পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বুড়িগঙ্গাকে কোনোভাবেই বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। দখল, দূষণে নদীটি দিন দিন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্বেগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। ‘যেভাবে চলছে চলুক’ এমন একটা মনোভাব নিয়ে বসে আছে। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে এ পর্যন্ত যে কত আন্দোলন হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। সভা, সেমিনার থেকে শুরু করে মানববন্ধন এমনকি কোর্টের নির্দেশনাও রয়েছে। পত্র-পত্রিকায় নদীটির মরণদশার কথা উল্লেখ করে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষকে মাঝে মাঝে লোক দেখানো কিছু উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। তারপর আবার যেই সেই অবস্থায় ফিরে আসে। বছরের পর বছর চলে গেলেও ‘বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে’ হবে এই আকুতি কারো মধ্যেই দেখা যায় না। ফলে চোখের সামনে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ নদীর ক্রমৃত্যু দেখার পরও কারোই যেন কিছু করার নেই।
বুড়িগঙ্গার ইতিহাস ঐতিহ্য বলে শেষ করা যাবে না। এর টলমল পানির জোয়ার-ভাটা এবং এর নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থার আকর্ষণেই মুঘলরা ১৬১০ সালে ঢাকাকে রাজধানীতে পরিণত করে। শুধুমাত্র বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করেই রাজধানী গড়ে উঠে। পানযোগ্য পানির মূল উৎস হয়ে উঠে এ নদী। কালক্রমে ঢাকা যতই আধুনিক হতে শুরু করে নদীটি ততই দৈন্যদশায় পরিণত হতে থাকে। দখলদাররা এর দুই পাড় দখল করে ভরাট করতে থাকে, অন্যদিকে রাজধানীর যত ময়লা-আবর্জনা রয়েছে তার সবটুকুই এসে পড়ে বুড়িগঙ্গায়। এখন তো এমন অবস্থা হয়েছে যে প্রায় সারা বছরই নদীটির পানি কালো হয়ে থাকে। পানির দুর্গন্ধে নদীর পাড় এবং এর উপর দিয়ে চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর পানি এতটাই বিষাক্ত যে মাছ দূরে থাক অন্য কোনো জলজ উদ্ভিদ বা প্রাণী এতে নেই। বলা যায়, একসময়ের সুপেয় পানির ধারা হিসেবে পরিচিত বুড়িগঙ্গা ময়লা-আবর্জনা ও বিষাক্ত পানির বড় ড্রেনে পরিণত হয়েছে। রাজধানীর যত ধরনের আবর্জনা রয়েছে তার সবই এ নদীতে ঢেলে দেয়া হচ্ছে। কলকারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল, গৃহস্থালি বর্জ্য, মেডিক্যাল বর্জ্য, মৃত প্রাণীর দেহ, প্লাস্টিক এবং বিষাক্ত পোড়া তেলসহ এমন কোনো বর্জ্য নেই যা এ নদীতে ফেলা হচ্ছে না। বুড়িগঙ্গার নাব্য বজায় রাখার জন্য কয়েক বছর আগে ড্রেজিং প্রকল্প হাতে নেয়ার পর দেখা যায়, এর তলদেশ প্রায় ৬ ফুট পুরো প্লাস্টিকের স্তর দিয়ে ঢেকে আছে। এত বিপুল প্লাস্টিক তুলে এর নাব্য বজায় রাখা সম্ভব নয় বলে এ প্রকল্প স্থগিত করা হয়। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না বুড়িগঙ্গা ড্রেজিং করার মতো অবস্থায়ও নেই। প্লাস্টিকের এ পুরুত্ব ইতোমধ্যে আরও যে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, রাজধানী থেকে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৪ হাজার টন কঠিন বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায়ই বুড়িগঙ্গায় পতিত হয়। বিশেষজ্ঞরা বুড়িগঙ্গা দুষণের ৯টি স্পট চিহ্নিত করেছিলেন। এ স্পটগুলো হলো টঙ্গী, তেজগাঁও, হাজারিবাগ, তারাবো, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজিপুর, ঢাকা এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন ও ঘোড়াশাল। এসব এলাকার বেশিরভাগ শিল্পকারখানার বর্জ্যরে কোনো পরিশোধনাগার নেই। প্রতিদিন এসব শিল্পকারখানা থেকে ৬০ হাজার ঘনমিটার বিষাক্ত তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। শুধু তাই নয়, রাজধানীর বেশিরভাগ স্যুয়ারেজ লাইন সরাসরি বুড়িগঙ্গার সাথে যুক্ত হয়ে এর পানি দূষিত করছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এই বিষাক্ত বুড়িগঙ্গার পানিই আবার আমরা ওয়াসার মাধ্যমে পান করছি। যে পাত্রের পানি বিষাক্ত করছি, সেই পাত্রের পানিই পান করছি। দূষণের এই ভয়াবহতার পাশাপাশি প্রভাবশালীদের দ্বারা এর দুইপাড় দখল হয়েছে। এদের কবল থেকে বুড়িগঙ্গার তীর দখলমুক্ত করার উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না। মাঝে মাঝে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সাড়ম্বরে ঘোষণা দিয়ে বুলডোজার নিয়ে হাজির হয়। ক্যামেরার সামনে কিছু উচ্ছেদ অভিযানের চিত্র দেখিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। দখলমুক্ত জায়গা সংরক্ষণে কার্যকর উদ্যোগ নিতে খুব কম দেখা যায়। এভাবে যদি দিনের পর দিন একটি নদীর ওপর দখল ও দূষণের অত্যাচার চালানো হয়, তবে তা কি বেঁচে থাকতে পারে?
রাজধানীর চারপাশে যে চার নদী বেষ্টন করে একে সজীব করে রেখেছে, এই চার নদীই দখল-দূষণে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীতে খুব কম রাজধানীই রয়েছে, যার চারপাশে নদী রয়েছে। অথচ চারটি নদীই কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। এক বুড়িগঙ্গা বাঁচানো নিয়ে পরিবেশবিদসহ সচেতন মানুষের আকুতি এবং পত্রপত্রিকার লেখালেখি হলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। অথচ এই বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো খুবই জরুরী। বুড়িগঙ্গা যদি না থাকে, তাহলে কী অবস্থা হবে? আমরা মনে করি, যে কোনো উপায়ে হোক বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এর পাড় দখলমুক্ত করতে হবে এবং এর দূষণ রোধ করতে হবে। বুড়িগঙ্গাকে রাজধানীর ভাগাড়ে পরিণত করার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে সকলকে সোচ্চার হতে হবে। দূষণের যতগুলো উপায় আছে সেগুলো রোধ করতে হবে। অপরিশোধিত কোনো বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা যাবে না। রাজধানীর সরাসরি স্যুয়ারেজ লাইন নদীর সাথে সংযোগ দেয়া যাবে না। বিষাক্ত কেমিক্যাল ও মেডিক্যাল বর্জ্য কোনোভাবেই অপরিশোধিত অবস্থায় নদীতে ফেলা যাবে না। আমাদের উচ্চ আদালত বিভিন্ন সময়ে জনসম্পৃক্ত ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর ক্ষেত্রেও আদালত কার্যকর নির্দেশনা দিতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।