পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
হালে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির সুখবর শুনে মন যখন প্রজাপতি হয়ে আনন্দে ডানা মেলে আকাশে উড়াল দিতে চায়, তখন কিছু মন খারাপ করা খবর আবার সে আনন্দকে ম্লান করে দেয়, মনের আর প্রজাপতি হয়ে আকাশে ওড়া হয়ে ওঠে না। ক’দিন আগে দেশের একটি সংবাদ মাধ্যমে যে খবরটি সচেতন সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে তাহলো- ‘বছরে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যান বিদেশিরা।’ প্রথমে খবরটিতে গুরুত্ব দেয়া হয়ে ওঠেনি। কারণ এ দেশ যাদের, মানে যারা দেশটা চালান- যেমন আমাদের বিজ্ঞ ও বহুবয়সী অর্থমন্ত্রী, তার কাছে এ পরিমাণ টাকা খুবই সামান্য টাকা। কয়েক বছর আগে কুখ্যাত হলমার্ক গ্রুপের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যাংক ঋণ নিয়ে আত্মসাতের ঘটনায় করা তার মন্তব্য অবিস্মরণীয় হয়ে আছে- ‘৪ হাজার কোটি টাকা বড় অংকের টাকা না।’ আদতে এ ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট বা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করা হয় এবং তা উদ্ধার হয় না। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ তার বা তাদের কাছে গণ্য করার মত ব্যাপারই নয়। তা, তারা দেশের মালিক-মোক্তার হয়ে যখন হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করাকে কোনো গুরুত্ব দেন না সেখানে আমরা দেশের সামান্য জনগণ বা ছাপোষা মানুষ হয়ে তাতে গুরুত্ব দিতে যাই কেন? কিন্তু পরে মনে হল যে ইস! ঘরে, রাস্তায়, চায়ের দোকান তথা সবখানে যখন মলিন মুখ বেকারদের ছড়াছড়ি, মানে যে দেশে এত বেকার, সে দেশের বছরে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে? আমাদের ছেলেরা চাকরি পায় না আর তারা এসে এতগুলো টাকা নিয়ে যায়? এ কেমন কথা?
বাংলাদেশ থেকে বছরে এই যে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, যা বিদেশিরা এ দেশে কাজ করে রেমিট্যান্স হিসেবে তাদের দেশে পাঠাচ্ছেন বা নিয়ে যাচ্ছেন, সে কথাটি আমাদের দেশের কারো নয়। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের। বিশ^ব্যাংকের অর্থনীতিবিদের বক্তব্যের ভিত্তিতে করা এ গবেষণায় বলা হয়, ২০১৬ সালে বিদেশিরা কাজ করে বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথে ২০১ কোটি ৩০ লাখ ডলার নিয়ে গেছে। চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, নেপাল, থাইল্যান্ড, জাপান, নরওয়ে ও যুক্তরাজ্যে এ অর্থ গেছে। লক্ষ করার বিষয় যে, পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায় ২০১৬ সালের তথ্য দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথে কত টাকা বিদেশিরা কাজ করে নিয়ে গেছেন, সে পরিমাণ আরো বেশি না কম, তা কেউ জানায়নি। আর এ হিসেব বৈধ পথে যাওয়া অর্থের, অবৈধ পথে কি পরিমাণ অর্থ যায় তা অজ্ঞাত। উল্লেখ্য, এই বিদেশিরা প্রধানত এ দেশের তৈরি পোশাক খাতসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করেন।
বাংলাদেশে যে সব বিদেশি কাজ করেন তাদের হিসাব সরকারের কাছে আছে। সে হিসাব বলে যে, বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ৮৫ হাজার। অন্যরা বলেন, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা আরো অনেক বেশি, অতএব তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও বেশি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, গত জানুয়ারিতে এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়, বাংলাদেশে কাজ করা শুধু ভারতীয়রাই বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা দেশে নিয়ে যান বা দেশে পাঠান। আরো উল্লেখ্য, বিদেশিদের বেতন বাংলাদেশিদের চেয়ে দু’ থেকে তিনগুণ বেশি। বিশ্বের কোনো দেশে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশিরা সে দেশের স্থানীয়দের চেয়ে দু’তিন গুণ বেশি বেতন পান কিনা আমার জানা নেই। উদ্বেগের ক্ষেত্র হচ্ছে যে, বহু বিদেশিই আছেন যারা নিয়মানুযায়ী ওয়ার্ক পারমিট ছড়াই এখানে কাজ করেন। কারা ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজ করছেন তাদের হিসাব সরকারের কাছে আছে বলে মনে হয় না।
দেশের খুব কম সংখ্যক মানুষের পক্ষেই কোনো বিষয়ের তথ্য জানার জন্য কাগজপত্র ঘাঁটা সম্ভব। পরিশ্রমীরা সে তথ্য সংগ্রহের কাজটি করেন। আগ্রহীরা তা থেকে উপকৃত হন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে উপস্থাপিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনের বরাতে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিদেশি কর্মীরা ৫শ’ কোটি ডলার বা ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। ঐ প্রতিবেদনে এর কারণও উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয় যে দেশের শ্রম শক্তিতে দক্ষতার অভাব রয়েছে, আর সেই দক্ষতার অভাব পূরণ করা হচ্ছে বিদেশিদের দিয়ে। প্রতিবেদনে শ্রমিক নেতাদের স‚ত্রে বলা হয়েছে, সব থেকে বেশি বিদেশী কর্মী কাজ করেন পোশাক খাতে। পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান যেমন গার্মেন্ট, কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল, ওভেন ও নিটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, সোয়েটার ফ্যাক্টরি, বায়িং হাউস, মার্চেন্ডাইজিং কোম্পানি মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ বিদেশী কাজ করেন এ দেশে। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউস, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ফোন কোম্পানি, পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান, চামড়াজাত প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি, মিডিয়া রিসার্চ প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনী সংস্থাসহ বিদেশীরা কাজ করছেন সাধারণ ফার্নিচারের দোকানেও।
বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশি নাগরিকদের টাকা যে যে দেশে যায় সেগুলোর কয়েকটির কথা আগেই উল্ল্খে করা হয়েছে। একটি সূত্রে বলা হয়, সব মিলিয়ে প্রায় ৫৫টি দেশের নাগরিক বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করেন। তাদের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। সূত্রে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের চাকরিতে ভারতীয়দের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ২০১৫ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন। তারা তাদের দেশে এক বছরে পাঠিয়েছেন ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সমান। বাংলাদেশ ভারতে পঞ্চম রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বিবেচিত। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদে দেয়া স্বরষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশে মাত্র ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি চাকরি করেন। তার মধ্যে অর্ধেক ভারতীয়। একটি সূত্রে অনুমান প্রকাশ করে বলা হয় যে, বাংলাদেশে বৈধভাবে কাজ করতে হলে বিনিয়োগ বোর্ড থেকে অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু বিনিয়োগ বোর্ড থেকে যেসব ভারতীয় কর্মী ওয়ার্ক পারমিট নিয়েছেন, তার বাইরে বহুগুণ বেশি ভারতীয় রয়েছেন, যারা অবৈধভাবে বাংলাদেশে আছেন। আর তাদের অর্জিত অর্থ অবৈধ পথে হুন্ডির মাধ্যমেই পাচার করা হয়ে থাকে।
জানা গেছে, ‘ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডের নাগরিকরা। এরপর তারা নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কাজ করে ভিসার মেয়াদ শেষের আগেই চলে যান। নতুন করে আবার ভ্রমণ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান এসব বিদেশী কর্মীর বেতন পরিশোধ করে রাজস্বমুক্ত বিভিন্ন খাত থেকে। বিদেশী কর্মীরা ডলার করে টাকা নিয়ে যান নিজের দেশে।’
বহু সাধারণ মানুষের পক্ষেই বুঝে ওঠা মুশকিল যে, দেশের ছেলেরা যেখানে পৈতৃক ভিটেমাটি, সোনাদানাসহ শেষ সম্বল বিক্রি করে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকার চাকরির জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়, অনেকে বিদেশ যেতে গিয়ে ও বিদেশে গিয়েও মৃত্যুর শিকার হচ্ছে, যে দেশে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ বেকার, সে দেশে এসে বিদেশীরা কিভাবে বছরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যায়। গ্রাম বাংলায় আমজনতার মধ্যে প্রবচন প্রচলিত আছে- ‘গাঁয়ের যোগী ভিখ পায় না, বিদেশি কুকুরে ঠাকুর ভজে।’ এক্ষেত্রে বুঝি সে কথাই প্রযোজ্য।
কেন বিদেশিরা কাজ করে বা তাদের আনা হয়? তার জবাবে মূল কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, দেশে কর্মমুখী শিক্ষা ও দক্ষতার অভাব। বহু কাজ আছে যা বিদেশিরা ছাড়া সম্ভব নয়। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী পড়ানো হয় না, বাংলাদেশিরা ইংরেজি জানেন না। এর বিপরীত ভাষ্যও রয়েছে যে, ‘দেশে দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি থাকতেও কোনো কোনো খাতে চাকরির ক্ষেত্রে বিদেশিদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদেশি কর্মী নিয়োগ চলছে। এ প্রবণতা শুধু বিদেশী কোম্পানি বা সংস্থায়ই নয়, খোদ দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এখন বিদেশি কর্মী রাখা রীতিমতো ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।’
এ বিদেশি নিয়োগ ও বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যাওয়া নিয়ে সরকারি পর্যায়ে কারো কোনো মাথাব্যথা থাকার কথা জানা যায়নি। তবে বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষোভ-উদ্বেগ আছে। সংবাদ মাধ্যমে এ নিয়ে মাঝেমধ্যে লেখালেখি হয়। এ মাসেও একাধিক সংবাদ মাধ্যমে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০১২ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি বছর নতুন ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু কাজ পায় মাত্র ৭ লাখ। বাকি ১৫ লাখ থাকে বেকার। এর মধ্যে উচ্চশিক্ষিত অর্থাৎ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যারা শিক্ষাজীবন শেষ করেছে তারাও রয়েছে। প্রতি বছর এই ১৫ লাখ শ্রমশক্তি বেকারের সংখ্যা শুধু বাড়িয়েই চলেছে।
বাংলাদেশে বেকারত্বের এই কঠিন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিদেশিদের কাছে অর্থ চলে যাওয়ার সহজ সমাধান কেউ কেউ দিয়েছেন। একজন বলেছেন, দেশে কারিগরি দিক দিয়ে দক্ষ লোক তৈরি কম হচ্ছে। আরেকজন বলেছেন, জার্মানির মত দেশগুলো তাদের শিল্পের কি চাহিদা সে অনুযায়ী জনশক্তি তৈরি করে। বাংলাদেশেও সেটা দরকার। বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বেকার জনশক্তিকে কারিগরি দিক দিয়ে দক্ষ না করা পর্যন্ত বাংলাদেশের বেকারত্ব কমবে না, অন্যদিকে বিদেশিদের বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাওয়াও বন্ধ হবে না, বরং এ পরিমাণ আরো বাড়বে। প্রশ্ন, তবে এভাবেই কি বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে বহুঘোষিত উন্নয়নের মহাসড়কে?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।