Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

এ জার্নি বাই বাস

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ২২ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সড়ক মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের গতি-প্রকৃতি দেখে বোঝা যায় দেশ কতটা এগিয়ে গেছে। এটা বিজ্ঞজনদের কথা। সড়ক পথে চলাফেরা করতে গিয়ে বোঝার উপায় নাই আমরা এগিয়ে গেছি নাকি পিছিয়ে পড়ছি। মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করেছি। দেশের সবকিছুই চলছে ডিজিটালে। দেশের সড়ক পথে পড়তে হচ্ছে হয় যানজট যন্ত্রণায়; নয়তো দুর্ঘটনার মৃত্যুফাঁদে। মহাসড়কের যানজট নামের এই মহাযন্ত্রণার অবসান হবে কবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার পরের দিন ২১ নভেম্বর (২০১৭) ছেলেকে নিয়ে ছুটতে হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে। সকাল ৬ টায় বাসা থেকে বের হয়ে মহাখালী বাসস্ট্যাÐ। কাউন্টারে দীর্ঘ অপেক্ষার পর উঠতে হলো বাসে। ঢাকা টু টাঙ্গাইল রোড ধরে বাস চলতে শুরু করলো রাজশাহীর পথে। জ্যাম ঠেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে গাড়ী। কোথাও থামলে সহসাই চাকা ঘোরে না। দিন যায়, রাত যায় গন্তব্যের মুখ দেখি না। কখন যানজট ছুঁটে যায় সে ভয়ে সিট ছেড়ে কোথাও খেতে যাওয়ার উপায় নেই। বসের ভিতরে দূর্বিসহ অবস্থা; বিপর্যস্ত মানবতা। মহাখালী থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হতে লেগে গেল ২২ ঘন্টা। যেদিকে তাকাই শুধু মানুষ আর মানুষ। নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দুর্দশা অন্ত নাই। হাজার হাজার গাড়ী রাস্তার দু’ধারে ঠায় দাঁড়িয়ে। নড়ন-চড়ন নেই। রাস্তার পাশে মেয়েরা চাদর দিয়ে পর্দা করে প্রাকৃতির কাজ সারছে।
যানজটে বিভৎস অবস্থা। বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে বাস দিল টান। বাসে পরীক্ষার্থী রয়েছে ২০ থেকে ২২ জন। সকাল সাড়ে ৮ টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হবে ভর্তি পরীক্ষা। উর্ধ্বস্বাসে চলছে বাস। ভিতরে চিৎকার চেঁচামেচি; পরীক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে ড্রাইভারের কোনো ভ্রæক্ষেপ নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেইটে বাস যখন থামলো ঘড়ির কাটায় তখন ৮টা বেজে ১০ মিনিট। পরীক্ষার্থীরা যে যেভাবে পারলো পরিমরি করে নেমে রিক্সা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে চলে গেল পরীক্ষা দিতে।
রাজশাহী জার্নির ৬ মাস পর সড়ক পথের যানজটের কী উন্নতি হয়েছে? ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-খুলনার মতো মহাসড়কে কী স্বাভাবিক ভাবে যানবাহন চলছে? ঘন্টায় কত কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলছে? মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করার গৌরব অর্জন করেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। বিজ্ঞানের বদৌলতে মিনিটেই দেশের যে কোনো প্রান্তের খোঁজখবর নেয়া যায়; এমনকি আমেরিকা-রাশিয়ায়ও কথা বলা যায়। কিন্তু সত্যিই কী আমাদের উন্নতি হচ্ছে? মতিঝিল থেকে ফার্ম গেইট যেতে কত ঘন্টা লাগে? গুলিস্তান থেকে গুলশান কত ঘন্টার পথ? এই রাজধানীতে আগে যে দূরত্ব পৌঁছাতে ১০ মিনিট লাগতো; এখন সেই পথ পাড়ি দিতে এক ঘন্টা থেকে দেড় ঘন্টা লাগে। এ ছাড়া অনিশ্চয়তা তো আছেই।
ঢাকা থেকে রংপুর (জিপিও থেকে ৩৩৫ কিমি) সড়ক পথে ৬ ঘন্টা দূরত্বের পথ। কয়েক বছর আগেও ঢাকা থেকে সকাল ৮ টায় রওয়ানা দিলে দুপুর দুইটা আড়াইটার মধ্যে রংপুর পৌঁছা যেত। ঢাকা থেকে সড়ক পথে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে সময় লাগতো ৫ ঘন্টা। রাস্তাঘাটের উন্নতি ঘটলে তো সেই সময় আরো কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে সময় লাগছে ১৫ ঘন্টা থেকে ২২ ঘন্টা। বিপদে না পড়লে কেউ সড়ক পথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যায় না। প্রশ্ন হচ্ছে সড়ক মহাসড়ক তথা যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বাদ দিয়েই কী আমরা এগিয়ে চলছি?
ঢাকা টু চট্টগ্রাম মহাসড়কে বলা হয় দেশের অর্থনীতির ‘লাইভ লাইন’। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে আমদানী রফতানীর পণ্য এই পথে ঢাকায় আনা নেয়া হয়। কিন্তু সেই ‘লাইফ লাইন’ বøক হলে অর্থনীতি কী এগিয়ে চলতে পারে? রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের বড় বড় শহরগুলোর যাতায়াতের সড়ক পথগুলোতে যানজট দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। সড়কে মাত্রাতিরিক্ত যান চলাচল এবং সড়কে ব্যবস্থাপনায় ত্রæটি থাকলে যানজট থাকবেই। সারাদেশের মানুষ ঢাকামুখী। কাজের সন্ধানের পাশাপাশি কারণে-অকারণে লাখ লাখ লোক নিত্যদিন ঢাকায় আসা যাওয়া করেন। এজন্য পরিবহন আগের চেয়ে অনেক বেশি, সড়কে চাপও বেশি।
মহাকাশে ছুঁটছি অথচ মহাসড়কে যানজট নিরসন করতে পারছি না। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে যোগাযোগের উন্নতি ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত। বিমানের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাড়াচ্ছি; ঢাকায় ফ্লাইওভার বাড়াচ্ছি; কিন্তু মহাসড়ক ও মহানগরীতে যানজট দূর করতে পারছি না। অপ্রিয় হলে সত্য যে সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে। ক্ষমতাসীন ও তাদের স্তবকদের উন্নয়নের ঢাকঢোলের সঙ্গে সড়ক পথের বেহাল অবস্থা এক সাথে যায় না। চট্ট্রগ্রাম থেকে ৫ ঘন্টার পথ ঢাকায় ১৫ ঘন্টায় পৌঁছানো কাউকে উন্নয়নের ফিরিস্তি শোনালে তিনি কী তা বিশ্বাস করবেন? রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের সড়ক পথ এখন কার্যত অচল। এ মহাসড়কে কখনো ৮৫ কিলোমিটার, কখনো ৫০ থেকে ৭০ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার যানজট এই মহাসড়কে স্বাভাবিক ঘটনা। যার কারণে ৫ ঘন্টার পথ পাড়ি দিতে হয় ১২ ঘন্টা থেকে ১৬ ঘন্টায়। গত কয়েক দিনের মিডিয়ার খবর হলো এই মহাসড়কে যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকছে। কয়েকদিন থেকে এ পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের কারণে ফেনীর লেভেলক্রসিং এলাকায় ঢাকামুখী গাড়ি চলার সময় চট্টগ্রামমুখী গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা হতো। একইভাবে চট্টগ্রামমুখী চললে ঢাকামুখীগুলো বন্ধ রাখা হতো। এখন ওই ফ্লাইওভারের একাংশ খুলে দেয়ায় ফেনিতে যানজট কমলেও অন্যত্র বিশেষ করে টোল প্লাজাগুলোতে যানকট লেগেই রয়েছে। কাঁচপুর সেতু এবং মেঘনা ও গোমতী সেতু এলাকার ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার যানজট স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে।
রোজার প্রথম দিন থেকে রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ চার মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া অংশে ১৩ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়। দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেট পর্যন্ত ১৯২ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেন। মহাসড়কের গৌরীপুর, চান্দিনা, চৌদ্দগ্রাম, ফেনীসহ কমপক্ষ্যে ১০টি পয়েন্টে যানজটে যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুরের কালিয়াকৈরের সফিপুর বাজার অতিক্রম করতে সময় লেগে যায় দুই ঘণ্টা। গত কয়েক মাস থেকে চন্দ্রা থেকে সিরাজগঞ্জ অংশে তীব্র যানজট হচ্ছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ডেমরা পয়েন্টে তীব্র যানজট এবং হবিগঞ্জের মাধবপুরে সৃষ্টি হয় কয়েক কিলোমিটার যানজট। দ্বিগুণ সময় ও অর্থ ব্যয় হলেও জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেন হয়েছে। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ ছাড়াও নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ যেতে এই মহাসড়ক ব্যবহৃত হয়। ঢাকা ময়মনসিংহ রোডে ৫ কিলোমিটার ও দৌলতদিয়া-খুলনা মহাসড়ক এলাকার দৌলতদিয়া ঘাটেও দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। ঢাকা থেকে উত্তরের ১৬ জেলামুখী বাসগুলো থেমে থেমে চলে। এভাবে আর কতদিন চলবে? উন্নয়ন আর নিত্য যানজট কী এক সঙ্গে যায়? এসএস সি ও এইচ এসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে ছাত্রছাত্রীদের এ জার্নি বাই বাস, এ জার্নি বাই ট্রেন রচনা লিখতে বলা হয়। উত্তরপত্রে এ জার্নি বাই বাস রচনা লিখতে গিয়ে আগের দিনের ছাত্রছাত্রীরা বাস যাত্রার আনন্দ-সুখ স্মৃতি বণর্না করতেন। এখন পরীক্ষায় এ জার্নি বাই বাস রচনা লিখতে বললে ছাত্রছাত্রীরা কী লিখবেন? ##

 



 

Show all comments
  • AI ২২ মে, ২০১৮, ১২:২৪ এএম says : 0
    যখন পৃথিবীর অনেক দেশ উন্নতি করছে, সেখানে কিছুটা অগ্রগতি সাধারণ ব্যাপার।
    Total Reply(0) Reply
  • সোলায়মান ২২ মে, ২০১৮, ৩:০৫ এএম says : 0
    এখন দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যানজট
    Total Reply(0) Reply
  • নাবিলা ২২ মে, ২০১৮, ৩:০৬ এএম says : 0
    এখন জার্নি মানেই একটা দুঃস্বপ্ন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মহাসড়ক

২৮ ডিসেম্বর, ২০২২
২১ ডিসেম্বর, ২০২২
২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ