পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ঈদ সামনে রেখে প্রতিবছরই চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। পত্রিকার খবরই বলে দেয় এবারের ঈদও তার ব্যতিক্রম নয়। অবশ্য সড়ক-মহাসড়কে আগের বছরগুলোর মতো এবার বেপরোয়া চাঁদাবাজি না থাকলেও যানবাহন, বিশেষ করে মালবাহী ট্রাক, প্রাইভেট কার থামিয়ে পুলিশের চাঁদাবাজি বেশ লক্ষ করা যাচ্ছে। ঈদ বকশিশের নামে সড়ক- মহাসড়কগুলোয় চাঁদা তুলছে পুলিশের কিছু অসাধু সদস্য। ঈদকে ঘিরে থানা পুলিশের পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশ মিলেমিশে চাঁদাবাজি করছে- এমন অভিযোগ উঠেছে। সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতারা ‘যানজট নিরসন প্রকল্পের’ নামে রসিদ দিয়ে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছেন। এজন্য সড়কের প্রবেশ পথে মোতায়েন করা হয়েছে লাঠিয়াল বাহিনী। বাস, ট্রাক, কোচ, সিএনজি অটোরিকশা, ইজিবাইক, রিকশা-ভ্যান ইত্যাদি যানবাহন থামিয়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে তাকে হয়রানি ও মারধর করা হচ্ছে।
জানা গেছে, রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীনে ফুটপাত দখলকারী গ্রæপ আছে কমপক্ষে ৭০টি। সংশ্লিষ্ট এলাকার ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরাই এসব গ্রæপের সদস্য। এরাই ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে হকারদের কাছে ভাড়া দিয়ে থাকে। ভাড়ার আড়ালে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতার নামে আদায় করা হয় মোটা অংকের টাকা। ফুটপাতের হকাররা জানায়, রমজান শুরু থেকেই সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজরা চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। কয়েকটি এলাকায় সন্ত্রাসীদের নামেও চাঁদা চাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চাঁদাবাজরা এলাকা ভেদে ২শ’ থেকে ৩শ’ দোকানের একটি অংশকে নাম দিয়েছে ‘ফুট’। চক্রাকারে ফুটের হকারদের কাছ থেকে দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদার টাকা নিচ্ছে চাঁদাবাজ গ্রæপের নিয়োজিত লাইনম্যানরা। তাদের কাছ থেকে টাকা বুঝে নিচ্ছে প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার মনোনীত সর্দার। লাইনম্যানের উত্তোলিত টাকার সিংহভাগই যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও মাস্তান বাহিনীর পকেটে। ফুটপাতের দোকানগুলোতে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার সঙ্গে জড়িত বিদ্যুৎ বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর পকেটেও যাচ্ছে লাইনম্যান ও সর্দারের উত্তোলিত টাকার একটি অংশ। রাজধানীর গুলিস্তান এলাকার কয়েকজন হকার জানায়, লাইনম্যানদের দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদা পরিশোধ করে দোকান চালাতে হয়। চাঁদার রেট কম হলেই উচ্ছেদসহ বিভিন্ন হুমকি দেয়া হয়। ভেঙে দেয়া হয় দোকানপাট। এর সবই হচ্ছে প্রকাশ্য দিবালোকে।
ঈদ বকশিশের নামে বিভিন্ন কৌশলে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও পুলিশ বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যের বিরুদ্ধেও। চাঁদা দাবির ঘটনায় কিছু ক্ষেত্রে থানায় ডায়েরি ও মামলা হলেও অধিকাংশ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা চাঁদাবাজির বিষয়ে পুলিশকে জানায়নি। ব্যবসায়ীরা বলেছেন ‘নীরব’ চাঁদাবাজিতে তাদের এখন ত্রাহী মধুসূধন অবস্থা। এলাকার বড় বড় সন্ত্রাসীর নাম করে চাঁদা চাওয়া হয়েছে। অনেক দাগি সন্ত্রাসী এলাকায় না থাকলেও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা ঈদকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এলাকার কিছু মাস্তান রাজনৈতিক নেতার পরিচয়েও চাঁদাবাজি করছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের বক্তব্য হলো, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। পুলিশের বক্তব্য যদি সত্য হয় তবে কেন ঈদকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি? অবাক ব্যাপার যে, কেবল ঈদের মৌসুমে নয় সারা বছরই চলে চাঁদাবাজি। ঈদকালীন চাঁদাবাজিতে চাঁদাবাজরা বরাবর সক্রিয় থাকলেও এবার যেন তারা অতিমাত্রায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, মতিঝিল, ফকিরাপুল, গুলিস্তান, এলিফ্যান্ট রোডের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, নামকরা শীর্ষ সন্ত্রাসী, মৌসুমি চাঁদাবাজ, এলাকাভিত্তিক চাঁদাবাজ বা সন্ত্রাসীরাই শুধু চাঁদা নিচ্ছে না। এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চাঁদা আদায় করছে হিজড়ারা। শারীরিক অক্ষমতার অজুহাতে এরা নানা দলে বিভক্ত হয়ে বাসাবাড়ি, যানবাহন ও ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বত্র চাঁদাবাজির উৎসবে মেতে উঠেছে।
একটি সুস্থ সমাজ সর্বদাই আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। চাঁদাবাজি সুস্থ সমাজ কাঠামোয় বিশৃংখলা সৃষ্টি করে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিত হলে চাঁদাবাজি কমে আসবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। জোরপূর্বক কারও কাছ থেকে চাঁদা আদায় নিঃসন্দেহে অপরাধ। অনেক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন দল ও সংস্থার নামেও চাঁদা আদায় করে থাকে। বিশেষ করে পরিবহন খাতে এ ধরনের চাঁদাবাজি বেশি লক্ষ করা যায়। চাঁদা আদায় হয় হাট-বাজারে, ফেরিঘাটে, সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রভাবশালীর নামে। ঈদের সময় বাস ভাড়া বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়। এর পেছনে সংশ্লিষ্টদের স্বেচ্ছাচারিতা যেমন রয়েছে, তেমনি চাঁদাবাজরাও এজন্য দায়ী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক, এদেশে চাঁদা না দিয়ে কোনো ব্যবসা করা সম্ভব নয়।
সমাজে শান্তি-শৃংখলা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারীসহ অন্যান্য অপরাধীর বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স প্রদর্শনের কোনো বিকল্প নেই। চাঁদাবাজদের গ্রেফতারের পর প্রায়ই আইনের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে সহজেই ছাড়া পায়। তাছাড়া জেল থেকে বের হয়ে চাঁদাবাজরা আরও সংহারী মূর্তি ধারণ করে। আইনশৃংখলা বাহিনীর ওপর আমরা আস্থা রাখতে চাই। চাঁদাবাজদের দমনে আইনশৃংখলা বাহিনীর আন্তরিকতা ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি বিচার ব্যবস্থার সংস্কার নিয়েও ভাবতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।