স্বতন্ত্র উৎসব ঈদ
এল ঈদুল ফিতর, এল ঈদ ঈদ ঈদসারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল নাক’ নিদ। হ্যাঁ, সুদীর্ঘ
বিন্দুর কখনোই পছন্দ ছিল না তমালকে। ওকে দেখলেই বিন্দুর মনে হতো- গরম পানিতে সেদ্ধ এক টুকরো সেকসেকে মাছ। এত ফর্সা পুরুষ মানুষ!
তার ওপরে আবার গো-বেচারা। সাদামাটা তার অবয়ব। আকর্ষণ করার মতো কী আছে? ঐ সাদা রঙ! বিন্দু দুষ্টুমি করে নাম দিয়েছে মাকাল ফল। এই ফর্সা রঙ আকর্ষণ করেছে বিন্দুর বান্ধবী আলোকে। আলোর নিজের গায়ের রঙ নিয়ে চাপা একটা দুঃখ আছে, তা থেকেই জন্ম নিয়েছে এই ভালোবাসার। আলো নিজেকে নিজেই বলে- কানা মেয়ের নাম পদ্মলোচন, আমার মতো কালো মেয়ের নাম রেখেছে আলো- এই আর কি! বিন্দু বলেছে- তাতে কী এসে যায়? এখন তো প্লাসে-মাইনাসে মাইনাস হয়ে গেল।
আলো- তার মানে কী?
বিন্দু- বুঝলি না? মানে হলো তোর কালো রঙ, আর তমালের ফর্সা রঙ। মাইনাস প্লাসে মাইনাস হয়ে গেল তোর কালো রঙ।
তমারের মাঝে নতুন আলোর জন্ম হলো।
আলোকে বিয়ের পরে তমাল জেনেছে বিন্দুর এই সব উপহাসের কাহন। তমাল বলেছে- দেখব তোমার বান্ধবীটি কেমন পাত্র জোগাড় করে! মাকাল ফল না কি নিম ফল।
বিয়ের পরে আলো প্রাইভেট কলেজে চাকরি নিয়েছে। তমালের ব্যবসা চলে ধীর-গতিতে। এরই মাঝে পিঠাটিঠি দুটো কন্যা সন্তানের জননী হয়েছে আলো। চাঁদের মতো ফুটফুটে। নাম দিয়েছে কাজল ছোট্টটির আঁখি। আহ্লাদের বা আনন্দের বাড়াবাড়ি ছিল না। আহামরি কিছু উত্থান-পতনও নেই এই চলার পথে। আলো বাড়িতে দু’চারজন ছাত্রী পড়ায়। আরো একটু সচ্ছলতার জন্য কাজল-আঁখিও বড় হয়ে উঠছে, ওদেরও চাহিদা বাড়ছে। অর্থের টানাপোড়েনে একেবারে হিমশিম। যদিও আলো-তমাল ওরা দু’জনই তেমন উচ্চাভিলাষী নয়। যতটুকু করতে পেরেছে তাতেই তুষ্ট। চলে যায় নিত্যদিনের এই পান্থশালায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মাঝে হিসেবের টাকা যেন পরাজিত সৈনিক। তবুও আর কি খুঁড়িয়ে চলা যাকে বলে।
বিন্দুর বিয়ে হয়েছে ভীষণ ধূমধাম করে। ভরা ভরা একটি সুন্দর পরিবারে। বিন্দুর মধ্যে যেমন আছে রোমান্টিকতা তেমন আছে জীবনকে নাচিয়ে বেড়ানোর সদিচ্ছা। বিবাহিত জীবনের রূপ, রস, রঙ ছিল ওদের মনে কানায় কানায় পূর্ণ। বিন্দু যেমনটি চেয়েছে বিধাতা অকৃপণ হাতে ঢেলে দিয়েছেন। রিয়াজ নামের পাত্রটি ওর স্বামী। ওরই মনের মতো। ওরই স্বপ্নের সুপুরুষ। মনের ছাঁচে ঢেলে সাজিয়ে নিয়েছে তাকে। দিনগুধেলা কেটে যায় রূপালি জ্যোৎস্নায় হেসে-খেলে। কখনও মালয়েশিয়া কখনো সিঙ্গাপুর। এভাবেই জীবনের প্রথম দিনগুলো মধুচন্দ্রিমায় পার করেছে। কোথায়ও কোনো কার্পণ্যের ছোঁয়া ছিল না। একেবারে বিলাসী জীবন যাকে বলে। রিয়াজ বিন্দুকে গাড়ি ড্রাইভিং শিখিয়েছে। কখনও শখ করে কখনও প্রয়োজনে অবশ্যই চালাতে পারবে। প্রায়ই ওরা বেরিয়ে পড়ে লং ড্রাইভে। রিয়াজ ভালো চালক। সে-ই চালিয়ে নিয়ে যায়। এই সব মুহূর্তে ড্রাইভার সাথে থাকা পছন্দ না। তাই দু’জনে দু’জনার সঙ্গী।
কখনও আশুলিয়া, কখনও যমুনা ব্রিজের আগেই একটা সুন্দর রিসোর্ট আছে এ পর্যন্ত। ওদের দু’জনের মধ্যে অনেক ব্যাপারেই ভীষণ মিল। একই সাথে নেচে ওঠে মন। বৃষ্টি ভেজা রাতে আকাশে মেঘ বালিকার ডাকে বিন্দু থেকে বিভাস হয় রিয়াজের সান্নিধ্যে। দোতলা বাড়ির ছাদে গিয়ে বর্ষায় স্নাত হতে চায়। জলকেলিতে ওরা উর্বশী। রিয়াজের মন দোলে বৃষ্টিতে, ঘাসের ডগায় শিশিরের স্পর্শে, জ্যোৎস্না রাতে রুপালি চাঁদের আলো অবগাহনে, রবি ঠাকুর আর নজরুলের গানের মাঝে ডুব দিতে। ভালোবাসা-ভালোলাগার এইভাবেই জীবনের কিছুটা সময় বেহিসাবে কাটিয়ে দেয় ওরা। অলস সময়ের লম্বা রাস্তা পারপার শেষে কাজের ব্যস্ত সময় হিসাব করতে হয় পাই পাই করে।
রিয়াজও চায় বিন্দু তার অফিসে বসে কিছুটা সময় ব্যস্ত হয়ে উঠুক। রিয়াজকে প্রায়ই বিদেশে এবং দেশেও বিভিন্ন জেলায় যেতে হয় ব্যবসায়ের কাজে। বিন্দু তখন সামলে নেয় অফিস আর ব্যবসা। গড়িয়ে যায় অনেকটা সময়। সুখ আর বিত্তের মাঝে পাঁচটি বছর কীভাবে কেটে যায় হিসাব মেলাতে পারে না বিন্দু। সুখের সময়গুলো খুব তাড়াতাড়ি পার হয়।
আজ হিসাব মিলাতে হিমশিম। মনের কোণে জন্মে নিয়েছে একটি দুঃখবোধ। কী করবে আর কী করা যায়। চেষ্টা তো অনেকেই করেছে একটি সন্তানের জন্য। এত প্রাচুর্যের মধ্যে ‘নেই’ শব্দের হাহাকার বিন্দুকে পোড়ায়। ডাক্তার দেখিয়েছে দু’জনই। বিন্দুর পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে রিয়াজ। যত রকম চেষ্টা সবই করেছে। জেনেছে বিন্দুর সমস্যা, রিয়াজের নয়। সমস্যা বিন্দুতেই। বিন্দু সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। ওর অক্ষমতা ওকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। ঘুম কেড়ে নেয় রাতের, সুখ কেড়ে নেয় জীবনের। দুঃখের কালো ছায়া ওকে স্থবির করে দেয়। বিন্দু রিয়াজকে বলেছে, তুমি বিয়ে করো। বউ নিয়ে অন্য বাসায় থাকো। আমি দুঃখ পাব না বিশ্বাস করো। তোমার বংশ রক্ষার প্রয়োজন আছে। দেখে নিও আমি কষ্ট পাব না। আমি তো এতটা স্বার্থপর হতে পারি না।
রিয়াজ বিন্দুর ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে ধরে বলেছে। যথেষ্ট হয়েছে। আর নয় এসব কথা।
আমরা দু’টিতেই করব স্বর্গ রচনা। সন্তান হতেই হবে! একা কি ম্যান্ডেটারি? যদি এমন হতো সমস্যাটি তোমার নয় আমার, তবে কি তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারতে? তবে কেন উঠছে এই সব কথা?
বিন্দু রিয়াজের বুকের কাছে। আরো কাছে টানে রিয়াজ বিন্দুকে। জড়িয়ে ধরে আদর করে চোখ মুছে দেয়। পর প্রশস্ত বুকে মুখ রেখে আরো কাঁদে বিন্দু।
রিয়াজ বলে, আমার ভাইদের যতগুলো ছেলে-মেয়ে আছে আজ থেকে ওরাই আমাদের। তবুও বিন্দুর মনে হয় স্বপ্নের মতো বোনা সংসারটিতে এমনভাবে স্বপ্নভঙ্গ কেন হলো!
বিন্দু ওর বুকে মুখ রেখেই বলে- তোমার জন্যই আমার কষ্ট। আমার কারণে বাবা হতে পারলে না। নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হয়।
-আর কথা নয়। চুপ চুপ চুপ...চুপ। আর একটি শব্দও নয় এই প্রসঙ্গে। অন্য প্রসঙ্গ টানে রিয়াজ- মনে আছে তো রাতে লায়ন্স-এর ডিনার আছে। কী পরবে আজ?
তোমার সেই আকাশ রঙের শাড়িতে হাজার রুপোলি তারার ঝলক। ঐ শাড়িটাই পরবে। ঐ শাড়িতে তোমাকে জ্যোৎস্না মেয়ের মতো লাগবে। ওগো আমার জ্যোৎস্না মেয়ে রেডি থেকো। এই বলে রিয়াজ বেরিয়ে পড়ে অফিসের কাজে। চোখে জলের রেখা, মুখে ম্লান হাসিতে হাজার তারার ভালোবাসার ঝলক। রিয়াজের এত ভালোবাসা ওকে ভুলিয়ে দিতে চায়- ছোট্ট মনের বিশাল দুঃখটাকে।
এই ঝড় কি রিয়াজের মনের আর্শিতে লাগেনি? তবুও সব সময় নিজেকে বিষণœতার জ্বরে ভোগাতে রাজি নয়। মনকে বুঝিয়েছে সব চাওয়া সব পাওয়াই কি মানুষ এক জনমে পায়? হয়তো পরের জনমে পাবে দশ দশটা ছেলে-মেয়ে। হয়তোবা পেয়েই গিয়েছিল অতীতের জনমে দশ দশটা ছেলে-মেয়ে। ওর কাছে মনে হয় ক্ষণস্থায়ী জীবনে একজন ভালো সঙ্গী পাওয়াটাই বড় পাওয়া। আল্লাহ্তালার হাজার রহমত। তিনি নীরবে বসে সব কিছুই ব্যালেন্স করেন।
কেউ অনেক অর্থবিত্তের মাঝে সন্তানদের প্রোপার এডুকেশন দিতে পারে না। আবার বিত্তহীন সংসারে আলোকবর্তিকার জন্ম হয়। এক্সেপশন তো আছেই। বিন্দুর ভালোবাসার পরশে রিয়াজ ঝেড়ে ফেলে দুঃখের খড়কুটো। বিন্দুকে বুঝিয়েছে রিয়াজ- আল্লাহ্তায়ালাহ্ তার প্রিয় বান্দাকে দুঃখ-কষ্টে ফেলে ইমানের পরীক্ষা করেন। আমাদের প্রিয় নবীর কথাই ধরো না কেন। কতটা দুঃখ-কষ্টের মধ্যে তাঁর দিন পার করতে হয়েছে। তিনি কি পারতেন না নবীজীর মুশকিল আসান করতে? এই চরম সত্যকে আমাদের মানতেই হবে।
বিন্দু বোঝার চেষ্টা করেছে ঠিকই তবুও মন তো থাকে ঠায় দাঁড়িয়ে নীরবে নিজের বলয়ে একটি বস্তুকে কেন্দ্র করে। নিজেকে নিয়ে এমনই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে বিন্দু, অন্যের খবর রাখার সময় জোটেনি।
এরই মধ্যে খবর এলো, আলো অসুস্থ। তার দুটো কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে। ডায়ালাইসিস করতে হবে। প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। বন্ধুটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। অভিমানিনী আলো চায় না ঋণে আবদ্ধ জীবন। বিত্তহী অসচ্ছলভাবে জীবন সংসার সমুদ্র যা হোক পাড়ি দিয়েই চলেছে কোনো না কোনোভাবে। এই রাজরোগের মুখোমুখি দাঁড়াতে ভীষণই কষ্ট। আগের দিন যক্ষাকে রাজরোগ বলা হতো। এ রোগ হলে অর্থবিত্ত সবই শেষ হতো। মানুষকে বাঁচানো কষ্টসাধ্য ছিল। আজ বিজ্ঞানের অবদানে সহজ এর চিকিৎসা। ছয় মাস ওষুধ খেলেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু কিডনি রোগকেই বলতে হবে রাজরোগ। বিত্তবানও ফকির হয়ে যায়। কিডনি ট্র্যানসপ্লান্ট-এর সমস্যা, অর্থের বিনাশ তো আছেই। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন অর্থের ওপর দিয়ে জীবনের চাকা চালিয়ে যেতে হবে। সেই সামর্থ্য আলো-তমালদের নেই।
বিন্দু সাহায্য করেছে প্রতি সপ্তাহে ডায়ালাইসিস-এর খরচা। বলেছে কিডনি ম্যাচ মতো পাওয়া গেলে ট্র্যানসপ্লান্ট-এর খরচও বহন করবে। মানতে পারেনি আলো। আত্মসচেতন আলো নিজের মধ্যে নিজেই অহংকারী আত্মনির্ভরশীল এক আত্মা। দেয়নি সায়।
অভিমান নিজের প্রতি, অভিমান জীবনের প্রতি, অভিমান বিধাতার প্রতি, অভিমান নিজের অক্ষমতার প্রতি। পুরো একটা বছর এভাবেই পার করেছে। কাজল-আঁখি মায়ের সেবায় লেখাপড়ার ক্ষতিটুকু স্বীকার করেছে। তমালের বিষণ্ণ নয়ন ওকে পীড়িত করেছে। আত্মহত্যা মহাপাপ তাই আর ঐ কাজ নয়। সবাইকে বাঁচিয়ে দবোর চেষ্টায় সবার অলক্ষ্যেই হোমিও প্যাথিক করেছে। যদি এভাবে কিছুদিন ভালো থাকা যায়।
সবার জন্য শ্রেয়। অর্থ সমস্যা দূর হবে। ঋণদায়গ্রস্ত জীবন তার কাম্য নয়। আলো বেঁচে থাকার ইচ্ছাশক্তি মরে গেছে। কী নিয়ে যুদ্ধ করবে?
নিজের হাতে তো গোলাবারুদ নেই। ধার করা সম্পদে পথ চলবে না আর। সবাইকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে এই বাঁধন থেকে। এভাবে ডায়ালাইসিস করে একটি বছর অর্থ জলের মতো শেষ হয়ে গেছে। ক্যান্সারের যেমন নির্দিষ্ট সময় আছে, কিডনি সমস্যার কোনো সময়সীমা নেই। গড়িয়ে গড়িয়ে অনেক সময় ক্ষত-বিক্ষত করে দেবে একটা সন্দুর সংসারকে। বিন্দু প্রায় দুই সপ্তাহ ডায়ালাইসিস বন্ধ রেখেছে। তমারের অনুরোধেও রাজি হয়নি। আলো ভেবেছে আর অর্থের অপচয় করবে না। দুটো মেয়ের জন্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল একটি বছরে তা প্রায় শেষ। এরই মধ্যে হঠাৎই একদিন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে আলো। হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। প্রচুর পানি জমে গেছে শরীরের পরতে পরতে। ডাক্তাররাও উৎকণ্ঠায় সময় গুনে। প্রেসার ধীরে ধীরে লো হতে আরম্ভ করল। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য।
পানি, প্রচুর পানি বের করা হলো। আস্তে আস্তে আলো ডিপ স্লিপে চলে গেল। কাউকে আর কষ্ট দিতে হবে না। চোখের সামনে থেকে এত দ্রুত একটি মানুষ চলে গেল।
কাজল-আঁখির ক্লান্ত-অসহায় চোখ দুটো খোঁজে মাকে। কার্পণ্যহীনভাবে খেটেছে ওরা মায়ের জন্য। এভাবেই সারা জীবন সেবা দিয়ে তুলে রাখতো পুরোজর বেদিতে। তবুও থাকত মা সামনে। আন্টিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। মা বেঁচে থাকত একটি মানুষ প্রতিনিয়ত তাকে দর্পণ জেনে দু’চোখ জুড়াত। আর তো হবে না দেখা। শুধু স্মৃতি করবে আনাগোনা। স্পর্শের মধুরতা হারিয়ে গেছে। আঁকড়ে ধরে বিন্দু আন্টিকে কাজল আর আঁখি। মায়ের বান্ধবী- মায়ের ছোঁয়া লেগে আছে ঐ শরীরে। মায়ের গন্ধ লেগে আছে ঐ আঁচলে। ঘিরে থাকে নিত্যদিন বিন্দুকে কাজল আর আঁখি। আর বিন্দুও পেয়েছে দুটো সন্তানকে কাছে।
প্রায়ই আসা-যাওয়া। ওদের সান্নিধ্য ভালোবাসার আবেশে জড়িয়ে থাকে বিন্দু। ভীষণ মায়া পড়ে যায় দুটো মেয়ের ওপর। ওরা দুটি লেখাপড়া নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। বাবার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় কম। তবুও দেখেছে বাবা কেমন নিস্তেজ নীরস হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। কর্মস্পৃহা একেবারে কমে গেছে। জীবনকে আরো গুটিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি। মনে হয় দটো মেয়ের জন্যও কোনো চিন্তা নেই। বেঁচে থাকার আশা নেই। আলোর মধ্যে তমালের হৃদয়ে অনুভূতি বৃত্তাবদ্ধ ছিল। বাবার এই উদাসীনতা কাজল-আঁখির মনে অস্থিরতার জন্ম দেয়। কাজল লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে একটা চাকরিও জোগাড় করে ফেলে, যেন কিছু চাইতে না হয় বাবার কাছে। দুটো বোনের অনেক কিছুই প্রয়োজন, যা মাকে বলা যেত। বাবাকে বলা যায় না।
বুঝিয়েছে বিন্দু তমাল ভাইকে। দুটো মেয়ের কথা। মনের এই উদাসীনতা ঝেড়ে ফেলতে। আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে কাজল-আঁখিকে নিয়ে। হতাশাগ্রস্ত মানুষটি আরো হতাশার দিকে ছুটে গেছে। তমালের শুধু মনে পড়ে আলোকে। সংসারে কখন অর্থ দরকার, মেয়েদের কী প্রয়োজন সবই যোগান দিয়েছে আলো। কোনো মাসে বেশি কোনো মাসে কম, কোনো মাসে একেবারেই নেই টাকাকড়ি তমালের হাতে। তবুও চলেছে সংসার। আলো ছাড়া এ জীবন তমালের অর্থহীন মনে হয়। ওকে ছাড়া পথ চলা অসম্ভব। আজকাল ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। সারাদিন বাসায় বসেই দিন কাটায়। নিজেতে নিজেই আত্মস্থ থাকে। বাবার সাথে কাজল-আঁখিরও বেশি কথা হয় না। ওরাও ভাবে বাবা মায়ের মৃত্যুশোক ভুলতে পারছে না। মনোপীড়া ওদেরও কম কি, তবুও জীবনে ব্যস্ততায় অনেক কিছুই কিছুটা সময় ভুলে থাকা যায়। নতুবা মানুষ বাঁচত না। বাবার অর্থহীন বোবা দৃষ্টি ওদের অসাড় করে দেয়। ভেবে পায় না কী করবে। লেখাপড়ার চাপ, তার ওপরে চাকরি- দু’টিতে একসাথে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। এমনিভাবেই চলছে ওদের জীবনযাত্রার চাকা।
সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে কাজল-আঁখি। ঘরে সাঁঝবাতি নেই। বাবা-বাবা কোথায় তুমি, বলে বেডরুমে পা বাড়িয়ে লাইটের সুইচ অন করে কাজল। দেখে বাবা বিছানায়। কাছে যায় কাজল-আঁখি। বাবা এখন ঘুমিয়ে। জ্বর-টর হলো নাকি! আঁখি গায়ে হাত দিয়ে ডাকছে, বাবা ওঠো, বাবা ওঠো, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কাজল আবার গায়ে হাত দিয়ে শিউরে ওঠে। কোথায় বাবার জ্বর? হাত-পা তো একেবারে ঠান্ডা হয়ে আছে। একেবারে সাড়াশব্দ নেই। ওদের কান্না আরো দ্বিগুণ হলো। চিৎকারজুড়ে দিলো। বাবা ওঠো, বাবা ওঠো। কী হয়েছে বাবার? বুদ্ধি করে বিন্দু আন্টিকে ফোন করল কাজল। আঁখি ডাক্তার আনতে ছুটল। মনের মধ্যে অশনি সংকেত। বুকটা দুরুদুর করছে। বিন্দুও অতি দ্রুত ছুটে এলো। ডাক্তার এলো। না নেই, সব শেষ। তমাল অভিমান করে চলে গেছে। কী এত অভিমান ছিল! আলোকে ছাড়া কি পথ চলা যাচ্ছিল না? এই মেয়ে দুটো কী পথের সাথী হতে পারত না? ‘কাপুরুষ’ শব্দটি বিন্দুর মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে। বিন্দুকেও তো বলতে পারত ওর অক্ষমতার কথা। এভাবে আত্মহত্যা? মেয়ে দুটির জন্য একটু চিন্তা হলো না! কাজল-আঁখির কান্নার রোল বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। তমালের হাতের মুঠো থেকে একটা চিরকুট পাওয়া গেল। বিন্দুকে উদ্দেশ্য, করেই লেখা। বিন্দু খুলে পড়তে লাগল চিঠিটি-
হেরে গেছি বিন্দু, আমি হেরে গেছি জীবনের খেলায় তোমাদের কাছে। তমাল ভাই সত্যি একটা মাকাল ফল, কিছুই করতে পারল না। আলোকে বাঁচাতেও পারল না। ভবিষ্যতে কাজল আর আঁখিকে বাঁচাতে পারবে না। তাই আমার এই পালিয়ে যাওয়া। আলো আমাকে আগলে রেখেছিল একটি শিশুর মতো। কোনো চাপ সহ্য করতে দেয়নি। কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। আমার মেয়ে দুটো তোমার। ওরা আজ থেকে তোমার। তোমার আশায় তোমার ওপর ভরসা করে পালিয়ে গেলাম। ক্ষমা করো। বিন্দুর বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়। কান্নাসিক্ত কণ্ঠে বলে, কাজল-আঁখি মা আমার, তোমাদের বাবা কী পাগলামিটাই করল। পড়ো, বাবার চিঠিটা পড়ো। দু’বোন বাবার চিঠি পড়ে চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসা অক্ষরগুলো, আরো কাঁদায়। বাবাকে বুঝতে না পারার অক্ষমতায় কষ্ট আরো দ্বিগুণ হয়।
বিন্দুর কোলের কাছে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। এক পর্যায়ে কান্নার বাঁধ ভেঙে যায়। আন্টি, আমরা একেবারে এতিম হয়ে গেলাম। মায়ের মৃত্যুর দু’মাস যেতে না যেতেই বাবাকে হারালাম। ওহ্ কী দুঃসহ জ্বালা! আমাদের কী দোষ ছিল আন্টি! আমাদের বাবা-মা সবাই এভাবে চলে গেলেন। ওদের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে যায়। বিন্দু আন্টিও ভাষা খুঁজে পায় না। কী বলে বোঝাবে ওদের! বলবে কি সেই সনাতন প্রথাগত কথা- বাবা-মা সবারই চিরদিন বেঁচে থাকে না ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই সান্ত¡নার ভাষা বিন্দুর বলতে আর ইচ্ছে করলো না। ওদের দু’জনকে জড়িয়ে নিজেও সমব্যথী হলো। স্পর্শের অনুভবে কথা হয় বিশ্বাসের গূঢ় বিস্তারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।