের প্রতিবেশী লোকেরা সবিস্ময়ে তাদের খোঁড়া পিতার দিকে তাকাতে লাগল। বৃদ্ধ তাঁর লাঠির ওপর ভর করে হুজুর (সা.) এর সামনে সবকিছু অবলোকন করছিলেন। এক পর্যায়ে বৃদ্ধ তাঁর ছেলেদের ন্যায় যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলেন। যুদ্ধের জন্য তাঁর নামও তালিকাভুক্ত করতে হবে। তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন; ‘আমিও যাব।’ উপস্থিত লোকজন তাঁর কথা শুনে বলতে লাগল, ‘আপনি মা’জুর (অক্ষম), মাজুরের ওপর জিহাদ ফরজ নয়।’ বৃদ্ধ নীরবে তাদের কথা শুনতে লাগলেন। কিন্তু যখন তাঁর যুবক ছেলেরাও তাঁকে বাধাদান করল তখন রাগান্বিত হয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন; ‘তোমরা চুপ থাক। আমাকে তোমরা বদর যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত রেখেছিলে, জিহাদের সকল পুণ্য তোমরাই অর্জন করতে চাচ্ছ, আমি কি এর অংশীদার নই? কী বিস্ময়কর ব্যাপার যে, আমার ছেলেরা বেহেশতে গমন করবে, আর আমি তা থেকে বঞ্চিত থাকব।’
খোঁড়া বৃদ্ধ যখন দারুণ আবেগ ও আক্ষেপের সাথে এ মনোভাব ব্যক্ত করছিলেন তখন তাঁর খোঁড়া পা থরথর করে কাঁপছিল, লাঠিতে ভর করে অতি কষ্টেই তিনি স্থির ছিলেন। তার এই অবস্থা দেখে জনৈক প্রবীণ বন্ধু তার কাঁধে হাত রেখে বললেন; ‘আমর ইবনে জুমুহ! তুমি ঠিকই বলছ। কিন্তু প্রশ্ন হল, তুমি কীরূপে যুদ্ধে গমন করবে?’ বৃদ্ধ আল্লাহর কসম করে বললেন; ‘আমার খোঁড়া পা টেনে টেনেই আমি যাব।’ বৃদ্ধ আমর ইবনে জুমুহকে লোকেরা অনেক বুঝিয়েও যখন যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত থাকতে রাজি করাতে পারলো না তখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে অনুমতি দান করলে তিনি যুদ্ধে যেতে পারবেন। সকলেরই বিশ্বাস ছিল যে, হুজুর (সা.) তাকে অনুমতি দান করবেন না। আমর ইবনে জুমুহ পা টেনে টেনেই হুজুর (সা.) এর কাছে গমন করলেন এবং বললেন; ‘হে আল্লাহর রসূল! আমার আকাক্সক্ষা এই যে, আমি এই খোঁড়া পা নিয়ে বেহেশতে গমন করব।’ হুজুর (সা.) তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন; ‘আল্লাহ তোমাকে অক্ষম করেছেন, কাজেই তোমার যোগদান না করাতে এমন কি ক্ষতি আছে?’ আমর ইবনে জুমুহ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার অতি বিনয়ের সাথে তাঁর বাসনার কথা পুনরুল্লেখ করলেন। তাঁর পীড়াপীড়িতে হুজুর তাকে যুদ্ধে গমনের অনুমতি দান করেন।
হুজুর (সা.) এর অনুমতি লাভ করার পর আমর ইবনে জুমুহ খুবই আনন্দিত হলেন। তিনি লাঠিতে ভর করে দ্রæত পা টেনে টেনে তাঁর লোকজনের নিকট আসেন এবং কেঁদে কেঁদে বলতে থাকেন; ‘আমি অনুমতি লাভ করেছি। হুজুর (সা.) বলেছিলেন, যোগদান না করাতে ক্ষতির কি আছে? তোমরা জান, এর উত্তরে আমি কি বলেছিলাম?’ লোকেরা প্রশ্ন করল; ‘আপনি কী জবাব দিয়েছিলেন?’ আমর ইবনে জুমুহ বললেন; ‘আমি বলেছিলাম, হুজুর! আল্লাহর কসম, আমার বিশ্বাস যে, আমি এই খোঁড়া পা টেনে টেনেই বেহেশতে প্রবেশ করব এবং এরপর আল্লাহর রসূল (সা.) আমকে অনুমতি দান করেন।’
যে দিন ভোরে মদিনা বাহিনী ওহোদের পানে যাওয়ার জন্য বের হয় সে সময় আমর ইবনে জুমুহের গৃহ থেকে চারজন সুস্থ সশস্ত্র যুবককে বের করা হয় এবং তাদের অগ্রভাগের প্রথম সৈনিক ছিলেন স্বয়ং আমর ইবনে জুমুহ। তিনি পা টেনে টেনে বের হচ্ছিলেন। তখন তাঁর হাতে ছিল লাঠির পরিবর্তে একটি লম্বা বল্লম এবং তাকে অতি উৎসাহী ও উৎফুল্ল মনে হচ্ছিল। তাঁর স্ত্রী মশকের মুখ বন্ধ করতে করতে বলছিলেন; আমি দেখছি যে, সে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসছে। আমর ইবনে জুমুহ তাঁর স্ত্রীর এই কৌতুক বাক্য শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলেন এবং কেবলামুখী হয়ে দোয়া করতে লাগলেন; ‘আল্লাহুম্মা লা-তারুদ্দুনি ইলা আহলি।’ (অর্থ: হে আল্লাহ! আমাকে আমার গৃহের দিকে যেন প্রত্যাবর্তন করতে না হয়।)
রণক্ষেত্রে তুমুল যুদ্ধ চলছিল। হযরত আবু তালহা একটি টিলার ওপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধের দৃশ্য দেখছিলেন। তিনি দেখে বিস্মিত হলেন যে, সেই খোঁড়া এবং প্রবীণতম বৃদ্ধ তাঁর বল্লমের ওপর ভর করে অতি উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে দুশমনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন, বৃদ্ধ এত দ্রæত অগ্রসর হচ্ছিলেন যে, তার হেফাজতে নিয়োজিত তার ছেলে খাল্লাদ পিতার পেছনে দৌড়াচ্ছিল। ক্ষণিকের মধ্যেই খোঁড়া মোজাহিদ এক পায়ের ওপর ভর করে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করলেন এবং অপর হাত দ্বারা লম্বা বল্লমটি আল্লাহর এক দুশমনের গলায় নিক্ষেপ করে চিৎকার করে উঠলেন; ‘আল্লাহর কসম! আমি জান্নাত কামনা করছি।’
পিতা-পুত্র দুইজনই শাহাদত বরণ করেন। যুদ্ধ শেষ হলে আমর ইবনে জুমুহের স্ত্রী-পুত্ররা তাদের লাশের নিকটে আসেন। তাঁর স্ত্রী একটি উটে স্বামী ও পুত্রের লাশ উঠিয়ে মদিনার দিকে রওনা হন। কিন্তু উট কয়েক কদম চলার পর বসে যায়। অনেক চেষ্টা করে উটটিকে সামনের দিকে চালাবার চেষ্টা করা হলেও শেষ পর্যন্ত সে ওহোদের দিকে দৌড়াতে থাকে। আমরের স্ত্রী বিস্মিত হয়ে হুজুর (সা.) এর খেদমতে উপস্থিত হলে হুজুর (সা.) তাকে বললেন; ‘উটের প্রতি এটাই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমর যাওয়ার কালে কিছু বলেছিল কি?’ স্ত্রী বললেন, ‘হ্যাঁ, তিনি যাওয়ার সময় কেবলামুখী হয়ে দোয়া করেছিলেন যে, তাকে যেন আর গৃহের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে না হয়।’ হুজুর (সা.) বললেন; ‘হ্যাঁ, এ কারণেই উট সেদিকে যাচ্ছে না।’ হুজুর (সা.) যখন ওহোদের শহীদগণকে পরিদর্শন করে এই খোঁড়া শহীদের নিকট গমন করেন, তখন তাকে দেখে বললেন; ‘আল্লাহতায়ালা তাঁর কোন কোন বান্দার দোয়া কবুল করেন। আমর তাঁদেরই একজন এবং আমি তাঁকে বেহেশতে এই খোঁড়া পা দ্বারা চলাফেরা করতে দেখছি।’
নওমুসলিম ওছাইরাম: ওহোদ যুদ্ধে এমন একজন শহীদ হন, যিনি ইসলাম গ্রহণের পর হযরত আবু হোরায়রা (রা.) এর বর্ণনা অনুযায়ী, এক ওয়াক্ত নামাজও পড়ার সময় পাননি অথচ হুজুর (সা.) তাঁর বেহেশতি হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করেন। এই ব্যক্তির নাম আমর ইবনে সাবেত ইবনে ওকাশ ইবনে জাগবা ইবনে জাউরা ইবনে আবদুল আশহাল এবং সালমা ইবনে সাবেত -এর ভাই উব্বাদ ইবনে কুশর -এর চাচাতো ভাই এবং হোজাইফা ইবনুল ইয়ামানের ভাগ্নে। বনি আশহালের এই লোক ‘ওছাইরাম’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণে অস্বীকার করলেও মুসলমানদের সাথে উত্তম আচরণ করতেন। ‘ওহোদ’ যুদ্ধের দিন তার অন্তরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলামের মহব্বত সৃষ্টি হয় এবং ইসলাম গ্রহণ করে তরবারি ধারণ করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু এই খবর কারও জানা ছিল না। বনি আবদুল আশহালের লোকেরা যখন শহীদদের লাশ দেখছিল, তখন তাঁর প্রতি তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়, তারা বিস্মিত হয়ে বলে ওঠে যে, ‘আল্লাহর কসম, এতো ওছাইরাম!’ দেখা গেল, তার মধ্যে তখনও কিছুটা প্রাণ বাকি আছে। এখানে কীভাবে এল জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ইসলাম গ্রহণের কাহিনী বর্ণনা করেন এবং তখনই ইন্তেকাল করেন।
সম্ভবত ইসলামের ইতিহাসে ওছাইরামই একমাত্র সাহাবী এবং প্রথম শহীদ যিনি ইসলাম গ্রহণের কিছুক্ষণের মধ্যে ওহোদ যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন এবং এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ারও সময় পাননি এবং সৌভাগ্যবান যে, রসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বেহেশতি হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।