Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুন্দরবন রক্ষা করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সুন্দরবনের স্পর্শকাতর অঞ্চলে বৃহদাকার কয়লাবিদ্যুত প্রকল্প নির্মানসহ সেখানে অব্যাহতভাবে ভারী শিল্পকারখানার অনুমোদন বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রামপাল কয়লাবিদ্যুত প্রকল্পে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিবরণ তুলে ধরে সরকারের পক্ষ থেকে সাফাই গাওয়া হলেও আদতে সুন্দরবনের বিপর্যয় রোধ করা যাচ্ছেনা। রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র বাস্তবায়িত হওয়ার ১০-২০ বছর পর এর পরিবেশগত প্রভাব কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা অনুমান করা কঠিন নয়। সেখানে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মানসহ ভারী শিল্পকারখানা গড়ে উঠার কারণে এখনি যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে সুন্দরবনের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিঘœ হওয়ার যথার্থ কারণ রয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের উপর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নজরদারি ও আগ্রহ দেখা যায়। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য এবং বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে রামসার কনভেনশনের তালিকাভুক্ত হওয়ায় সুন্দরবনের প্রতি আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদিদের নজরদারি থাকা স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশের জন্য সুন্দরবনের গুরুত্ব অনিবার্য ও বহুমাত্রিক। এক কথায় সুন্দরবন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক নিরাপত্তাব্যবস্থায় অন্যতম প্রতিরক্ষাবুহ্য হিসেবে গণ্য। বাংলাদেশের অতি ঘনবসতির বাস্তু ব্যবস্থা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাকৃতিক নিরাপত্তায় সুন্দরবনের নিরাপত্তা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সুন্দরবনের নিরাপত্তা প্রশ্নে কোনো ধরনের শৈথিল্য দেখানোর সুযোগ নেই। যে কোনো মূল্যে একে রক্ষা করতে হবে। কলকারখানা বন্ধ হলে তা পুনরায় গড়ে তোলা যায়, সুন্দরবন হারিয়ে গেলে, নতুন করে আরেকটা সুন্দরবন গড়ে তোলা কখনোই সম্ভব নয়। অথচ সুন্দরবনের ক্ষতি হয় বা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয় এমন কাজই বেশি করা হচ্ছে। এর চারপাশ ঘিরে যেভাবে কলকারখানা ও পরিশোধনাগার গড়ে উঠছে তা ক্রমেই এ বনের জন্য ফাঁস হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সম্প্রতি এক গবেষনায় সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমে বড় ধরনের কিপর্যয়ের চিত্র ফুটে উঠেছে। সুন্দরবনের সন্নিহিত অঞ্চলে অপরিকল্পিত শিল্পায়নে বিপদ সম্পর্কে দেশি-বিদেশী পরিবেশবাদিদের উদ্বেগ ও সতর্কতার বিষয়গুলো এই গবেষনা রিপোর্টে উঠে এসেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান শাখার অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত ৭ সদস্যের গবেষকদল ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে সুন্দরবনের ফ্লোরা, ফনা এবং ক্রমক্ষয়িষ্ণু প্রাকৃতিক পরিবেশের যে বিবরণ উঠে এসেছে তা খুবই উদ্বেগজনক। রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মান, সিমেন্ট কারখানা, রূপান্তরিত পেট্টোলিয়াম ও গ্যাস কারখানাসহ অসংখ্য ভারী শিল্পের বর্জ্য, কাঁচামাল পরিবহন এবং মালবাহী নৌ দুর্ঘটনায় ইতিমধ্যেই সুন্দরবন বড় ধরনের হুমকির সম্মুখীন। পানির স্বাভাবিক গুণাগুণ, জলজ ও বনজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর খাদ্যচক্রের ভিত্তিগুলো দ্রæত ধসে যেতে শুরু করেছে। গবেষণা রিপোর্টে পানির ফাইটোপ্লাঙ্কটন, জুপল্যাঙ্কটন ও বেনথোসের অপযার্প্ত উপস্থিতি ধরা পড়েছে। প্রাণী ও উদ্ভিদের খাদ্যচক্রে রাসায়নিক দূষণের ক্ষতি যে কোন প্রাকৃতিক বাস্তুব্যবস্থার জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়।
গবেষণা জরিপ চলাকালে সুন্দরবনের যে সব এলাকায় শিল্প কারখানা চালু হয়েছে এবং কারখানা চালুর আগের অবস্থার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান লক্ষ্য করেছেন গবেষকরা। শিল্পায়ণ শুরুর আগে যেখানে ৩০টির বেশী প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার পর সে মৎস্য প্রজাতির মধ্যে প্রায় ১০টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। অভিন্ন এলাকার শিল্পায়িত এলাকায় মাছের প্রজনন মৌসুমে যেখানে প্রতি লিটার পানিতে মাছের ডিমের সংখ্যা পাওয়া গেছে ১৭০০-২৪০০ সেখানে অশিল্পায়িত এলাকায় প্রতি লিটার পানিতে একই একই প্রজাতির মাছের ডিম পাওয়া গেছে ৬,৩০০ থেকে ৮,৭০০। এর কয়েক বছর আগের জরিপে এ সংখ্যা আরো বেশী ছিল বলে জানা যায়। দেশে বিনিয়োগ, শিল্পায়ণের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না। তবে সুন্দরবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয় এমন শিল্প যতই লাভজনক হোক তা নির্দ্বিধায় পরিত্যাজ্য। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার কারণে যেখানে আমাদের রাজধানী শহর এখন বসবাসের অযোগ্য শহরের বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষে অবস্থান করছে সেখানে অপরিকল্পিত শিল্পায়ণের ফলে আগামী দশকের শেষে সুন্দরবনের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে আশঙ্কা ও আতঙ্কিত হতে হয়। সুন্দরবনের পানি, মাটি ও বাতাসের গুণাগুণ ইতিমধ্যেই ব্যাপক হারে আক্রান্ত হয়েছে। রয়েলবেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, বিশেষ প্রজাতির ডলফিনসহ বেশ কিছু বন্য ও জলজ প্রানীর অস্তিত্ব ক্রমহ্রাসমান অবস্থায় পড়েছে। সুন্দরীগাছ, গোলপাতা, মৌমাছি, বিভিন্ন প্রজাতির পাখির অস্তিত্বও হুমকির মুখে রয়েছে। এহেন বাস্তবতা সামনে রেখে সুন্দরবন অঞ্চলে শিল্পকারখানাগুলো ব্যাঙের ছাতার মত দ্রæত বেড়ে চলেছে। যে সুন্দরবন সিডর-আইলার মত সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছাস থেকে আমাদের উপকূলীয় জনপদকে বারবার রক্ষা করেছে, লাখ লাখ মৎস্যজীবী, কাঠুরিয়া, মৌয়ালসহ নানা ধরনের পেশা ও কর্মসংস্থানের উৎসস্থল, তার ক্ষতি হয় এমন কর্মকাÐ বন্ধ করা অপরিহার্য। আমাদের জাতীয় অর্থনীতির বিশাল অবদান এবং গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সুরক্ষার এই আধারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন দ্রæত ও কার্যকরভাবে বন্ধ বা অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে। সুন্দরবনের ভেতর বাণিজ্যিকনৌ চলাচল নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সুন্দরবন

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন