Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রভাবমুক্ত বিচার ও বিচারকের বিবেক

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম


প্রবাদ রয়েছে, ‘দেশ বৈরী দেশান্তরী, হাকিম বৈরী প্রাণে মারি’। অর্থাৎ দেশের সাধারণ মানুষ যদি কারো উপরে বৈরী বা অসন্তুষ্ট হয়ে যায় তবে সে যত শক্তিশালীই হোক না কেন তাকে দেশ ছাড়তে হয়। অন্যদিকে হাকিম অর্থাৎ বিচারক যদি বৈরী হয়ে পড়েন তবে যার উপর তিনি বৈরী হন তার হয় জীবন নাশ। বিচারক যখন ফাঁসি দেন বা কোন সাজা প্রদান করেন তখন মানুষ একটি কারণেই তা মেনে নেয়। কারণটি বিচারকের ‘নিরপেক্ষতা’ ও ‘প্রভাবমুক্ততা’, তবে জনমনে বিপত্তি-আপত্তি ঘটে তখনই যখন বিচারক তার বিচারিক সিদ্ধান্ত না দিয়ে আদিষ্ট হয়ে কোন বিচারকার্য পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। বিচারকগণ জনগণের অর্থে লালিত রাষ্ট্রীয় কর্মচারী। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৯৪(৪) মোতাবেক ‘সংবিধানের বিধানবলী সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন’। তারপরও স্বাধীন দেশের বিচারকদের যখন বিচারকার্যে ‘স্বাধীনতায়’ টান পড়ে তখনই শুরু হয় নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ পৃথক করার আন্দোলন। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের স্বকীয়তা, সম্মান রক্ষা করার জন্য বিজ্ঞ আইনজীবীরা বহু আন্দোলন করে কাগজে-কলমে সফল হলেও সরকার নির্বাহী থেকে বিচার ফল হচ্ছে উল্টো। বিচার বিভাগ যখন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে তখন থেকেই পুনরায় আলোচনার শীর্ষে চলে আসে বিচার বিভাগের চাকরির নিরাপত্তা বিধান সম্পর্কিত সরকারি নির্দেশনার গেজেট নোটিফিকেশন। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দেশ ত্যাগের যে কয়টি কারণ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম, বিচার বিভাগের সুনির্দিষ্ট স্বাধীনতার দাবি। বিচারপতি সিনহা সরকারের খুশির জন্য অনেক কাজ করলেও তিনটি কথার কারণে পরবাসী জীবন যাপন করতে হচ্ছে, তিনি আদালতে বসেই বলেছিলেন, ‘নি¤œ আদালত মানেই আইন মন্ত্রণালয়।’ কথাটি ছোট, কিন্তু এর বাস্তবতা অনেক বড় ও রূঢ়। কথিত রয়েছে, আইন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ ছাড়া নি¤œ আদালতের জজ বা ম্যাজিস্ট্রেটগণ গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। এমনও দেখা যায় যে, শুনানী হয় বেলা ১০ ঘটিকায়, সিদ্ধান্ত আসে বিকেল ৩ ঘটিকায়। কারণ আইন মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত নি¤œ আদালত কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। এতো গেল নি¤œ আদালতের দৈন্যদশা। উচ্চ আদালতের অবস্থা কী? সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৯৪(১) মোতাবেক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত, সেই সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিকে যখন বিমানে তুলে দেয়া হয় তখন অন্যান্য বিচারক বা বিচারপতির মেরুদÐ সোজা রাখার উপায় কোথায়?
সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাই কোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যে কোন বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সকল আদালতের জন্য প্রযোজ্য’। যদি তাই হয় তবে ৫ বছরের সাজায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের জামিনের প্রশ্নে আপিল বিভাগ যে নজির সৃষ্টি করেছেন, তাতে কি সর্বোচ্চ আদালতকে সরকারের প্রভাবমুক্ত মনে হয়েছে?
৪০ বছরের আইন পেশার অভিজ্ঞতায় শুনে আসছি, অঢ়ঢ়বধষ রং ধ গধঃঃবৎ ড়ভ জরমযঃ, অর্থাৎ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা কোন অনুকম্পা নয় বরং অধিকার। বিচারিক আদালতে জামিনে থাকা এবং না পালানোর নিশ্চয়তা থাকাই আপিল আদালতে জামিন পাওয়ার প্রধান শর্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তাছাড়া ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের বেলায় জামিনের ক্ষেত্রে মহিলা, শিশু ও রোগীর বেলায় বিশেষ বিবেচনার নির্দেশনা দেয়া স্বত্তে¡ও ৭৪ বছর বয়সী খালেদা জিয়ার জামিন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ঝুলে থাকার বিষয়টি বিচারিক ক্ষেত্রে কি নজির সৃষ্টি করবে? সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১১১ মোতাবেক, দেশের নি¤œ আদালতগুলি সর্বোচ্চ আদালতের এ নজিরকে অনুসরণ করে সরকার বিরোধীদের হেনস্থা করার একটা সুযোগ কি পেয়ে গেল? এ তো গেল বিএনপি চেয়ারপার্সনের মামলার দৃষ্টান্ত। বাস্তবিক পক্ষে এ অবস্থা দেশের সর্বনি¤œ আদালত পর্যন্ত যেখানে আইন দু’ভাবে প্রয়োগ হয়। সরকার দলীয়দের জন্য যা মধু বিরোধী দলের জন্য সে একই আইন বিষ হিসেবে আদালত কর্তৃক ব্যবহৃত হচ্ছে।
আদালত একটি স্পর্শকাতর বিষয়, যা নিয়ে কথা বলা বিশেষ করে সার্বক্ষণিক আইন পেশায় নিয়োজিত একজন কলামিস্টের বেলায় কঠিন। অন্যদিকে আদালত অবমাননার বিষয়টি তো রয়েছেই। তারপরও বিবেকের কারণে সত্যকে তুলে ধরাই প্রধান দায়িত্ব বলে মনে করি, বিচার ব্যবস্থার এ অবস্থায় যদি পরিবর্তন না আসে তবে স্বাধীনতার চেতনা ভুলণ্ঠিত হবে। যেহেতু এক নদী রক্ত ও মা বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সেহেতু স্বাধীনতার চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য কথা বলতেই হবে, যে কোন ঝুঁকির বিনিময়ে হলেও।
বিচার ব্যবস্থায় কমবেশি দুর্নীতি পূর্বেও ছিল। দু’ দশক পূর্বে সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে হাই কোর্টের একজন বিচারপতির টেলিফোনিক আলাপ প্রকাশ পাওয়ায় নিজ সম্মানবোধ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইবুনালের একজন বিচারপতির টেলিফোনিক কনভারসেশন প্রকাশ পাওয়ায় তিনিও সে ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব থেকে হাইকোর্টে ফিরে এসেছেন। ফলে বুঝা যাচ্ছে যে, নৈতিকতাবোধ এখনো মরে যায় নাই। তবে আদালত যেভাবে প্রভান্বিত হচ্ছে তা থেকে যদি মুক্তি হওয়া না যায় তবে ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতার’ যে আন্দোলন তা ভবিষ্যত প্রজন্মের নিকট মায়া কান্না হয়ে উপহাসের খোরাক হয়ে থাকবে।
দায়িত্ব নিয়েই বলতে পারি, কোনো কোনো বিচারক বলে থাকেন তারা আইন মন্ত্রণালয় বা সরকারের প্রভাবে বা নির্দেশে স্বাধীনভাবে বিচারিক সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না। অন্যদিকে আইনাঙ্গনে এটাও প্রচলিত রয়েছে যে, বিচারক নিজেই সরকারকে খুশি রাখার জন্য নিজে নিজেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি সরকারি লোক এ সনদ গায়ে লাগানোর জন্য নিজ বিবেককে বির্সজন দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন না। এর মূল কারণ হচ্ছে প্রমোশন ও সুবিধামত পোস্টিং।
‘বিবেকই শ্রেষ্ঠ আদালত’ রাস্তাঘাটে চলার সময় বাসের পিছনে বা কোথাও দেয়ালে লেখা দেখতে পাওয়া যায়। দেয়ালে বা বাসের পিছনে এ লেখাগুলি কারা লেখে তা কোন দিন খোঁজার চেষ্টা করি নাই। কেন লেখে তাও চিন্তা করি নাই। তবে এখন বুঝি বিবেকের তাড়নাই বিচার ব্যবস্থাকে একটি দিক নির্দেশনার জন্য পাবলিক পারসেপশন থেকে এ লেখাটি উঠে এসেছে। বিচারকগণ যখন বিবেক হারিয়ে নিজ স্বার্থের জন্য সরকারের স্বার্থ রক্ষা করেন তখন তাদের বুক কি একটুও কাঁপে না?
ব্রিটিশের আইন দ্বারাই দেশটি চলছে। পুলিশ আইনটি ১৮৬০ সালে ব্রিটিশরা প্রণয়ন করে। অন্যান্য মূল আইনও ব্রিটিশ দ্বারা প্রণীত। ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জন্য সর্বোচ্চ আদালত ছিল প্রিভিকাউন্সিল যা হাউজ অব লর্ডসের সমতুল্য। প্রিভিকাউন্সিলের কোনো কোনো রায় এখনো নজির হিসেবে আমাদের দেশসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রিভিকাউন্সিলের ব্রিটিশ বিচারকরা মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করে রায় দিয়েছেন। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ রয়েছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আন্দোলন করে কোন দিনই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জিত হবে না যতদিন না পর্যন্ত বিচারক নিজেকে স্বাধীন মনে না করেন। বিচারিক সেবা দেয়ার উদ্দেশ্যে কেউ যদি বিচারকের দায়িত্ব পালনের জন্য আগ্রহী হন তবে দেখতে হবে, তার মেরুদÐ সোজা আছে কি না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শক্ত মেরুদÐই হোক একজন বিচারকের যোগ্যতার সর্বপ্রথম উপাদান। সংবিধানের এই নির্দেশনা ও বিধান এখন অনেক ক্ষেত্রেই কথার কথা হয়ে আছে।
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিচার


আরও
আরও পড়ুন