Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পর্কের ‘মাইলফলক’ এবং পানিশূন্য নদী

প্রকাশের সময় : ৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এক সময়ের প্রমত্তা নদ-নদীগুলো শুকিয়ে এখন নালা এবং শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। শীতকাল শেষ হতে না হতেই নদী অববাহিকার কোটি কোটি কৃষিজীবী মানুষের মধ্যে পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়। আন্তর্জাতিক আইন, কলভেনশন ও আঞ্চলিক পরিবেশ, ভূ-প্রাকৃতিক দায়বদ্ধতা অগ্রাহ্য করে সত্তরের দশকে পদ্মার উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে পানি আগ্রাসন শুরু করেছিল, গত চারদশকে তা সর্বগ্রাসী রূপ গ্রহণ করেছে। যৌথ নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে সব আন্তর্জাতিক আইন ও বিধিবিধান রয়েছে তা একতরফাভাবে উপেক্ষা করেই বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার অবিরাম আয়োজন চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের এই পানিশোষণনীতির বিরুদ্ধে কোন কোন আন্তর্জাতিক মহলকে সোচ্চার ভূমিকায় দেখা গেলেও বাংলাদেশের সরকার এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলোর নীরবতা বিস্ময়কর। ভারতের পক্ষ থেকে মাত্র ৪০ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালুর কথা বলা হলেও কার্যত একতরফাভাবে পদ্মার পানি প্রত্যাহার শুরু যা দশকের পর দশক ধরে অব্যাহত আছে। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা হিসেবে পদ্মার পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে বাংলাদেশের চাপকে ভারত কখনোই পাত্তা দেয়নি। এ ধরনের অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দ্বিপাক্ষিক সমাধান সম্ভব না হওয়ায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপনের গণদাবীও পূরণ করতে পারছে না সরকার।
গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মার দু’কূলজুড়ে ধু-ধু বালুচর, মাঝখানে হাঁটুপানির শীর্ণ প্রবাহ। এক সময় যেখানে জেলেরা জাল ফেলে রূপালী ইলিশে নৌকার খোল বোঝাই করত, সেখানে এখন কিশোর-তরুণেরা ক্রিকেট খেলছে। পদ্মা এবং তার শাখা নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পদ্মা বিধৌত বিশাল জনপদে পানির হাহাকার ক্রমে তীব্র হয়ে উঠছে। নদীবক্ষ শুকিয়ে যাওয়ার পর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরও দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। এভাবেই সুজলা-সুফলা নদীমাতৃক বাংলাদেশে ভারতের পানি আগ্রাসনে মরু প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত ছয়-সাত বছর ধরে দেশের মানুষ অব্যাহত উন্নয়নের গল্প শুনছে। বাংলাদেশের নদ-নদীর উজানে পানি প্রত্যাহার এবং একের পর এক বাধ দিয়ে বাংলাদেশকে সব দিকে থেকে পানিবঞ্চিত করার সব আয়োজন অব্যাহত থাকলেও আমাদের সরকার প্রকারান্তরে ভারত তোষণেই ব্যস্ত রয়েছে। গঙ্গার পানিচুক্তির বাস্তবায়ন এবং তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির প্রতি ভারতের অযৌক্তিক সময়ক্ষেপণ ও অনীহা সত্ত্বেও ভারতের সাথে একতরফা বন্ধুত্বের নতুন নতুন মাইলফলক উন্মোচন করেছে সরকার। মূলত: কয়েক বছরে ভারতকে তার কাক্সিক্ষত ও সম্ভাব্য সবকিছু দিয়েও বাংলাদেশ যৌথনদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না। যদিও যৌথনদীর পানির হিস্যা কোন রাষ্ট্রের একক ইচ্ছাধীন বিষয় নয়। এটি বাংলাদেশের মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে গঙ্গা, তিস্তা, বরাকসহ যৌথ নদ-নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ, ভাটির দেশ এবং অববাহিকাঞ্চলের ইকো-সিস্টেম ও ইকোলজিক্যাল নিরাপত্তায় বিঘœসৃষ্টিকারী নদীকেন্দ্রিক এমন কোন প্রজেক্ট এককভাবে গ্রহণ করার এখতিয়ার ভারতের নেই।
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। পদ্মা ও তিস্তার পর সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনার উজানে মনিপুরে বরাক নদীর টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত। দেশের মানচিত্র থেকে ইতিমধ্যেই অনেক নদীর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। টিপাইমুখে বাঁধ এবং বরাকের পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা সফল হলে মেঘনা, সুরমা কুশিয়ারাসহ দেশের প্রধান ননহিমালয়ান নদীগুলোও বিলুপ্তির পথে যাত্রা করবে। পরিবেশ ও ভূতাত্ত্বিকদের মতে, প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পটি জীববৈচিত্র্য এবং ভূমিকম্প ঝুঁকির ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে স্পর্শকাতর এলাকায় পড়েছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ক্লাইমেটিক চেঞ্জ বা আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধির বিষয়গুলো বিবেচনা করে সারাবিশ্বে যখন গতানুগতিক উন্নয়ন ধারনার স্থলে টেকসই উন্নয়নের পরিবেশবান্ধব নতুন রূপরেখা প্রণীত হচ্ছে, পরিবেশ ও ভূ-প্রকৃতির উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনা করে ধারবাহিকতায় বড় বড় ড্যাম নির্মাণের প্রকল্পগুলো পরিত্যক্ত হচ্ছে, এমনকি পুরনো ড্যামগুলোও ডি-কমিশন করার চিন্তা-ভাবনা চলছে, ভারত তখন যৌথনদীর পানি প্রত্যাহার ও নতুন নতুন বাঁধ নির্মাণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের এসব উদ্যোগে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের ইকোলজি, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তাকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার আশঙ্কা তৈরী হয়েছে। গতকালও ঢাকার বিভিন্ন দৈনিকে এক সময়ের পদ্মা, ধলাই নদীর শুকিয়ে যাওয়া নদীবক্ষের ছবি ছাপা হয়েছে। একটি ইংরেজী দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত লিড নিউজ থেকে জানা গেল, ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানিচুক্তির পর এবার পদ্মার পানিপ্রবাহ সর্বনিম্ন। পক্ষান্তরে ভারতের অনীহায় বছরের পর বছর ধরে জয়েন্ট রিভার কমিশনের (জেআরসি)’র কোন বৈঠকই হয় না। অথচ বাংলাদেশ এবং ভারতের শাসকরা পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও চমৎকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দাবী করছেন। দেশ ও জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে ভারত তোষণের আঞ্চলিক রাজনীতি পরিহার করতে হবে। তোষণ অথবা আধিপত্যবাদী নীতি পরিহার করে পারস্পরিক স্বার্থ ও বন্ধুত্ব জোরদার করতে যৌথনদীর পানির ন্যায্য হিস্যা এবং অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে অবিলম্বে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সম্পর্কের ‘মাইলফলক’ এবং পানিশূন্য নদী
আরও পড়ুন