Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রবাসীর ঈদ ভাবনা

রহমান মৃধা | প্রকাশের সময় : ১২ মে, ২০২১, ১২:০১ এএম

সুইডেনের সমাজে যারা প্রভূত অর্থ-সম্পদের মালিক, তাদের অনেকেই স্ব-অর্থায়নে সেবামূলক কাজ করে। কিন্তু যাদের সম্পদ কম তারা এলাকায় কোনো মসজিদ, মন্দির, ক্লাব, পাঠাগার গড়ার জন্য সম্মলিতি উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। এ ধরনের সমাজসেবা হলো নিজের খেয়ে সমাজের জন্য কাজ করা। এদের প্রাপ্তি বলতে মানুষের জন্য কাজ করার আনন্দ বৈ আর কিছু না। এসব কাজ সুইডেনে সব সময়ই হয়ে থাকে। বাংলাদেশে রমজান মাসে আমরা অনেকেই এ ধরনের কাজ করে থাকি যাকাত-ফিতরা ও দান-খয়রাতের মাধ্যমে। সুইডিশদের মধ্যেও ভালো-মন্দ আছে তা সত্তে¡ও কেন যেন মনে হয়, সমাজ ব্যবস্থায় ইসলাম ধর্মের অনেক রীতিনীতির মিল রয়েছে, যেমন এরা বেতনের এক তৃতীয়াংশ ট্যাক্স দেয়, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। ইদানিং সুইডেনেও ইউরোপের অনেক দেশের মতো মসজিদ তৈরি এবং কমিটি নির্বাচনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করা হচ্ছে। ইসলাম ধর্মকে সুইডেন এবং ইউরোপে আগের তুলনায় সহজভাবে দেখা হচ্ছে, যদিও মাঝে-মধ্যে নানা সমস্যা দেখা যায়।

খ্রিস্টান প্রধান হলেও ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস রাশিয়ায়। দেশটিতে মুসলমানরা দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। বেসরকারি হিসাবে শুধু মস্কোতেই বাস করে প্রায় ৪০-৪৫ লাখ মুসলমান। ঈদের দিন রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলোতে একদিনের বিশেষ ছুটি ঘোষণা করা হয়। রাশিয়া একটি বিশাল দেশ। ইউরোপ এবং এশিয়া জুড়ে এর অবস্থান, সেক্ষেত্রে ইউরোপের মধ্যে যে শহরগুলো রয়েছে, সেখানেও ঈদ পালন হয়ে থাকে।

ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ঈদ আকাশ-পাতাল ব্যবধান। কারণ, ইউরোপে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বাইরে একটি দিনও বন্ধ রাখা হয় না। আমরা যারা মুসলিম রয়েছি, ঈদের দিনে কোনো ছুটি থাকে না। এর ফলে ঈদের নামাজ পড়াও মুশকিল হয়ে যায়। তাই ঈদ উপলক্ষে কর্মস্থলে আগেই ছুটির জন্য বলে রাখতে হয়। অন্যদিকে নামাজ শেষে ফের কর্মস্থলে যেতে হয়। ঈদের যে আনন্দ বাংলাদেশে, তা অনুভূত হয় না ইউরোপে। মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলোয় কর্মজীবী বাংলাদেশিরা কিছুটা ঈদের আনন্দ পান।

সুইডেনের সাউথ এবং নর্থের যে দূরত্ব তাতে করে কিছু শহরে ১৭ ঘণ্টা আবার নর্থে ২২ ঘণ্টা রোজা পালন করা হয়েছে এবার। সুইডেন ছাড়াও ইউরেপের অঞ্চলভেদে মুসলমানরা ১৭ থেকে ২২ ঘণ্টা পর্যন্ত রোজা পালন করেছেন। মসজিদ থাকা সত্তে¡ও নামাজ বা তারাবির নামাজ পড়া সম্ভব হয়নি। গত সপ্তাহে ডেনমার্কের এক মসজিদে পঞ্চাশ জন একত্রে নামাজ পড়ার পর জানা গেছে, সবাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এ সময় এধরনের খবর স্বাভাবিকভাবে বেদনাদায়ক। জিনিসপত্রের দাম রোজার মাসে বাড়ানো হয়নি বরং কিছুটা কম বলা যেতে পারে। বিশ্বের সব দেশের মানুষের বাস এখানে। সেক্ষেত্রে ধর্মচর্চায় সুযোগ-সুবিধা অনেক। কাজের ফাঁকে নামাজ-রোজার সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে, যা সত্যিই প্রসংশনীয়।

করোনাভাইরাসের কারণে এই বছরের রমজান প্রায় পুরোপুরি ঘরে বসেই পালন করেছেন সবাই। গতবারের মতো এবারও কিছুটা ভিন্নরকম ঈদ উদযাপন করতে হবে সবার। অধিকাংশ দেশে মসজিদগুলো বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে অনেক দেশের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা ঈদ-উল-ফিতরের জামাত আদায় করতে পারবে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার কারণে কেউ কোলাকুলিও করতে পারবে না। প্রিয়জনকে দূর থেকেই ঈদের শুভেচ্ছা জানাবেন সকলেই।

প্রতি বছর সকলেই এই দিনে চেষ্টা করে আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধুদের সাথে মিলিত হতে। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। কিন্ত প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস ¤øান করে দিয়েছে সকলের আনন্দ। বাংলাদেশের মতো প্রবাসেও সবাই লকডাউনের কারণে ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। ইউরোপের অনেক দেশে এবারও ঈদের জামাত হবে না। যদিও ইউরোপে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমতে শুরু করেছে, তারপরেও করোনার উপদ্রব ঠেকাতে এবারের ঈদের জামাত করার অনুমতি দেয়নি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো।

ঈদের ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে পার্ক কিংবা সমুদ্রতটে ভ্রমণ করতে পছন্দ করে অধিকাংশ প্রবাসী। এ বছর এসব পর্যটন স্পটে যাওয়া যাবে, তবে কেউ ভিড় করতে পারবে না। সুইডেনে এবার ঈদুল ফিতরের কোনো জামাত অনুষ্ঠিত না হলেও প্রবাসী বাংলাদেশিরা সামাজিক দূরত্ব মেনে ঘরেই পরিবার পরিজনের সঙ্গে ঈদুল ফিতর উদযাপন করবে। এ বছর কারও বাসায় কেউ যাবে বলে মনে হয় না। হবে না ঈদের কোলাকুলি করা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া এবং আত্মীয়-প্রতিবেশীদের নিয়ে ঈদ উদযাপন করা।

মনে পড়ে, প্রায় চল্লিশ বছর আগের স্মৃতি। ঈদের নামাজের পূর্বে মিষ্টিমুখ অর্থাৎ সেমাই খেয়ে নামাজে যাওয়া যেন একটা সামাজিক রেওয়াজ ছিল। খেতে না চাইলেও জোরপূর্বক খাওয়াতেন মা। এরপর নতুন পোশাক পরে সালামি নিতে অপেক্ষায় থাকতাম। বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজন বড় সবাইকে সালাম করলে টাকা হাতে তুলে দিতেন। সেই টাকা দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম বন্ধুদের নিয়ে। পাড়া-মহল্লা চষে বেড়াতাম। সবার বাসায় গিয়ে খীর, সেমাই খেতে খেতে একটা সময় আর খাওয়ার কোনো রুচি থাকত না। সব মিলে ছেলে বেলার ঈদ ছিল পরিপূর্ণ বিনোদনে ভরা, যা এখন শুধু স্মৃতি, তবুও মুছে যাওয়া দিনগুলি পিছু ডাকে, স্মৃতি হৃদয়ে বেদনার রঙ্গে রঙ্গে ছবি আঁকে। সেই আগের মতো আনন্দ এখন আর হবে না? হবে কী করে, বাবা-মা নেই, কোথাও কেউ নেই সেই ছোট বেলার মতো। তিন যুগেরও বেশি প্রবাসে ঈদ করছি। বিদেশে অর্থের পিছুটান না থাকলেও আনন্দ-উল্লাসের অনেক ঘাটতি রয়েছে, যা কোনভাবেই পূরণীয় নয়। দেশের টানে, নাড়ির টানে মন ছুটে চলে সব সময় দেশের দিকে। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে দেশকে অনেক বেশি মনে পড়ে। কারণ, সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ফলে বোধগম্য হয় ঈদ হচ্ছে। তবু সব কিছু মেনেই চলতে হয়। দুঃখ আর বেদনার আরেক নাম প্রবাসীদের ঈদ উদযাপন। পবিত্র ঈদের খুশি ধনী, গরীব সবার জীবনে নিয়ে আসুক সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি।

লেখক: সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন