Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চন্দনপুরের রাজা

ফরিদা হোসেন | প্রকাশের সময় : ১২ মে, ২০২১, ১২:০২ এএম

শেষ পর্যন্ত হার মানলো জাহিদ।
জাহিদ হাসান ভদ্রলোকের পুরো নাম। হার মানলো মফস্বল শহর চন্দনপুরের একপাশে গোল্লায় যাওয়া ছেলের কাছে।

ছেলেগুলো মুদী, গয়লা আর ঠিকাদারের ঘরের।
সন্ধ্যে সাতটা থেকে রাত প্রায় ন’টা পর্যন্ত তেতলা বাড়ির রোয়াকে বসে ওরা চাঁটি মেরে কোরাস গায়।
তেতলা বাড়িতে বারণ করবার কেউ নেই অনেক দিন থেকে। বাড়াবাড়ি দেখলে আশেপাশের বুডোরা ধমকে ওঠেন মাঝে মাঝে।

কিন্তু বড় একটা কেয়ার করে না ছেলেগুলো। বকুনী খেয়ে উপস্থিত পঙ্গপালের ঝাঁকের মতোছুটে পালায় বটে। কিন্তু একটু পরেই আবার সেই রোয়াকে ওদের আসর জমে উঠে।
তেতলা বাড়ির দু’পাশে দু’টো দোতলা বাড়ি। একটা চৌধুরী ভিলা। অন্যটার নাম নেই।
চন্দনপুরের এই বাড়ি তিনটি চোখে পড়ে সবার।
চোখে পড়ে এজন্যে যে, তেতলা বাড়িটা যেন দোতলা বাড়ি দু’টোর কেন্দ্র।
গোল্লায় যাওয়া ছেলেগুলোর বই-এর সাথে সম্পর্ক না থাকলেও রূপকথার রাজ্যে নিশ্চয়ই ওদের বিচরণ আছে।
নইলে বাড়ি তিনটেকে নিয়ে ওরা অতো সুন্দর ছড়া কাটবে কেন?

ওরা বলে-
দুই পাশে দুই রাণী মধ্যিখানে রাজা,
মান করেছে রাজা সাহেব খায় না তাই খাজা।
ছেলেগুলো তেতলা বাড়ির নাম দিয়েছে-
রাজ বাড়ি।
একপাশে সুয়োরাণী, অন্যপাশে দুয়োরানী।
ওদের জগৎ ওরাই গড়েছে চন্দনপুরের মাটিতে।
হাত ঘরে, চোখে আঙ্গুল দিয়ে, কেউ এদের পথ চলতে শেখায় নি।

বাপ-চাচারা ভোর না হতেই নিজেদের ধান্দায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর গলির মোড়ে চুলোর ধোঁয়া আর ঝাডুদারের রাস্তার ধূলোয় চোখ কচলাতে কচলাতে কৈশোর পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে ছেলেগুলো। এবং সবাই এদের নাম দিয়েছে-
বখাটে। গোল্লায় যাওয়া। তাতে অবশ্যই কিছু এসে যায় না ওদের।
বড় বেশি বেপরোয়া যেন ছেলেগুলো-বুনো কাশফুলের মতো।

একদিন ছেলেগুলো সুর করে গান ধরলো-
রাজবাড়ির বে’হবে।
পাড়ার বুড়োরা সজাগ হলেন। প্রশ্ন করলেন-
: বে’হবে কেন রে, হতচ্ছাড়ার দল? ওকি মানুষ?
উত্তর এলো-
: হবে হবে। বে’হবে। দেখছো না রাজবাড়ি সাজতে লেগেছে!
সবাই দেখলো। সত্যিই তো। তেতলা বাড়িতে রাজমিস্ত্রী লেগেছে। লেগেছে কাঠমিস্ত্রী।
পাড়ার লোকের কৌতুহলের শেষ নেই। সেই কবে থেকে খালি পড়ে আছে বাড়িটা। কেউ কেউ বলে অপয়া বাড়ি। দেয়ালের চলটা উঠে, দরজা-জানালায় শ্যাওলা পড়ে, যেন পোড়া বাড়ি হয়ে ছিল বহুদিন থেকে।
কিন্তু আজ হঠাৎ মেরামতের কাজ আরম্ভ হওয়াতে চোখ পড়লো সবার। ডানপিটে ছেলেগুলোর ভাব দেখে মনে হয়, যেন ওরা সব জানে। শেষ পর্যন্ত ওদের কথাই সত্যি হলো। তেতলা বাড়িতে নতুন রং লাগলো। দরজা জানালায় ঝুললো রঙ্গিন ভারী পর্দা। ডানপিটে কাওয়ালী গাওয়া ছেলেগুলো যেন একটু অবাক হলো।

দেখতে দেখতে ভোল পাল্টে গেল বাড়িটার।
কিন্তু কেন?
আর কার জন্যে?
আজ আর তেতলা বাড়ির রোয়াকে ঠাঁই হলো না।
গোঁফ পাকানো একটা দারোয়ান বসে আছে লাঠি হাতে।
আর তেতলার বারান্দায়। মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে, পাঞ্জাবী গায়ে, মুখে সিগারেট-খবরের কাগজ হাতে-কে ও? দলের একজন চেঁচিয়ে ওঠলো-
: রাজা সাহেব ।
: রাজা সাহেব!
বিস্মিত কণ্ঠ আর দৃষ্টি ছেলেদের।
সত্যি-ই!
রাজ বাড়ির রাজা সাহেবই বটে! যেন রূপকথার রাজপুত্তুর।
সেদিনই দস্যি ছেলেগুলো চন্দনপুরের আকাশ বাতাস ভরিয়ে তুললো নতুন সুরে-নতুন গানে। ওরা জানিয়ে দিল, রাজবাড়িতে রাজা সাহেব এসেছে।

কথাটা ছড়িয়ে পড়লো চন্দনপুরের সর্বত্র।
পাড়ার সবাই দেখলো রূপকথার রাজা সাহেবকে।
সকালে আকাশ নীল গাড়িতে চলে যায়। ফেরে বিকেলে।
ডানপিটে ছেলেগুলো আগের মতো তেতলা বাড়ির রোয়াকে তালি বাজিয়ে কোরাস গাইবার সুযোগ পায় না সত্যি। কিন্তু এজন্যে তারা মোটেও দুঃখিত নয়। সকাল-বিকেল ওরা গলির মুখে দাঁড়িয়ে দেখে ওদের রূপকথার রাজা সাহেবকে।
একদিন সকালে জাহিদ ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলো তার গাড়িটার চারপাশে ভীড় করেছে গোল্লায় যাওয়া ছেলেগুলো। ওদের নোংরা হাত দিয়ে ধরে ধরে দেখছে চকচকে গাড়িটা। জাহিদ গাড়িতে বসে তাকালো চারদিকে। দেখলো ছেলেগুলোকে। হেসে বলল-
: কি দেখছো?
কথা নেই ছেলেগুলোর মুখে স্বয়ং রাজা সাহেব ওদের সাথে হেসে কথা কইছেন।

ভদ্রলোকদের কাছ থেকে গলাধাক্কা আর গালমন্দই যাদের পাওনা। জাহিদের ব্যবহার ওদের জীবনে বিস্ময়ের জোয়ার বৈকি!
দলের একজন ফিসফিস করে উঠলো-
: রাজা সাহেব কি সুন্দর।
: ফিল্মের হিরোর মতন।
: ধ্যাৎ তার চেয়েও সুন্দর।
নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ওরা। জাহিদ ততক্ষণে গাড়িতে ষ্টার্ট দিয়েছে।
ছেলেগুলো তখনো দাঁড়িয়ে।
জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালো জাহিদ। নরম করে বললো,
: সরে যাও খোকারা। গায়ে লাগবে।
আকাশ নীল গাড়িটা চলে গেল জায়গাটা শূন্য করে।
আর এক অদ্ভূত অনুভূতিতে ভরে দিয়ে গেলো এক পাল বখাটে কিশোরের মন। শুধু একটি মিষ্টি শব্দ- খোকা! এ নামটাতো শুধু বড় লোকের ছেলেদের হয়।
ওরা জানে বড় বাড়ির ছেলেদের এমন ধারা মিষ্টি নাম হয়। কিন্তু রাজা সাহেব কি জানেন না যে ওরা সব জগা, ভিকু আর লখা নামের ছেলে! পরনে যাদের তেলচিটে নোংরা প্যান্ট, পোড় খাওয়া ঠোঁটের আড়ালে যাদের দাগপড়া দাঁত। যারা অযথা মানুষকে অসম্মান করে কথা কয়। সেই গোল্লায় যাওয়া বাজে ছেলেগুলোকেই রাজা সাহেবের মত মানুষ বললেন কিনা-খোকা! ছেলেগুলোর ধুলি-ধূসরিত হৃদয় প্রাঙ্গনে যেন হেমন্তের শিউলি ঝরলো টুপটাপ করে।

ঘটনাটা জানতো না জাহিদ। জানতো না সে চন্দনপুরের রাজা সাহেব। জানলো আরও কিছুদিন পর।
তেমন কিছু নয়। খুচরো টাকার জন্যে সামনের দোকানে এসে দাঁড়িয়েছিল জাহিদ। ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলো দোকানী, কি চাই রাজা সাহেব?
প্রথমটা খেয়াল করেনি জাহিদ।
দোকানী জিঙ্গেস করলো-
: রাজা সাহেবের কি কিছু চাই?
জাহিদ চোখ তুলে প্রশ্ন করলো-
: কাকে বলছেন?
: জ্বী আপনাকে, রাজা সাহেব।
: রাজা সাহেব।
বিস্মিত জাহিদ।
একটু দূরে তখন ছেলেদের জটলা।
দোকানী অমায়িক হেসে বললো-তার রাজা সাহেব নামের কাহিনী। খুচরো টাকা ব্যাগে রাখতে রাখতে হাসলো জাহিদ।
বললো-
: ভারী গল্প বানাতে পারে তো ছেলেগুলো।
দোকানী বলল-
: জ্বী স্যার। কাজ-কর্ম কিছু নেইতো। সারাদিন এই করে শুধু।
ঘুরে ঘুরে বাড়ি তিনটেকে দেখতে লাগলো জাহিদ।
সত্যিই তো, ওর সদ্য রং করা ঝকঝকে তেতলা বাড়ির দু’পাশে দু’টো দোতলা বাড়ি।
ছেলেবেলার সেই রূপকথার গল্পই মনে করিয়ে দেয়।
ছেলেরা বলে, দুয়োরাণী আর সুয়োরাণী।
আবার হাসলো জাহিদ। ভাবলো, ছেলেগুলো বড়বেশি বুদ্ধিমান।

বন্ধুরা শুনে বললো-
: রাণীদ্বয়ের সাথে আলাপ হয়েছে?
: আলাপ! না।
: বলিস কিরে! এতো ইন্টারেষ্টিং গল্পের পরও-
বন্ধুরা নাছোড়বান্দা।
জাহিদ বললো-
: কি করতে বলিস আমাকে?
: একদিন হুট করে আলাপ পরিচয় করে নে’ প্রতিবেশীদের সাথে।
: তারপর দেখ কি হয়।
: শুনেছি দু’বাড়িতেই দু’জন কুমারী আছেন-
: তাতে কি!
তাতে কি মানে! রাণী বানাবি, রাণী।
: রাবিশ-
এবার সত্যি রেগে গেল জাহিদ।
বলল-
: তোদের ইয়ার্কি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্লীজ তোরা এখন যা। আমি এখন বিশ্রাম নেব। কাল ভোরে আবার ঢাকা যেতে হবে। হৈ চৈ করতে করতে বেরিয়ে গেল বন্ধুরা। শুয়ে পড়লো জাহিদ।

এর কয়েকদিন পর-
জানালার ধারে দাঁড়িয়ে চুল ব্রাশ করছিল জাহিদ। শীতের সকাল।
ছাদে কাপড় মেলতে এসে রোদ পোহাচ্ছিল পাশের বাড়ির আশা।
সে জানতো না যে পাশের রাজবাড়ির জানালায় চুল ব্রাশ থামিয়ে ওকে দেখছিল রাজা সাহেব-জাহিদ।
হঠাৎ-
হঠাৎই জানালার দিকে চোখ পড়লো আশার। মাত্র কয়েকটি অব্যক্ত মুহুর্ত।
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ভীষণভাবে চমকে উঠলো আশা।
জানালার ওপাশের মোটা ফ্রেমের চশমায় চোখ যেন যাদু করচে ওকে!

বড় একটা শ্বাস টানার চেষ্টা করতে গিয়ে ছুটে এসে সিঁড়ির ঘরে আশ্রয় নিলো আশা। বুকের বেতরে যেন ওর সমুদ্রের ঝড় উঠেছে।
আর জাহিদও যেন একটা স্তব্ধ মূর্তি।
ওর আশ্চর্য গভীর চোখের সামনে যেন একটা ইতিহাস রচিত হলো। কয়েকটি সীমিত মুহুর্তের সীমিত ইতিহাস। ওর বর্তমান, ভবিষ্যত আর অতীতকে স্তব্ধ করে দিয়ে একটা স্মৃতির স্বীকৃতি রেখে গেল যেন। ঝড় উঠলো জাহিদের সংযত বুকের গভীরেও।

এরপর অনেকদিন আর ছাদে ওঠেনি আশা।
প্রয়োজনেও না। ওঠে নি ভয়ে। যে সর্বনাশা আগুন দেখেছে ওই মানুষটির চোখে...
বুক কাঁপে ওর।

কেমন যেন অবাক রকমের মানুষটা।
কিন্তু তেতলার ঘরেই জাহিদের বাস। এছাড়া উপায় নেই।
সকাল-বিকেল জানালার ধারে বসেই প্রয়োজনীয় কাজ করতে হয় ওকে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওর অবাধ্য চোখ মাঝে মাঝে চলে যায় পাশের বাড়ির ছাদে। কিন্তু ছাদটা শূন্য। শুধু একটা দাঁড়কাক বসে দোল খায় মোটা তারে।
একদিন নাম নেই বাড়ির মেয়ে ঝর্ণার সাথে পরিচয় হলো মেলায়।
মেলা দেখতে এসেছিল জাহিদ। গাড়ি ওয়ার্কশপে যাওয়ায়, রিক্সার জন্যে অপেক্ষা করছিল গেটে।
ওপাশ থেকে এগিয়ে এলো ঝর্ণা। বললো-
: আপনি কি গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করছেন?
: গাড়ি?
অপ্রস্তুত হলো জাহিদ
এবার বিলোল হাসলো ঝর্ণা।
: বা-রে গাড়ি ছিল না একটা?
: ও, গাড়ি... হ্যাঁ হ্যাঁ ওয়ার্কশপে গেছে। কিন্তু আপনি-মানে আপনাকে ঠিক...।
একটু যেন বেকায়দায় পড়লো জাহিদ। আবার মোহময়ী হাসি হাসলো ঝর্ণা।
বললো-
: আমি ঝর্ণা।
আপনার ডানদিকের দোতলা বাড়িটিতে থাকি।
এই থেকে আলাপের সূত্রপাত।
বিলোল হেসে আর কথার ফুলঝুরি ঝরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছে ঝর্ণা।
বাড়ির বারান্দায়, জানালায় অথবা রাস্তায় দেখা হলেই উচ্ছ্বসিত হয়ে গল্প জুড়ে দেয় জাহিদের সাথে।
: জানেন পাড়ার বখাটে ছেলেগুলো কি রটিয়েছে আমাদের নিয়ে?
: রটিয়েছে?
: বা-রে জানেনা না? কি সব রাজা-রাণীর ছড়া বানিয়েছে।
মৃদু হাসে জাহিদ।
বলে-
: এই বাড়ি তিনটেকে নিয়ে এদের কল্পনার যে শেষ নেই। কি করবে ছেলেগুলো? একটা কিছু নিয়ে থাকতে তো হবে।
: ঠিক বলেছেন।
জাহিদের চোখে চোখ রেখে হাসলো ঝর্ণা।

সেদিন আকাশে মেঘ ছিল। কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছিলো না।
স্তব্ধ বাতাসের গতি। রোজকার মতো জানালার পাশে বসে একটা দৈনিক পড়ছিলো জাহিদ। প্রথম পৃষ্ঠায় একটা ছবি। লেখা ছিল কৃতি শিল্পী। জাতীয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক বিজয়িনী আশা চৌধুরী। প্রথমটায় চমকে উঠলো জাহিদ। চোখ দু’টো পরিচিত। আর তাকানোর ভঙ্গিটা বুকে দোলা লাগানো...ছাদের সেই শীত সকালের দৃষ্টি। এতো বড় একটা প্রতিভা আশ্চর্য!
ছবিটা ভারী সুন্দর। এলো করে কাঁধা একটি হাতখোঁপা, চোখের পাপড়ী ঘর আর দীঘল...দু’টো পুষ্ট আর হাসি ভরা ঠোঁট।
মুগ্ধ হয়ে গেলো। জাহিদ। এবং আলাপ করবার একটা বাহানাও পেয়ে গেল।

রোজ সকাল-সন্ধ্যায় সঙ্গীতের মৃদ্যু রেশ শোনা যেতো। কিন্তু এতটা জানতো না জাহিদ।
আত্মীয়-বন্ধুদের সমাগম।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলো জাহিদ।
ডানপিটে ছেলেগুলো ভীড় করেছে বাড়ির সামনে।
চোখে-মুখে বিস্ময়।
ওদের মধ্যে একজন বললো-
: গান করে সোনার মেডেল পেয়েছে।
: কী গানরে, ফিল্মের...।
: আরে ধ্যাৎ ওস্তাদী গান-সেই যে মাথা নেড়ে-নেড়ে খেয়াল।
: খেয়াল কিরে? শেয়াল?
: আরে ছোঃ। সে তুই বুঝবি নে।
অনভিজ্ঞ ছেলেগুলো নিজেদের বাহাদুরী জাহির করে।
ওদের কথায় কান দেয় না কেউ
বন্ধুদের কথায় নয়, মনের তাগিদেই রজনীগন্ধার ঝাড় হাতে চৌধুরী ভিলার ড্রইং রুমে এসে দাঁড়ালো জাহিদ।
সন্ধ্যা তখন পেরিয়ে গেছে। কমে গেছে শুভেচ্ছা বাহিনীর ভিড়। টেবিলে ফুল আর মালার সমাহার।
আশা এলো একটু পরেই। পরনে নীল তাঁতের শাড়ী। খোঁপায় বেল কুড়ির মালা।
: আ-আপনি!

কণ্ঠের সাথে কেঁপে উঠলো চোখের পাতাও।
ফুলের ঝাড় শুদ্ধ দু’হাত বাড়িয়ে দিল জাহিদ।
মৃদু হেসে বললো-
: আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
: জ্বী।
অপ্রস্তুত চোখ দু’টো আবারও কাঁপলো। ফুলের ঝাড় নিতে হাতে হাত ঠেকলো। কাঁপলো বুকের ভেতরটা। স্বাভাবিক হতে চাইলো আশা।
বললো-
: বসুন।
বসলো জাহিদ।

কিন্তু সে জানলো না যে, এই আসনগ্রহণ শুধু এই ড্রইং রুমেই নয়, এই বাড়ির অনাঘ্রাত ফুলটির মনের উপরও।
নেশায় বুঁদ তখন চৌধুরী ভিলার প্রাঙ্গন।
ফুলের সুরভিতে মাতাল নীলাঙ্গন। মুগ্ধ জাহিদের হৃদয়ও।
আশা টি পট থেকে চা ঢালতে ঢালতে বললো-
: অনেকদিন থেকে বাড়িটি খালি পড়েছিলো। অনেকের ধারণা, ওটা অপয়া বাড়ি। আপনি এসেছেন শুনে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম।
: আর পরে-
চোখ তুলে চাইলো আশা।
তারপর দৃষ্টি সরিয়ে বললো-
: খুশী হয়েছিলাম।
: কেন?
: সাহস দেখে-
ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো জাহিদ। আশা যেন হঠাৎ করে একটা ছেলেমানুষী কথা বলে ফেলেছে।
আর তাই শুনে অহংকারী বিজ্ঞের হাসি হাসছে জাহিদ।
কিন্তু থামতে হলো।
পর্দা সরিয়ে ভেতরে এলো নাম নেই বাড়ির মেয়ে ঝর্ণা।
জাহিদকে দেখলো। হাসলো ঠোঁট টিপে।
তারপর আশার হাতে একটি ফুলের তোড়া দিয়ে বলল-
: তোমার খবর শুনে কি যে খুশী হয়েছি ভাই। সে তুমি ভাবতেও পারবে না।

হেসে বসতে বললো আশা।
জাহিদকে দেখিয়ে বললো।
: আমাদের নতুন প্রতিবেশী।
ঝর্ণা আড় চোখে দেখলো জাহিদকে।
বললো-
: আমার সাথে আগেই পরিচয় হয়েছে।
তারপর হঠাৎ ঝন ঝনিয়ে উঠে বলল-
: সেদিন অতো করে বললাম-কই আমাদের বাড়িতে তো গেলেন না?
: ইয়ে... আমি ....মানে-
অপ্রস্তুত হয়ে ঢোক গিললো জাহিদ এবং একটু পরেই কাজের অজুহাতে উঠে পড়লো।
আশার চোখে চোখ রেখে অনুমতির পরাগ ছড়িয়ে বলল-
: আসি।
চলে গেলো জাহিদ।
চলে গেলো একটা অব্যক্ত অনুভূতিতে আশার মনটা ভরে দিয়ে।
এরপর বছর ঘুরলো ছয় ঋতুর সোহাগ নিয়ে।
রাজবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আগের মতোই মিষ্টি করে হাসে রাজা সাহেব-জাহিদ হাসান। তানপুরার তারে মৃদু ঝংকার ওঠে চৌধুরী ভিলার বাতাসটাকে আকুল করে। আশার সুরেলা কন্ঠ কেঁদে কেঁদে গায় ‘গাগরী ভবনে ক্যায়াসে যাউ’।
আশ্চর্য একটা খুশীর শ্বাস টানতে টানতে সিগারেটে আগুন ধরায় জাহিদ। এক সময় ইজি চেয়ারে এলিয়ে পড়ে।

এতো ভালো বোধ হয় কোনদিন লাগেনি জীবনকে।
এ যে অন্য এক অনুভূতি...।

কখনো ছাদে দেখা হলে খিল খিল করে হেসেছে ঝর্ণা।
বলেছে-
: কি ভাবছেন?
: কিছু না-
: সত্যি?
: মিথ্যে বলার অভ্যেস নেই।
জাহিদের কথার ধরণ দেখে আবার হেসেছে ঝর্ণা।
শরীরটাকে টান টান করে দাঁড়িয়েছে।
চোখ সরিয়ে নিয়েছে জাহিদ।
ঝর্ণা আবারো ঘুরে দাঁড়ায়।
বলে-
: আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।
হঠাৎ যেন কিছু একটা আটকে যায় জাহিদের গলায়।
ঢোক গিলে বলে-
: আচ্ছা।
: খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছেন মনে হচ্ছে?
: নার্ভাস, আমি ...না মানে...।
জাহিদের অপ্রস্তুত ভাব দেখে হঠাৎ হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে ঝর্ণা।
অবাক হয় জাহিদ।
ঝর্ণার এই হাসিটা যেন কোন কালেই থামবার নয়। ঝর্ণা আটসাট শাড়ী পরা টানটান দেহটা যেন একটা বুনো জন্তু। যেন কিছুতেই নরম হতে জানে না।
কিন্তু গোল্লায় যাওয়া ছেলেগুলোর চোখ এড়ায় না এদিকে।
বলে-
: রাজা সাহেবের হাসিটা কি মিষ্টি।
: আর দুয়োরাণীর?
: ধ্যাৎ। আমার একটুও ভালো লাগে না।
: কেমন ধারা যেন -
ছেলেগুলোর আলোচনা বেশি দূর এগোয় না। একটু পরেই রাস্তায় নেমে এলো জাহিদ। গাড়িতে উঠলো। ষ্টার্ট দিলো।
নোংরা দাঁত বের করে হেসে ফেললো বখাটে ছেলের দল। চেয়ে রইলো। দেখলো ওদের রূপকথার রাজা সাহেবকে।

এর মাত্র কিছুদিন পর। শীত গড়িয়ে মধুমাস এসেছে চন্দনপুরের বুকে। কৃষ্ণচূড়া আর অশোক পলাশ যেন অনুরোগে রাঙ্গা। রাজবাড়ির ঝুলন্ত টবে নাইন ও ক্লকের মিষ্টি হাতছানি। সময়টা ভালো, আবার খারাপও। বাইশে ফাল্গুন। জাহিদের জন্মদিন। দিন সাতেক আগে একদিন বিকালে জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। এবং সেই অবস্থাতেই। যথাসম্ভব বন্ধুদের নিমন্ত্রণটাও করে এলো। প্রথমটা বুঝতে পারেনি জাহিদ। তাই আশা আর ঝর্ণাকে জানালো জন্মদিনের প্রস্তুতির কথা। বলল-
: ঠান্ডার জ্বর কয়েকদিনেই সেরে যাবে; কিন্তু যা করবার তোমরা কর। প্রতিবার আমার বন্ধুরা করতো। এবার ওরা শুধু ‘গেষ্ট’।
ঝর্ণা বলল-
: ও, সিওর। পার্টি ম্যানেজ করার অভ্যেস আমার আছে। আশা জাহিদের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু ভাবলো, তারপর বলল-
: সে হবে। আগে তার অসুখটা সারুক।
কিন্তু অসুখটা সারলো না বরং বাড়লো।
রাজবসন্ত। নাম ডাকটা বড়।
প্রথম প্রথম খুব ভিড় জমলো। তারপর কমলো।
পাড়ার প্রবীণরা দুঃখ করলো। এবং অবশেষে বউ ছেলে নিয়ে ঘরের দরজায় খিল দিলো।
রাজবাড়ির পাশে মানুষের ছায়া পড়াই বন্ধ হয়ে গেলো।
প্রথমদিকে কয়েকদিন আশা এলো। এসে বসলো জাহিদের বিছানার পাশে।
বললো-
: কেন এমন হলো?
হাসলো জাহিদ। বললো-
: বিধাতার কৃপা।
: কৃপা?
কান্না চাপতে চাইলো আশা।
আর ওর এই লুকোবার চেষ্টাই নতুন করে আঘাত দিল জাহিদকে।
বললো-
: তুমি আমার এতো কাছে না এলে ও তো পারতে আশা।
: হয়তো পারতাম-কিন্তু পারলাম না।
এবার মুখটাকে সম্পূর্ণ আড়াল করে নিল আশা।
চোখ বন্ধ করলো জাহিদ, ক্লান্ত কণ্ঠে বললো-
: শেষ বেলায় এইটুকুই আমার তৃপ্তি আশা। কিন্তু তুমি আর এসো না-রোগটা বড় ছোঁয়াচে।
অক্লান্ত কেঁদেছে আশা। কেঁদেছে ছেলে মানুষের মতো। ভিজে উঠলো জাহিদেরও দু’চোখ। তবুও হাসবার চেষ্টা করে বললো-
: এখনই অশ্রুর সরোবরকে শুন্য করে ফেলছো কেন আশা? যেদিন আমার মৃত্যু সংবাদ শুনবে সেদিনটার জন্য একটু রাখো।
: না,না, না ...।
দু’হাতে মুখ ঢেকে ছুটে পালিয়েছে আশা। সামলাতে পারেনি নিজেকে। ঝর্ণা এসেছিল একদিন। দেখেই বললো-
: মাগো-কি সাংঘাতিক-হাসপাতালে গেলেই পারতো।
পাশ ফিরে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলো জাহিদ।
কোন উত্তর দেবার প্রবৃত্তি হলো না।
বাড়িতে মাত্র দু’জন সহচর। চাকর কালু, আর ডাক্তার বন্ধু। ২১ ফাল্গুন, সন্ধ্যার দিকে রক্তিম চোখ খুললো জাহিদ।
ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো চারদিকে। চারদিকে অস্পষ্ট-কুয়াশাময়।

আর ঠিক এমনি সময় রাজবাড়ির ভেতরে জীবনের প্রথম ঢুকলো পাড়ার বখাটে ছেলেগুলো। অব্যক্ত বেদনায় দেখলো ওদের রূপকথার রাজপুত্রকে।
জাহিদের দৃষ্টি চার দেয়ালের শূন্যতার মধ্যে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিল, কিন্তু থেমে গেল দরজার কাছে এসে। ওখানে যেন কতগুলো পরিচিত মুখের ছায়া দুলছে। বার বার চেষ্টা করলো, বুঝতে চাইলো, চিনতে চাইলো। কিন্তু তবুও ওরা স্বপ্নের রাজ্যে ছায়া হয়ে রইল। ছেলেগুলো দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ভাবলো। রাজা সাহেব কি ওদের চিনতে পারছেন না? অমন দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে কেন? চিনতে পারলে নিশ্চয়ই একটু হাসতে চেষ্টা করতেন ....কেন রাজপুত্রের এমন হলো?
২২ ফাল্গুনের সূর্য আগুনের অবগাহন করবার সৌভাগ্যটুকুও হলোনা জাহিদের। তার আগেই সমস্ত অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতকে মিথ্যে করে দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল চন্দনপুরের রূপকথার মানুষটি। অসহায় সমস্যায় পড়ে প্রতিবেশীদের কাছে থাকে। সহযোগিতা আহ্বান করলেন ডাক্তার বন্ধু। মেঝেতে অজ্ঞান কালু।
কি আশ্চর্য! চন্দনপুরের মানুষগুলো যেন একই সাথে হঠাৎ করে কানা আর বোবা হয়ে গেছে। কেউ এগিয়ে এলো না।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই প্রথম লাশের পাশে এসে দাঁড়ালো পাড়ার বখাটে ছেলে দল।
বললো-
আপনি শুধু হুকুম করুন স্যার।
: তোমরা?
বিস্মিত ডাক্তার দেখলেন আশ্চর্য রুক্ষ আর কঠিন চেহারার ছেলেগুলোর চোখ অশ্রুতে টলমল করছে। থরথর করে কাঁপছে ওদের অসমান নোংরা চুল।
সব কাজ সারতে বেলা গড়িয়ে গেল। মস্তবড় গাড়ি এসে থামলো রাজবাড়ির দরজায়। চন্দনপুর বিস্মিত, স্তব্ধ। রাজা সাহেবের লাশ কাঁদে নিয়ে জীবনের প্রথম গাড়িতে উঠে বসলো বখাটে ছেলেগুলো। সবার শেষে উঠলেন ডাক্তার বন্ধু।
বুড়োরা পেছনে চেঁচিয়ে মরলো।
: ওরে সর্বনেশে ছেলের দল এই অবেলায় মরা নিয়ে যাসনে। ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।
কিন্তু গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে।
আর ভেতরে রূপকথার রাজপুত্রের লাশ ঘিরে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে পাড়ার হাড় জ্বালানো গোল্লায় যাওয়া ছেলেগুলো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন