Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং মাদকবিরোধী অভিযানের স্বরূপ

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৩১ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মানুষের সামাজিক-নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সূতিকাগার হচ্ছে আমাদের ভেঙ্গে পড়া ও লক্ষ্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা এবং এর গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এই মুহূর্তে আমাদের সামনে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষাব্যবস্থার সংকট, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, টাকা পাচারের নিয়ন্ত্রণহীন প্রতিযোগিতা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি সর্বোপরি মাদক সন্ত্রাস। এসব সামাজিক-অর্থনৈতিক উপদ্রব আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে দিতে চলেছে। রাষ্ট্রের আইন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচারিক আদালত এবং সামাজিক বন্ধনের পুরনো ঐতিহ্যগুলো এখন আর ব্যক্তির নিরাপত্তা দিতে পারছেনা। মানুষ ক্রমেই নিরাপত্তাহীনতার অনিশ্চয়তার গভীরে নিমজ্জিত ডুবে যাচ্ছে। আমাদের সরকার ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে দেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে, অন্যদিকে শাসকশ্রেনীর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় একশ্রেনীর মানুষ একেকটি স্থানীয় প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণরেখায় একচ্ছত্র ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের সমাজের উপর এই দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক প্রভাবশালী চক্রের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সামাজিক স্থিতিশীলতা ও নানা মতের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ ক্রমে সঙ্কুচিত হয়েছে। দেশের লাখ কোটি মানুষ নকোনোমতে প্রান নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে। ইউরোপ-আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ার মত দেশে সেকেন্ড হোম করার নামে প্রতিবছর দেশ থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে তার সিংহভাগ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে অর্জিত। এর বিপরীতে সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে নিরাপত্তাহীনতার শিকার হাজার হাজার স্বচ্ছল-সম্পদশালী মানুষও পুঁজি পাচার করে নিজেদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইছে। এহেন প্রক্রিয়াকে সমাজের সুবিধাভোগি কিছু ব্যক্তি ও পরিবার সীমিত আকারে নিরাপত্তার বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করলেও এর মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি ক্রমে দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। অস্থিতিশীলতা, সন্ত্রাস ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীন অবস্থায় সামাজিক-অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক প্রত্যাশিত উন্নয়ন অসম্ভব। প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তার প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। প্রায় সবগুলো সরকারী ব্যাংক দেউলিয়া অবস্থায় উপনীত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো জনগনের আস্থার সংকটে পতিত হয়েছে। ইতিবাচক ভ‚মিকা পালনের মধ্য দিয়ে সম্প্রতি পুলিশ বাহিনীর প্রতি জনগনের আস্থা অর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু পুলিশ বাহিনীর ক্ষেত্রেই নয় প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীর এমন আহ্বান সমভাবেই প্রযোজ্য। তবে জনগনের আস্থা অর্জনের এই প্রক্রিয়ায় প্রথম দায়িত্বটিই পালন করতে হবে দেশের প্রধান নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীকে। কারণ জনগনের আস্থাহীনতার শিকার হওয়া প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় মূলত রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণের শিকার।
দেশে এখন সর্বব্যাপী মাদক বিরোধী অভিযান চলছে। যুব সমাজের মাদকাসক্তি এখন আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে এ ধরনের অভিযানের প্রতি দেশের সচেতন নাগরিক সমাজের অকুণ্ঠ সমর্থন থাকার কথা। চলমান মাদক বিরোধী অভিযানের প্রতিও সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকা স্বাভাবিক। তবে বিগত সময়ের জঙ্গি বিরোধী অভিযানের মত চলমান মাদক বিরোধী অভিযানও ইতিমধ্যে অপরাজনীতির পাঁকে তার লক্ষ্য হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে। একদিকে সর্ষের ভেতর ভুতের আছর, অন্যদিকে অভিযানকে মোটা অংকের চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হীন ষড়যন্ত্রমূলক কাজে ব্যবহারের নানাবিধ প্রবণতা ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে। আমাদের সমাজ প্রগতি ও আগামী দিনের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করতে মাদকের মত প্রতিবন্ধকতা শেকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলার কোন বিকল্প নাই। এই বিকল্পহীন তৎপরতাকে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে অপব্যবহারের যে কোন দৃষ্টান্ত সমাজে আরো বড় ধরনের সংকটের জন্ম দিতে পারে। মাদকের বিরুদ্ধে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিরো টলারেন্স মানে হচ্ছে, ব্যক্তি যেই হোক, মাদক ব্যবসায় তার সম্পৃক্ততা প্রমানিত হলে তাকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে কারো পক্ষে বছরের পর বছর ধরে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আন্ত:সীমান্ত মাদক চোরাচালান থেকে শুরু করে মাদক বিক্রির প্রতিটি স্তর এবং ট্রানজিট পয়েন্টে মাদক চক্রের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেনীর সদস্যের যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। গত রবিবার রাজধানীর কয়েকটি বস্তিতে পুলিশের মাদক বিরোধী অভিযানে বেশ কয়েকশ ব্যক্তি আটক হয়েছে। এর মধ্যে কারওয়ান বাজার বস্তিতে অভিযান চলাকালে পুলিশ মাদক বিক্রেতা হিসেবে এক ষাটোর্ধ মহিলাকে আটক করলে উক্ত মহিলা গণমাধ্যম কর্মীদের সামনেই অভিযানের আগে মাদক বিক্রেতাদের সরে যেতে পুলিশের আগাম বার্তা দেয়ার তথ্য ফাঁস করে দেন। অভিযান চালিয়ে প্রকৃত মাদক চক্রকে গ্রেফতার করার বদলে অভিযান চালানোর আগে তাদেরকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়ার মধ্য দিয়ে অনেক কিছুই বুঝা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক বিরোধী অভিযানকে পুঁজি করে পুলিশের একশ্রেনীর সদস্য দায়মুক্তির বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ গণমাধ্যমের কল্পকাহিনী নয়। এমন একটি বিকল্পহীন অভিযানকে প্রশ্নবিদ্ধ ও ব্যর্থ করে দিতে সংশ্লিষ্টদের এহেন কর্মকান্ড যথেষ্ট। মাদক বিরোধী অভিযানে কথিত মাদক বিক্রেতাদের ধরা বা নির্মূল করার পাশাপাশি সর্ষের ভেতরের ভুতগুলোর প্রতিও জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন থাকতে হবে। তাদের কারণে মাদক নির্মূলের নামে কথিত বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ারে বিচার বহিভর্’ত হত্যাকান্ডকে দেশের মানুষের আস্থার সংকট তৈরী হয়েছে। মাদক বিরোধি অভিযানকে পুলিশের টাকা কামানো এবং প্রভাবশালী মহলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ন্যুনতম সম্ভাবনা থাকলে অভিযানের গতিপ্রকৃতি ও সময়সীমা পরিবর্তন করে নতুনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বর্তমানে দেশে ইয়াবার মত মাদক মহামারির মত ছড়িয়ে পড়েছে। কক্সবাজারের মিয়ানমার সীমান্ত হচ্ছে ইয়াবা পাচারের মূল রুট। কক্সবাজারের রাজনৈতিক মঞ্চে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে মাদক ব্যবসায় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নাম এমনভাবে কখনো উঠে আসেনি। বর্তমানে সেখানকার একজন এমপির নাম যেভাবে উচ্চারিত হচ্ছে, এমনটা আগে কখনো শোনা যায়নি। মানুষের মুখে মুখে ও জনগনের পারসেপশন কোন মিথ নয়, তিনি মিডিয়ার অপপ্রচারের শিকার এমনটাও মনে করার কোন কারণ নেই। মাদক বিরোধী অভিযানে ইতিমধ্যে নিহতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে ১২ হাজারের বেশী। বেশীরভাগই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তবে এদের অনেকের কব্জা থেকে কমবেশী মাদক উদ্ধার করা হলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ব্যক্তির বন্দুকটি খুঁজে পাওয়া যায়না কেন! এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, মাদকের পাশাপাশি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র আমাদের সমাজব্যবস্থা ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য অনেক বড় হুমকি। মাদক ব্যবসা ও মাদক চোরাচালান বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের চোরাচালান, বিক্রয় এবং ব্যবহারের বিরুদ্ধে আরো বড় আকারের অভিযান পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন। মাদক বিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সন্দেহভাজনদের মৃত্যুর ঘটনাগুলো সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য না হলেও এসব ঘটনা এটাই প্রমান করে, মাদক বিরোধী অভিযানের চেয়ে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বেশী ভয়ানক। মাদক বিরোধী অভিযানের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান এবং অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মূলোৎপাটনের উদ্যোগ নেয়া হলে মাদক বিরোধী অভিযান আরো বেশী সহজ ও সফল হতে পারত। জঙ্গি বিরোধী অভিযান, মাদক বিরোধী অভিযান বা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের মত অভিযানকে যদি সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে এবং একশ্রেনীর পুলিশ সদস্যের রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার রাস্তা হয়ে উঠে তাহলে এসব অভিযানে জঙ্গিবাদ, মাদক বা অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। অভিযানকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিনত করার পরিনাম আরো বেশী ভয়ঙ্কর ও দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। পুলিশের গোয়েন্দা তথ্যে সারাদেশের মাদক বিক্রেতা, অবৈধ অস্ত্রধারি ও অস্ত্র ব্যবসার সাথে জড়িতদের তালিকা আছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এই তালকা হালনাগাদ করাও কোন কঠিন কাজ নয়। ডাকঢোল পিটিয়ে অভিযান পরিচালনার চেয়ে তালিকা ধরে ধরে উদ্ধার অভিযানে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী। মাদক বিরোধী অভিযানকে ঘিরে এই মুর্হূতে দেশে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। ইতিমধ্যেই বন্দুকযুদ্ধের নামে নিরপরাধ সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী হত্যার অভিযোগ উঠেছে। ইউনুস আলী নামের এক ব্যক্তি কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর তার চারটি নিস্পাপ শিশু সন্তানের কান্না-আহাজারির ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। অথচ সারাদেশে চিহ্নিত মাদক সম্রাটদের কেউ ক্রসফায়ারে নিহত হয়নি। যত বড় সন্ত্রাসী বা অপরাধী হোক, বিচারের মাধ্যমে তার সর্বোচ্চ শাস্তিই কাম্য। বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের নামে কাউকে বিচারহীনভাবে হত্যা কোন সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। মাদক অভিযানের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারীদলের সাথে সংশ্লিষ্ট একশ্রেণীর নেতার ভিন্ন গেমপ্লানের কথাও ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়ে গেছে। সর্বশেষ সড়ক ও সেতুমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হুমকি দিয়ে বলেছেন, মাদক ব্যবসার নামে নিরীহদের ফাঁসানোর চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। মাদক বিরোধী অভিযানের নামে একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর নানা রকম কারসাজি দেখেই হয়তো তিনি এমন মন্তব্য করেছেন। গত কয়েক বছরে বিএনপি নেতাকর্মীদের নিস্ক্রীয় করে দলকে দুর্বল করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মামলা দিয়েছে। সন্ত্রাস, বাসে অগ্নিসংযোগ, চুরি, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, মাদক, অবৈধ অস্ত্র, বিস্ফোরক ও খুনের মামলাপ্রাপ্ত বিরোধিদলের হাজার হাজার নেতাকর্মী এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। নেত্রকোনায় পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ছাত্রদল নেতা আমজাদ হোসেন নিহত হওয়ার পর পুলিশ তাকে মাদক ব্যবসায়ী বলে দাবী করলেও নিহতের পরিবার এবং দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ তোলা হয়েছে। মামলায় জর্জরিত রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে লাখ লাখ টাকার গোপন লেনদেন হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
বিগত সময়ে দেশে জঙ্গি বিরোধী অভিযানের মোড়কে রাজনৈতিক ব্লেইম গেমের পাশাপাশি বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার হয়রানির এন্তার অভিযোগ উঠেছিল। একইভাবে গ্রেফতারবাণিজ্য ও গোপন লেনদেন বা পণবাণিজ্যও হয়েছে বিস্তর। তবে এসব অভিযোগের সত্যাসত্য উদঘাটনে কখনো কোন তদন্ত বা প্রামান্য তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়না। পুলিশ ও বিশেষ বাহিনীগুলোর অপরাধের অভিযোগ তদন্তে দেশে শক্তিশালী নিরপেক্ষ কোন সংস্থাও গড়ে তোলা হয়নি। এরপরও প্রতিবছর নানা অপরাধে পুলিশের বিভাগীয় ব্যবস্থায় গড়ে ১০ হাজারের বেশী পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহিত হচ্ছে। এত বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেনীর সদস্যদের অপরাধ প্রবণতা মোটেও কমছেনা। গুরুতর অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে দায়সারা গোছের লঘুদন্ড দেয়ার কারণেই পুলিশ সদস্যের বিভাগীয় শাস্তি তাদের অপরাধ প্রবণতা কমাতে ভ’মিকা রাখছেনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক), বিচার বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি ও অপরাধপ্রবণতাকে সর্ষের ভুত হিসেবে অভিহিত করা যায়। এসব সেক্টরের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলার পেছনে কাজ করছে একচ্ছত্র রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ। পুলিশ ও আমলাতন্ত্রে দলীয় নিয়োগের ফলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, পেশাদারিত্ব এবং চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে পড়ায় সরকারের কর্মকান্ড,আইনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার উপর তার বিরূপ প্রভাব অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ এখন পুরো সমাজব্যবস্থাকেই গিলে খেতে বসেছে। সারাদেশে হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থানীয় প্রশাসন থেকে ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত এখন একশ্রেনীর টাউট ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীর প্রভাববলয়ের শিকার হয়ে পড়েছে। স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তৃণমূলের সামাজিক প্রতিষ্ঠান, গ্রাম্য বিচার ও শালিসব্যবস্থার উপর একশ্রেনীর রাজনৈতিক প্রভাবশালীর নীতিহীন প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে দেশে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সুশাসনের অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিস্তার এখন গুরুতর নানামাত্রিক সামাজিক সমস্যার জন্ম দিয়েছে। দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থান না পেয়ে হতাশ ও অপসংস্কৃতির শিকার যুব সমাজের লাখ লাখ সদস্য যেনতেন প্রকারে দেশত্যাগ করতে চায়। বিগত দশকের প্রথম দিকে দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল। সে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি, সামাজিক-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়গুলো বার বার আলোচিত হলেও অবস্থার পরিবর্তনে কোন রাজনৈতিক উদ্যোগ নেয়া হয়নি। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, নানা মতের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সহাবস্থানের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে বেপরোয়াভাবে রুদ্ধ করা হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশের যুব সমাজ এবং বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের উপর। নিরাপত্তাহীনতা ও রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ জঙ্গিবাদ ও মাদকের জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্রে পরিনত করছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে শত শত বাংলাদেশী তরুণের সমুদ্রে সলিল সমাধী, বিদেশী কোস্টগার্ডের হাতে আটক হওয়া, বিদেশে জঙ্গলে গণকবর, মানব পাচারকারী চক্রের হাতে ক্রীতদাসে পরিনত হওয়ার লজ্জাজনক খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়েছে।
আমাদের সরকার দেশকে সব নাগরিকের জন্য নিরাপদ ও বাসযোগ্য করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বদলের তথাকথিত উন্নয়নের পরিসংখ্যান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক মানদন্ডে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি পেয়ে আমরা যখন বগল বাজাচ্ছি, তখন বাংলাদেশের রাজধানী বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকার শীর্ষে স্থান পাচ্ছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রায় সবগুলো আন্তজার্তিক সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করছে। দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিপরীতে জননিরাপত্তা ও মানবাধিকারের গ্যারান্টি নিশ্চিত না করে শুধুমাত্র পরিসংখ্যানগত অর্থনৈতিক উন্নয়নের দাবী দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছেনা। মাদকের গডফাদার ও মাদক সম্রাটদের তালিকা দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আছে। সীমান্তের যে সব স্পট ও বন্দর দিয়ে দেশে মাদক প্রবেশ করছে তা’ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অজানা নয়। তাহলে মাদক নির্মূল নিয়ে এমন ডাকঢোল, হইচইয়ের কারণ কি? মাদকের গড ফাদাররা সব সময়ই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকছে। পুলিশকে মাসোহারা দেয়া খুচরা মাদক বিক্রেতারা অভিযানের আগে বার্তা পেয়ে যাচ্ছে। যারা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছে, আটক ও তালিকাভুক্ত হিসেবে জীবন সংশয়ের মধ্যে রয়েছে তাদের অনেকেই নাকি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও অপপ্রচারের শিকার। যুব সমাজকে মাদকের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে সত্যিকার অর্থেই ব্যাপক আকারের মাদক বিরোধী অভিযানের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না। তবে এ অভিযানকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করা হলে তা’ সমাজে ও রাজনীতিতে বড় ধরনের ক্ষত ও অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন