পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
হে খোদা! এখন যদি আমার দুনিয়াতে থাকা তোমার নিকট কল্যাণকর না হয় তাহলে আমাকে তুলে উঠিয়ে নিয়ে যাও।’ সময়টা জোহরের পরে। দুনিয়ার মানুষের অত্যাচার-নিপীড়নে অতিষ্ট হয়ে ইমাম বোখারী এ দোয়া করেন এবং মাগরিব ও এশা এর মধ্যে দোয়া কবুল হয়। হঠাৎ তার শরীর হতে প্রচুর ঘাম নির্গত হতে থাকে এবং এশার নামাজের পর আশেখে রসুল আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যান। ঈদুল ফিতরের চাঁদরাত। তাঁর বয়স হয়েছিল ১৩ দিন কম ৬২ বছর। হিজরী ২৬৫ সাল। ‘সমরখন্দ’ হতে তিন মাইল দূরে ‘খরতং’ নামক স্থানে তাকে দাফন করা হয়। হিজরী ১৯৪ সালের ১৩ শাওয়াল তার জন্ম। তাঁর কোন সন্তান ছিল না। একটি বর্ণনা অনুযায়ী তিনি শাদীও করেননি। তাঁর নাম মোহাম্মদ; উপনাম আবু আব্দুল্লাহ। পিতার নাম ইসমাঈল। বোখারার অধিবাসী ছিলেন বলে আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ বোখারী নামেই তিনি ইতিহাসে খ্যাত। তাঁর বংশ পরিচিতি; মোহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম ইবনে মুগীরা ইবনে বরদাজবে। তিনি পারস্য বংশোদ্ভূত মজুসী বা অগ্নি উপাসক ছিলেন। বরদাজবের পুত্র মুগীরা বোখারার শাসনকর্তা ইয়ামান জুফীর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইমাম বোখারীর পিতা ইসমাঈল হজরত ইমাম মালেকের শাগরিদ ছিলেন। তিনি হাম্মাদ ইবনে জায়দ ও ইবনুল মোবারকের কাছ থেকেও হাদীস শ্রবণ করেন।
বর্ণিত আছে যে, শৈশবে ইমাম ‘নাবীনা’ অর্থাৎ অন্ধ ছিলেন। তাঁর মায়ের দোয়ায় আল্লাহ তাকে দৃষ্টিশক্তি দান করেন। শৈশবেই তিনি পিতাকে হারান, মা তার লালন পালন করেন। প্রথম দিকে তিনি অর্থশালী ছিলেন। পৈত্রিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সমস্ত সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেন। ইমাম বোখারীর (রহ.) মধ্যে হাদীস হিফজ করার আগ্রহ দশ বছর বয়স হতেই শুরু হয়ে যায়। জন্মগতভাবে তিনি ছিলেন অসাধারণ ধীশক্তির অধিকারী। খোদা প্রদত্ত এ মেধা-প্রতিভা খুব কম লোকেরই ভাগ্যে আসে, দুনিয়ার ইতিহাসে এটি একটি বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁর ছয় লাখ সহীহ হাদীস সনদসহ মুখস্থ ছিল। তিনি এসব হাদীস সংগ্রহের জন্য হেজাজ, ইরাক, ইয়েমেন, খোরাসান, মিশর, সিরিয়া প্রভৃতি শহরে-গ্রামে-গঞ্জে, পাহাড়ে, জঙ্গলে এবং যেখানেই জানা গেছে যে, কোন বুজর্গের নিকট হাদীস আছে, তাদের কাছ থেকে সেগুলো সংগ্রহ করার জন্য হাজার হাজার মাইল পদব্রজে সফর করেছেন। আরবের ভীষণ গরমে তাকে এসব দূরবর্তী স্থান ও দুর্গম এলাকা সফর করতে হয়েছে। কথিত আছে যে, এসব স্থান সফরকালে কোন কোন সময় তাঁর প্রসাব রক্ত আকারে বের হতো, কিন্তু তিনি তা পরোয়া করতেন না, হাদীস সংগ্রহের নেশায় তিনি বিভোর ছিলেন। এ অবস্থায় তিনি ছয় লাখ হাদীস সংগ্রহ করেন এবং মুখস্থ হয়ে যায়।
১৬ বছর বয়সে ইমাম বোখারী (রহ.) ইমাম অকী ও ইবনুল মোবারকের কিতাব মুখস্থ করে ফেলেন। অতঃপর মায়ের সঙ্গে হজের জন্য গমন করেন এবং হেজাজে শিক্ষা লাভ করেন এবং সেখানে ৬ বছর অবস্থানের পর প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর হাদীস সংকলনে আত্মনিয়োগ করার ঘটনানাটিও বিস্ময়কর। ৬ লাখ হাদীসের জখীরা ছিল তাঁর সামনে এবং ১৬ বছর সময়ের মধ্যে হাদীস সংকলনের কাজ সমাপ্ত করেন। এ সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি কখনো মদীনার মসজিদে নববীতে বসে এবং কখনো খানা-ই-কাবায় বসে হাদীস সংকলন করতেন এবং এ কাজে তিনি অত্যন্ত সতর্কনীতি অনুসরণ করেন। এ সম্পর্কে সীরাত লেখক ও মোহাদ্দেসীন লিখেছেন যে, প্রত্যেক হাদীস লিপিবদ্ধ করার পূর্বে ইমাম বোখারী গোসল করতেন, দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তেন, ইস্তেখারা করতেন এবং সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পর হাদীস লিপিবদ্ধ করতেন। এভাবে তিনি কিতাব সম্পূর্ণ করেন।
আল্লামা খতীব বাগদাদী তাঁর বিখ্যাত ‘তারিখে বাগদাদে’ ইমাম বোখারী (রহ.) এর অসাধারণ মেধা-প্রতিভা এবং ইমাম বোখারী (রহ.) বিদ্বেষী এক শ্রেণীর আলেমের জালিয়াতির এক অদ্ভুত কাহিনী লিখেছেন। যা সংক্ষেপে এই যে, যখন তিনি বাগদাদে গমন করেন তখন ‘সাজেশী উলামা’ দলের লোকেরা তাঁর পরীক্ষা নেওয়ার জন্য একটি সূ² কৌশল অবলম্বন করেন। তাদের মধ্যে দশ জন দশটি হাদীস গলদ মুখস্থ করে বিভিন্ন সময় ইমাম বোখারীর (রহ.) সামনে পাঠ করেন। ইমাম সাহেব পঠিত সবকটি হাদীস বিকৃত হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর সনদ সহকারে প্রত্যেকটি ‘রেওয়ায়েত’ (বর্ণনা) মূল মতন (এবারত) সহ পেশ করেন, যাতে তাঁর বিরুদ্ধবাদীরাও অবাক ও বিস্মিত হয়ে যায়।
অত্যন্ত সতর্ক ও গুরুত্ব সহকারে ইমাম সাহেব কর্তৃক লিপিবদ্ধ করা হাদীসগুলোর সংখ্যা চার হাজারের কিছু বেশি, যা সংক্ষেপে ‘বোখারী শরীফ’ নামে বিশ^খ্যাত। তিনি সমকালীন এক হাজার আশি জন মোহাদ্দেসীরনের কাছ থেকে হাদীস শ্রবণ করেন। খোদ তাঁর কাছ থেকে এক লাখ লোক হাদীস শ্রবণ করেন। আগেই বলা হয়েছে যে, ইমাম বোখারীর (রহ.) ছয় লাখ হাদীস মুখস্থ ছিল এবং এ ছয় লাখ হাদীসের জখীরা সামনে রেখে হাদীস সংকলন শুরু করেছিলেন। কিতাব সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি তা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইবনে মুঈন এবং ইবনুল মাদিনীর সামনে পেশ করেন এবং তাঁরা সবাই প্রশংসা করেন এবং বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ঐক্যমত পোষণ করেন, তবে চারটি হাদীস নিয়ে বিতর্ক থাকে। ইবনে হাজার বলেন, বিতর্কিত এ হাদীসও সত্য।
সে যুগের মোহাদ্দেসীনে কেরাম সর্বসম্মতভাবে বলেছেন যে, ‘আছাহ হুল কুতুবে বাদা কিতাবিল্লাহি আছ ছাহীহুল বোখারী’। অর্থাৎ কোরআন হাকীমের পর বিশুদ্ধতম কিতাব সহীহ বোখারী। সহীহ বলতে কেবল লিখিত আকারে সহীহ বা বিশুদ্ধতম নয়, এ কিতাবের ভাব-ভঙ্গি ও সাহিত্যের দিক থেকেও অতি উত্তম, আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী। বিখ্যাত বৈয়াকরণ আল্লামা রাজি (৬৮৬) বলেন; ‘খাটি আরবী জানতে হলে কোরআন, অতঃপর সহীহ বোখারী এবং হেদায়া পড়তে হবে।’ এ স্বীকৃতি সত্য ও বাস্তবতার স্বীকৃতি। বস্তুত সকল দিক বিবেচনায় সহীহ বোখারী এক শ্রেষ্ঠ কীর্তি। কোরআন এর ব্যাখ্যা গ্রন্থগুলোর পর সর্বাধিক ব্যাখ্যা গ্রন্থ রচিত হয়েছে এবং অহরহ হচ্ছে বোখারী শরীফের। হাদীস শাস্ত্রে ‘আমীরুল মোমেনীন’ সহ আরও বহু উপাধিতে ভ‚ষিত এ মহান হাদীস বিশারদের শেষ জীবনে নিজের দেশেই নানা বিপদ ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। ‘খালকে কোরআন’ অর্থাৎ কোরআন ‘কাদীম’ এ না ‘হাদেস’ এ বিষয়ে ইমাম সাহেবের মত ছিল কোরআন ‘কাদীম’ অর্থাৎ সৃষ্ট নয়, আদি। এ বিষয়ে ইমাম জুহলীর সাথে তাঁর মত বিরোধ দেখা দেয় এবং তিনি ইমাম সাহেব সম্পর্কে শাসকের কান ভারি করেন বলেও অভিযোগ আছে। অতঃপর বোখারার শাসকের সাথে তাঁর মন কষাকষি হয়। বোখারার শাসক ইমামকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। ইমাম সাহেব সেখান হতে সমরখন্দ চলে যান। সেখানে তিনি আল্লাহর দরবারে যে প্রার্থনা করেন তা এবং ঈদ রজনিতে তাঁর ইন্তেকাল হওয়ার কথা নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।