পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
হিজরতের পর দ্বিতীয় বর্ষে রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পর রসূলুল্লাহ (সা.) নবম রমজান পেয়েছিলেন। প্রথম দিকে রমজান মাসে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, ‘বদর যুদ্ধ’ ছিল তার মধ্যে প্রধান। এই বিজয়ের আনন্দের সাথে আরও একটি আনন্দের বিষয় ছিল রমজান মাসে হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর জন্ম। হিজরী তৃতীয় বর্ষের ১৫ রমজান হজরত ইমাম হাসান (রা.) জন্মগ্রহণ করেন।
তার জন্ম ছিল এক অতীব আনন্দদায়ক ঘটনা। কেননা ইমাম হাসান ছিলেন হজরত আলী (রা.) ও হজরত ফাতেমা (রা.)-এর প্রথম পুত্র সন্তান এবং রসূলুল্লাহ (সা.)-এর দৌহিত্র। রমজান মাসে হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর জন্ম ছিল এক সৌভাগ্যের বিষয়। তাঁর ভ‚মিষ্ঠ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মদীনায় মুসলমানদের মধ্যে দারুণ আনন্দের সৃষ্টি হয়। হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর কুনিয়াত (ডাক নাম) ছিল ‘আবু মোহাম্মদ’। ইসলামের পঞ্চম খলিফা হিসেবে তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে খেলাফতে রাশেদার একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন, এর মাধ্যমে খেলাফতে রাশেদার ৩০ বছর পূর্ণ হয়।
হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর জীবনে ব্যতিক্রমধর্মী একটি ঘটনা হচ্ছে এই যে, তাঁর জন্ম যেমন রমজান মাসে, তেমনি রমজান মাসেই তিনি খেলাফত লাভ করেন। হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদতের পর কুফায় চল্লিশ হাজার লোক হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর হাতে মৃত্যুর ওপর বয়াত গ্রহণ করে। রসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় হজরত ইমাম হাসান (রা.) দীর্ঘকাল না পেলেও নানার আদর্শ শিক্ষা তিনি পরিপূর্ণভাবে পেয়েছিলেন। তাঁর সৌভাগ্য হয়েছিল যে, জন্মের পর তাঁর নানা সাইয়েদুল মোরসালীন স্বীয় দৌহিত্রের কানে আজান ও একামত বলেছিলেন।
হজরত ইমাম হাসান (রা.) ১৫ রমজান জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লালন-পালন, শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছুই সরাসরি রসূলুল্লাহ (সা.) এবং মাতা-পিতার তত্তাবধানে সম্পন্ন হয়। অবশ্য হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর সাত বছর বয়সের সময় তাঁর নানা রসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত হয়ে যায়। তথাপি এই অল্প বয়সেও তিনি কয়েকটি হাদীস সরাসরি তাঁর নানার কাছ থেকে বর্ণনা করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৩ বলে উল্লেখিত হয়ে থাকে। সাত বছর বয়সে এতগুলো হাদীস মুখস্থ রাখা একটি অসাধারণ ব্যাপার। এতে প্রমাণিত হয় যে, হজরত ইমাম হাসান (রা.) কি অসাধারণ মেধা ও প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।
হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর মহান পিতা, ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) রমজান মাসের দ্বিতীয় দশকের শেষ দিকে আততায়ীর তরবারীর আঘাতে আহত হন এবং তাঁর শাহাদতের পর হিজরী ৪০ সালের ২৬ রমজানুল মোবারক মুসলমানগণ সর্বসম্মতভাবে হজরত ইমাম হাসান (রা.) কে খলিফা মনোনীত করে তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করে। তিনি মাত্র ছয় মাসের মত খলিফা ছিলেন। অতঃপর এক চুক্তির মাধ্যমে, শান্তিপূর্ণভাবে হজরত মোআবিয়া (রা.) কে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ফলে খেলাফতে রাশেদার অবসান ঘটে। ক্ষমতা হস্তান্তরের পর তিনি সাত বছর জীবিত ছিলেন। বলা হয়, তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।
হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বহু হাদীস রয়েছে। বোখারী, মুসলিম ও তিরমিজীতে বর্ণিত এক হাদীস অনুযায়ী হযরত বারা ইবনে আজেব (রা.) বলেন, আমি নিজের চোখে রসূলুল্লাহ (সা.) কে দেখেছি যে, তিনি হজরত ইমাম হাসান (রা.) কে নিজের কাঁধে বহন করে বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আমি এই শিশুকে ভালবাসি, তুমিও তাকে ভালবাস।’
হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর খেলাফত লাভ ও হজরত আমীর মোআবিয়া (রা.)-এর নিকট একটি চুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা ইসলামী ইতিহাসের এক নজিরবিহীন অধ্যায়। ইতিহাস রচয়িতাগণ এ ঘটনার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। এখানে সংক্ষেপে তা উল্লেখ করা হলো;
চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদতের পর হিজরী ৪০ সালের রমজান মাসে ইরাকবাসীরা দলে দলে এসে হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর হাতে বায়াত করতে থাকে এবং তিনি খেলাফতের আসনে সমাসীন হন। অতঃপর তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। এ ভাষণে তিনি বলেন, ‘হে লোক সকল! গতকাল তোমাদের মধ্যে হতে এমন এক ব্যক্তি আলাদা হয়ে গেছেন যে, পূর্ববর্তীরা যাকে অতিক্রম করতে পারেনি এবং পরবর্তীরা যার নিকটবর্তী হতে পারবে না। রসূলুল্লাহ (সা.) লড়াইসমূহে তাকে স্বীয় পতাকা দান করতেন, তিনি কোন যুদ্ধে পরাজিত হননি। মিকাঈল ও জিবরাইল ফেরেশতাদ্বয় তাঁর ডান বামে থাকতেন। তাঁর জমাকৃত সাতশত দেরহাম ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাঁর কাছে সোনা রূপার এক পাইও ছিল না। জমাকৃত দেরহামগুলোও একটি গোলাম কেনার জন্য ছিল।’
খেলাফত লাভের পর এটি ছিল ইমাম হাসান (রা.)-এর প্রথম ভাষণ। অপরদিকে হজরত আমীর মোআবিয়া (রা.) হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদতের খবর শুনার পর ‘আমিরুল মোমেনীন’ উপাধি ধারণ করে সিরিয়াবাসীদের বায়াত নবায়ন করান। অতঃপর ইসলামী দুনিায়ায় সরকারি পতাকা উড্ডীন করায় তার পুরনো আশা পূরণের স্বপ্ন দেখতে থাকেন এবং এটিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে ৬০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে কুফা আক্রমণ জন্য গমন করেন এবং হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর নিকট এই মর্মে খবর পাঠান, ‘সন্ধি, যুদ্ধ অপেক্ষা উত্তম এবং আমাকে উপস্থিত খলিফা হিসেবে স্বীকার করে আমার হাতে বায়াত করুণ’।
অতঃপর, হজরত ইমাম হাসান (রা.) ৪০ হাজার সৈন্যদলসহ কুফার দিকে যাত্রা করেন এবং ‘দায়রে আবদুর রহমান’ নামক স্থানে পৌঁছার পর কায়স ইবনে সাদকে বারো হাজার সৈন্যসহ অগ্রগামী দলের নেতা হিসেবে সামনে প্রেরণ করেন। এ বাহিনী যখন ‘মাদায়েনের সাবাত’ নামক স্থানে উপনীত হয়, তখন কেউ কায়স ইবনে সাদের মৃত্যুর খবর প্রচার করে দেয়। হজরত ইমাম হাসান (রা.) এখানে একদিন অবস্থান করেন। এসময় তিনি প্রদত্ত ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন; ‘আমি স্পষ্ট দেখছি তোমাদের মধ্যে অধিকাংশ যুদ্ধ হতে বিরত থেকে দুর্বলতার পরিচয় দিচ্ছো। তাই তোমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি তোমাদের জোর জবরদস্তি করতে চাই না’।
ইমামের এ বক্তব্য শুনার পর লোকেরা একে অপরের দিকে তাকাতে থাকে। খারেজী ও মোনাফেকরা বলতে শুরু করে যে, হজরত ইমাম হাসান (রা.) মোআবিয়া (রা.)-এর সাথে সন্ধি করতে চান এবং তারা একই সাথে তাঁর প্রতি কোফরের ফতোয়া ঘোষণা করে। কোফরের ফতোয়ার ফলে সৈন্যদের মধ্যে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। তারা পালাতে থাকে। একটি দল হজরত ইমাম হাসান (রা.) কে ‘কাফের’ আখ্যায়িত করে তাঁর তাবুতে ঢুকে পড়ে এবং তাঁর শরীরের পোশাক ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে এবং হাতের কাছে যা কিছু ছিল সব কিছু লুট করে নেয়। ইমাম একটি ঘোড়ায় আরোহণ করেন এবং হামদানের গোত্রগুলোর প্রতি সাহায্যের আহ্বান জানান। তারা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে এবং গুন্ডা, বদমাশদেরকে বিতাড়িত করে দেয়। গন্ডগোল, হাঙ্গামা থেমে যাওয়ার পর ইমাম মাদায়েনের দিকে যাত্রা করেন। পথে জাররাহ ইবনে কাবিসা নামক এক খারেজী ইমামের প্রতি বর্ম নিক্ষেপ করলে তা উরুতে ভেদ করে। আক্রমণকারী খারেজীকে লোকেরা ধরে হত্যা করে। অতঃপর ইমামকে মাদায়েনের ‘কাসরে আবিয়াদে’ নিয়ে যাওয়া হয় এবং ক্ষত শোকানো পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থান করতে থাকেন।
আঘাতপ্রাপ্ত ইমামের ক্ষত শোকানের পর তিনি শুনলেন যে, উবায়দুল্লাহ ইবনে আমেরের নেতৃত্বে সিরীয় বাহিনী মাদায়েনের নিকট এসে অবস্থান নিয়েছে। হজরত ইমাম হাসান (রা.) মোকাবিলা করার জন্য বের হন। উবায়দুল্লাহ ইবনে আমের নিকটে পৌঁছে ইরাকবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেন; ‘আমি যুদ্ধ করতে আসিনি। আমীর মোআবিয়া (রা.) বিরাট বাহিনীসহ আম্বারে অবস্থান করছেন এবং আমি তার অগ্রগামী দলের নেতা। তোমরা আমার পক্ষ হতে হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর খেদমতে সালাম জানানোর পর নিবেদন পেশ করবে যে, উবায়দুল্লাহ বলেছে, আল্লাহর ওয়াস্তে যুদ্ধ হতে বিরত থাকুন, যাতে ধ্বংস হতে রক্ষা পাওয়া যায়।’
হজরত ইমাম হাসান (রা.) এ বার্তা শ্রবণ করে মাদায়েনে প্রত্যাবর্তন করেন এবং উবায়দুল্লাহর নিকট খবর পাঠান যে, ‘নিম্নে বর্ণিত শর্তগুলোর ভিত্তিতে আমীর মোআবিয়া (রা.)-এর সাথে আমি সন্ধি করতে এবং খেলাফত হস্তান্তর করতে প্রস্তুত’। শর্তগুলো হচ্ছে;
‘১. আমীর মোআবিয়ার (রা.) কিতাব ও সুন্নাতের অনুসরণ করে চলবেন, ২. পুরাতন শত্রæতাকে ভুলে যাবেন এবং কারও জানমালের ওপর হস্তক্ষেপ করবেন না এবং ৩. আমাদের পক্ষের লোকদের জানমালের নিরাপত্তার অঙ্গীকার করবেন।’ ইমামের এসব শর্ত আমীর মোআবিয়া (রা.)-এর নিকট পেশ করা হলে। তিনি সবগুলোই অনুমোদন করেন এবং বলেন, ‘হজরত ইমাম হাসান (রা.) তাঁর আরও শর্ত থাকলে পেশ করতে পারেন, আমি সবই মেনে নেব’। অতঃপর হজরত ইমাম হাসান (রা.) সন্ধিনামা লিখে আমীর মোআবিয়া (রা.)-এর নিকট প্রেরণ করেন। তিনি তা দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হন। অতঃপর ইমাম মিম্বর হতে অবতরণ করা মাত্র আমীর মোআবিয়া (রা.) তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন; ‘হে আবু মোহাম্মদ! আজ আপনি এমন বীরত্ব দেখালেন যা আজ পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারেনি’। এই ঘটনার মাধ্যমে অবসান ঘটে ৩০ বছর ব্যাপী খেলাফতে রাশেদার এবং সূচনা হয় ‘উমাইয়া’ রাজত্বের। মাহে রমজানের দ্বিতীয় দশকে জন্মগ্রহণকারী হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর পূত-পবিত্র জীবনাদর্শ গ্রহণ করে চলা মুসলমানদের কর্তব্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।