পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া হয়, যারা রাজনীতির সাথে যুক্ত, তাদের আদর্শ ও লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন হলেও জনগণের কল্যাণেই নিবেদিত। মানুষের জীবনযাপন এবং মৌলিক অধিকার রক্ষা ও সুখে-দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়েই রাজনীতিতে তাদের আগমণ। জনসাধারণ যদি মনে করে, এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ তাদের কল্যাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে, তবেই তারা রাজনীতিবিদদের সমর্থন দেয় এবং ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায়। ক্ষমতাসীন হয়ে একজন রাজনীতিবিদ যখন জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে সমর্থ হন, তবে তিনি তাদের নেতা বা প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এটা হচ্ছে রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয় যে সবসময় ঠিক থাকে তা নয়। বিশেষ করে আমাদের দেশে যেখানে গণতন্ত্র পুরোপুরি ভিত্তি লাভ করেনি, গণতান্ত্রিক ধারা বারবার হোঁচট খায়, সেখানে কোন একটি দল বা জোট ক্ষমতাসীন হলে তারা সহজে ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। ক্ষমতায় থাকার জন্য নানা ফন্দিফিকির করে। জনগণের রায় পাল্টে দেয়া ও উপেক্ষার প্রচেষ্টা চালায়। ক্ষমতার মেয়াদ শেষের দিকে তারা হাইপারটেনশনে ভুগতে থাকে। ইলেকশন ভীতিতে আক্রান্ত হয়। এর ফলে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে না গিয়ে কীভাবে এবং কী করলে পুনরায় জয়লাভ করা যাবে, তা নিয়ে নানা অপকৌশল অবলম্বন করতে থাকে। এর মূল কারণ হচ্ছে, তারা নিজেরাও জানে, জনগণকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছিল, তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা উপলব্ধি করে জনগণ এবার আর তাদের ভোট দেবে না। তাদের মন্দ কাজের বিরুদ্ধে রায় দেবে এবং আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। এই আশঙ্কা থেকেই মেয়াদান্তে বিভিন্ন কৌশলে জনরায় কিভাবে ভিন্নভাবে প্রবাহিত করা যায়, এ নিয়ে কুরাজনীতি শুরু করে। অথচ এটা তো খুবই সাধারণ কথা, ক্ষমতায় থাকাকালে জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে ক্ষমতাসীন দল যদি সফল হয়, তাহলে মেয়াদ শেষে তার উপর ভরসা করে এবং নতুন প্রতিশ্রুতি দিয়ে পুনরায় নির্বাচনের মুখোমুখি হবে। জনগণও সন্তুষ্ট হয়ে তাদের আবার ক্ষমতাসীন করবে। মুশকিল হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল কোনোভাবেই জনগণের উপর এই ভরসা করতে পারছে না। সে যে উন্নয়নের জোয়ারের কথা বলছে, এর উপর নির্ভর করতে পারছে না। নির্ভর করতে পারলে নিশ্চয়ই আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াই চালাত। তা না করে সে এখন থেকেই নানা অপকৌশল ও তাদের তত্তে¡র গণতন্ত্রিক ধারা যা সর্বজন গ্রহণযোগ্য নয় সে ধারা অবলম্বন করে নির্বাচন করতে চায়। এটা করতে চায়, তার বিজয় নিশ্চিত করার জন্য। অর্থাৎ গণতন্ত্র থাক না থাক, যে কোনো উপায়ে তাকে ক্ষমতায় আসতেই হবে। এই যে কোনো উপায়কে ঢেকে দেয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মুখে এখন গণতন্ত্রের কথা বেশ জোরেসোরে শোনা যাচ্ছে। অথচ যখন তাদের শাসনকে জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠান স্বৈরশাসন হিসেবে চিহ্নিত করে, তখন তাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা শুনলে যেন কেমন খটকা লাগে। প্রশ্ন জাগে, আসলে গণতন্ত্র কি! গণতন্ত্র আমরা বুঝি না, নাকি তারা বোঝেন না? গণতন্ত্র মানে কি এক ব্যক্তি বা একদলীয় শাসন কায়েম করা, নাকি অন্য কিছু? এমন এক দ্ব›েদ্ব পড়ে যেতে হয়। কেউ কেউ প্রায়ই উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ দিয়ে থাকেন। এ অনুযায়ী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। তারা এ কথা বলেন না, যেসব গণতান্ত্রিক দেশ আজ উন্নতির শিখরে, তারা উন্নত হয়ে জন্মায়নি। গণতন্ত্রের অবিরাম চর্চার মধ্য দিয়ে উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে সকল দল-মতের মধ্যে যে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহিষ্ণুতা ও সহবস্থান নিশ্চিত করতে হয়, এ সংস্কৃতি আমাদের রাজনীতি থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বিরোধী দল-মতকে অবজ্ঞা করার প্রবণতা শিকড় গেঁড়ে বসেছে। দমন-পীড়নের মাধ্যমে নিঃশেষ করে দেয়াই তার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন দল বরাবরই বুঝিয়ে দিচ্ছে, তার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে, কার্যকর বিরোধী দল থাকা চলবে না। তাদের শেষ করে দিতে হবে। শুধু তার সাথে তাল মিলিয়ে চলাদের নিয়ে নামকাওয়াস্তে একটি সংসদ হলেই চলবে। এ ধরনের এক অদ্ভুত গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠা করেছে ক্ষমতাসীন দল। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই অতিসাধারণ এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত। তারা সক্রিয় রাজনীতি থেকে বরাবরই দূরে থাকে। ভোটের সময় হলে ভোট দেয়। রাজনীতি আমার কাজ নয়, এ চিন্তা-ভাবনা নিয়ে জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাজনীতির মারপ্যাঁচে জড়াতে চায় না, উত্তাপও নিতে চায় না। কোন রকমে খেয়েপরে বেঁচে থাকাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। এই মনোভাব নিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও, সার্বিক রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির কারণে যখন দেখে কোন রকমে খেয়েপরে বেঁচে থাকার নীতিতে টান ধরেছে, তখনই তাদের টনক নড়ে। ভর মৌসুমে যখন ২০-২৫ টাকার শাক-সবজির ৫০-৬০ টাকায়, ২৫ টাকার পেঁয়াজ ৬০-৮০ টাকায় কিনতে হয়, তখন কারণ খোঁজে। খুঁজতে গিয়ে রাজনীতির দিকে দৃষ্টিপাত করে। যে কোন উপায়ে ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি তাদের দৃষ্টি গোচর হয়। ক্ষোভ জন্মায়, আক্ষেপ বাড়ে। প্রতিকার না পেয়ে মুখবুঁজে সহ্য করে। কার কাছে প্রতিকার চাইবে। প্রতিকারের দায়িত্ব যাদের, ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে সাধারণ মানুষের দিকে তাদের তাকানোর সময় কোথায়! গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখা হচ্ছে বলতে বলতে গণতন্ত্রের মূলশক্তি সাধারণ মানুষের কথাই বেমালুম হয়ে গিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের এই কীর্তি এবং বিরোধী দলের প্রতিকার ও প্রতিবাদ করার কর্মসূচি না দেখে সাধারণ মানুষ এখন রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে।
দুই.
ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিদের মুখে গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নের ফিরিস্তি বেশি শোনা যায়। ভোটের অধিকার নিশ্চিতের কথা তারা এখন আর বলে না। উন্নয়নের ধোঁয়া তুলেই মানুষের মন জয় করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ধোঁয়া যাতে দূর করতে না পারে তার কৌশলও নিয়েছে। ক্ষমতাসীন দল মনে করছে, তার এই লক্ষ্য পূরণের পথে মূল বাধা প্রধান বিরোধী দল। কাজেই তাকে নির্মূল করতে হবে। ক্ষমতাসীন দল এ নীতি অবলম্বন করতে গিয়ে যা ঘটাচ্ছে, তা বোধ করি বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। ক্ষমতাসীন দল যে উন্নয়নের কথা বলছে, এটা বলার কি প্রয়োজন আছে? সাধারণ মানুষ তো জানেই, ক্ষমতায় যে দল থাকবে তার কাজ হচ্ছে দেশের ও মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন করা। এটা তার বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। এ দায়িত্বের কথা এত ঢাকঢোল পিটিয়ে করার দরকার কি! উল্লেখ করা প্রয়োজন, চরম স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের অধীনেও উন্নয়ন থেমে থাকে না। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়। তার মানে এই নয়, তার দুঃশাসন মেনে নিতে হবে। কাজেই কোনো সরকার যখন গণতন্ত্রের ধার না ধেরে কেবল উন্নয়নের কথা বলে তখন বুঝতে হবে, গণতান্ত্রিক উপায়ে নয়, উন্নয়নের ছুঁতোয় সে যেনতেনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাচ্ছে। অথচ ক্ষমতাসীন দলের ভাল করেই জানা, আমাদের দেশের মানুষ গণতন্ত্র বাদ দিয়ে শুধু উন্নয়নে খুশি হয় না। খুশি হলে আইয়ুব খানকে ক্ষমতা ছাড়তে হতো না। আর আমাদের জনগণের কাছে যে জীবনের চেয়েও গণতন্ত্রের মূল্য অনেক বেশি মূল্যবান, তা স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায় বলেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। তারা জানে, গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা থাকলে উন্নয়ন-অগ্রগতি এমনিতেই হয়। আবার এ কথাও সত্য, মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে অভাব-অনটন দূর হওয়ার পাশাপাশি জীবন যত উন্নত হয়, মানুষের গণতন্ত্রের আকাঙ্খাও তত তীব্র হয়। তখন গণতন্ত্রই তাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠে। গণতন্ত্রহীন উন্নয়ন তাদের কাছে কখনোই কাঙ্খিত নয়। তারা গণতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্য দিয়েই উন্নয়নকে অধিক শ্রেয় মনে করে। রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির প্রতি সাধারণ মানুষের অনীহা বরাবরই রয়েছে। এর ফলে উদ্ভুত রাজনৈতিক যে সংঘাত ও সংঘর্ষ চলছে, তাতে রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষকে ক্রমেই প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আবার এ থেকে উত্তরণের পথও তাদের সামনে খোলা নেই। ফলে অসহায় হয়ে বসে থাকা ছাড়া তাদের করার কিছু থাকছে না। তারা এক ধরনের ভলিবল খেলার মধ্যে পড়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দল বলছে জনগণ তাদের সাথে আছে। আন্দোলনরত বিরোধী দলও বলছে জনগণ তাদের সাথে আছে। জনগণ যে কোন দিকে আছে, তা বোঝার কোন উপায় নেই। একটি উপায় হতে পারে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। যেখানে জনগণ তার মতামত স্বাধীনভাবে দিতে পারবে। এ পথটি এখন রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। আন্দোলনরত বিরোধী দল এ পথের দাবিতে আন্দোলন করলেও, ক্ষমতাসীনরা তা পাত্তাই দিচ্ছে না। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য একধরনের জবরদস্তিমূলক পথ অবলম্বন করে চলেছে। যেমনটি করেছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনিও তার শাসনামল গণতন্ত্রের কথা বলেই চালিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তার এই কথিত গণতন্ত্র টিকেনি। তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। দুঃখের বিষয়, সেই এরশাদকেই প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়ে বলতে শোনা গেছে, বর্তমান সরকার আমার চেয়েও বড় স্বৈরাচার। অবশ্য প্রকারন্তরে এরশাদ নিজে যে স্বৈরাচার ছিলেন তা স্বীকার করে সততার পরিচয় দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সরকার যদি আত্মবিশ্বাসী ও জনসাধারণের প্রতি আস্থাশীল হয়, তবে তারা নির্বাচনের মাধ্যমে জনরায় নেয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে যারা সরকার পরিচালনা করে, তারা তাদের প্রতি জনগণের আস্থা অটুট রয়েছে কিনা, তা টেস্ট করার জন্য স্বেচ্ছায় মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে থাকে। এতে তারা কখনো জয়ী হয়। কখনো পরাজিত হয়। পরাজিত হলে জনরায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজ থেকেই ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের এই চর্চা অতীতে কখনো হয়নি, এখনো হচ্ছে না। ভবিষ্যতে হবে কিনা, তাও নিশ্চিত নয়।
তিন.
দেশের মানুষ যে এখন নিদারুণ পেরেশানিতে রয়েছে, তা প্রতিদিনের পত্র-পত্রিকায় তাদের জীবনের টানাপড়েনের চিত্র দেখে বোঝা যায়। চরম দুর্ভোগের মধ্যে তাদের দিন কাটছে। রাজনীতির যাতাকলে পিষ্ট হয়ে তাদের জীবনযাপন দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। দেশ উন্নয়নের স্বর্ণশিখরে অবস্থান করছে। অথচ কী উন্নয়ন হচ্ছে, তা মাঝে মাঝে পত্র-পত্রিকাগুলো কোথা থেকে কী এনে তাতে যেন পানি ঢেলে দেয়। এই যেমন একটি পত্রিকা গত সপ্তাহে একেবারে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলায় গরিব লোকের সংখ্যা বাড়ছে। জেলাগুলো হচ্ছে, কুড়িগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট। এর মধ্যে আবার কুড়িগ্রামে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭১ জনই গরিব। অথচ সরকার কিন্তু খুব গর্ব করে বলছে, উত্তরবঙ্গের মঙ্গা সে দূর করে ফেলেছে। সেখানে মঙ্গা বলে কিছু নেই। পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বছরওয়ারি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে যে জেলাগুলোতে প্রতি বছরই গরিব মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস-এর হিসাব অনুযায়ী, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৯৩ লাখ। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশে দরিদ্র সংখ্যা আরও বেশি। সংখ্যাটি ৫ থেকে ৬ কোটি হবে। অর্থাৎ দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষ অতি দরিদ্র রয়ে গেছে। তাহলে সরকার যে উন্নয়নের ফানুস উড়াচ্ছে, তা যে এক ধরনের প্রহেলিকা ছাড়া কিছু নয়, তা সাধারণ মানুষের আর্থিক টানাপড়েন এবং দারিদ্রতা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। সরকার দেশের উন্নতি দেখছে ধনীদের আরও উন্নতির সূচক দিয়ে। জিডিপির প্রবৃদ্ধিও দেখাচ্ছে ধনীদের আয় ও সম্পদ দিয়ে। এই জিডিপির মধ্যে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষগুলো নেই। জিডিপিতে তাদের অংশ মিটিয়ে দিচ্ছে ধনীদের অংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের সব মানুষের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ আয় করে ১০ শতাংশ ধনী মানুষ এবং বেশির ভাগ সম্পদই তাদের অধীনে। অর্থাৎ সরকার দেশের উন্নয়ন দেখাচ্ছে ধনীদের আয় ও উন্নতির সূচকের মাধ্যমে। সাধারণ মানুষ পড়েছে বিপাকে। কারণ সরকার তাদের কথা শোনার প্রয়োজন মনে করছে না। সরকারের উন্নয়নের সূচক দেখানোর দরকার সে তা তাদের বাদ দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ চলমান পরিস্থিতিকে যে দুঃস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেবে, তার কোন জো নেই। তারা ঘুমেও দুঃস্বপ্ন দেখছে, বাস্তবেও তার মুখোমুখি হচ্ছে। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে যখন খরচ বাঁচাতে বড় ফ্ল্যাট ছেড়ে ছোট বাসা ভাড়া নিতে হয়, তখন এটা তার কাছে দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কি হতে পারে! পর্যবেক্ষকরা স্পষ্টতই বলছেন, এখন মানুষের কাছে খরচ কমানো অটোমেটিক চয়েস হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষকে বাধ্য হয়ে তাদের খরচ কমাতে হচ্ছে এবং তারাই বেশি দুঃসময়ের শিকার। মধ্যবিত্তরা খরচ বাঁচানোর জন্য জীবনধারণের উপকরণ ছাড়া ফ্যাশন বা সৌখিন খাতের ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। তাদের অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে যে, খেয়েপরে বেঁচে থাকাই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি মধ্যবিত্ত শ্রেণী। ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংকের এক হিসাব অনুযায়ী, দেশে জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ বা ৩ কোটি মধ্যবিত্ত রয়েছে। এই মধ্যবিত্ত জনসংখ্যা গত এক দশক ধরে জিডিপিতে ৬ শতাংশের বেশি ভূমিকা রেখে চলেছে। এখন এই সংখ্যাটি কতটা এবং কী হারে বেড়েছে তার হিসাব করা দরকার। তবে হিসাব করলে নিশ্চিতই দেখা যাবে, অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার নি¤œবিত্তে পরিণত হয়েছে। ধনী শ্রেণী আরও ধনী হয়েছে। জিডিপিতে মধ্যবিত্তের অবদান কমে তার জায়গা পূরণ করছে অল্প সংখ্যক ধনী মানুষ। অর্থাৎ দেশে মানুষের মধ্যে আয়ের বৈষম্য আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। একেই যদি উন্নয়ন বলা হয়, তবে সরকার বলতে পারে। তবে এটা ঠিক, সরকারের এই উন্নয়নের ফানুস সাধারণ মানুষ বুঝতে পারলেও, তাদের কিছু করার নেই।
চার.
এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, মেধাবী তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কত সংখ্যক দেশ ছাড়ছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও তা যে বছরে কয়েক হাজার হবে তাতে সন্দেহ নেই। এসব তরুণ অনেকটা স্থায়ীভাবেই দেশ ছাড়ছে। এর মূল কারণ হিসেবে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি, অপশাসন, সুশাসন এবং অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের অভাবের কথা বলা হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, মেধাবীদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা হচ্ছে, দেশকে মেধাশূন্যতার দিকে ঠেলে দেয়া। এ প্রক্রিয়া বহু বছর ধরে চললেও ক্রমাগত রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও অস্থিতিশীলতা তা ত্বরান্বিত করেছে। যে মেধাবী তরুণদের দেশের ভবিষ্যত এবং রাজনীতিকে সঠিক ধারায় প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা, তারা যদি দেশ ত্যাগ করে, তবে রাজনৈতিক চলমান অপসংস্কৃতি যে আরও খারাপের দিকে যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। যারা যেতে পারে না তারা রাজনীতির এক গভীর সংকটতম সময়ে পড়ে হতাশ ও হতোদ্যম হয়ে পড়ছে। সাধারণ মানুষ এই রাজনীতির শিকার হয়ে চরম দুঃসময়ে পড়েছে। তারা না পারছে কিছু বলতে, না পারছে সইতে। তাদেরকে এই অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলেই অর্থমন্ত্রীকে সহাস্যে বলতে শোনা যায়, ‘দেশে গত দশ বছরে জিনিসপত্রের দাম বাড়েনি।’ তার এ কথার প্রতিবাদ করবে কে? যারা প্রতিবাদ করবে তাদেরকে সরকার স্টিম রোলার চালিয়ে পিষ্ট করে রেখেছে। ফলে সাধারণ মানুষকে মুখ বুজেই সব সয়ে যেতে হচ্ছে। আর শুনতে হচ্ছে উন্নয়নের জোয়ারের কথা। এ অবস্থার মধ্যেই ক্ষমতাসীন দল সাধারণ মানুষের কাছেই ভোট চাইছে। ক্ষমতাসীন দলের এ আচরণ দেখে সাধারণ মানুষের মনে একটি গল্পই বারবার পড়ার কথা। গল্পটি হচ্ছে এরকম- এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি কাদাযুক্ত পথ পাড়ি দেয়ার জন্য এক গরিব মানুষের ঘাড়ে চড়ে বসে। গরিব ব্যক্তিটির গলা সে এমনভাবে প্যাঁচিয়ে ধরে যে তার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তারপরও সে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি দরিদ্র ব্যক্তিটির ঘাড়ে আরাম করে বসে আফসোস করে বলছে, আহা, তোমার কী কষ্ট হচ্ছে, আমি খুবই দুঃখিত। তুমি চিন্তা করো না, আমি নিশ্চয়ই তোমার দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেব, শুধু এবারের মতো আমাকে এই পঙ্কিল পথটুকু বহন করে নিয়ে যাও। আমাকে তোমার ঘাড় থেকে নামিয়ে দিও না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।