Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আয়নায় নিজের চেহারা দেখা উচিৎ ভারতের

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ২৪ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে দুর্ভাবনায় ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা। বিষয়টি নিয়ে দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও বিশ্বে সর্বাধিক ভাষায় প্রচারিত বিবিসি এ সংক্রান্ত খবর পরিবেশন করেছে। খবরটি তাদের নিজস্ব নয়- ভারতেরই একটি সংস্থার- অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের(ওআরএফ) বরাতে পরিবেশন করেছে। সংস্থাটি অন্যতম ভারতীয় থিংক ট্যাংক বলে পরিচিত। এর সম্পর্কে উক্ত খবরে বলা হয়েছে, ওআরএফ নিজেদেরকে ‘স্বাধীন’ বললেও ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠী রিলায়েন্সের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের সঙ্গেও বিভিন্ন বিষয়ে একযোগে কাজ করে ওআরএফ। প্রতিবছর নয়াদিল্লিতে ‘রাইসিনা ডায়ালগ’ নামে বহুপাক্ষিক সম্মেলন হয়, ওআরএফ সেটির মূল আয়োজক, আর এতে সহায়তা করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই সম্মেলনে মূলত ভূরাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে নীতিনির্ধারকরা আলোচনায় অংশ নেন। ভারত সরকারের আঞ্চলিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ওআরএফ এখন ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ওআরএফ এর ফেলো মনোজ যোশী ভারতের খুবই সুপরিচিত একজন সাংবাদিক এবং তিনি ভারত সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক টাস্ক ফোর্সের একজন সদস্য ছিলেন।
অর্থাৎ ওআরএফ খুবই প্রভাবশালী এবং সরকারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক যুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। তাই এ সংস্থাটির বক্তব্যকে ভারত সরকারের অভিমত বলে মনে করা হচ্ছে। আর সে কারণেই উক্ত বক্তব্যকে এদেশে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এখন দেখা যাক, আলোচিত সে বক্তব্যটি কী? বক্তব্যটি মনোজ যোশীর যা ওআরএফ গত ১৮ এপ্রিল প্রকাশ করেছে। আর সেটাই বিবিসি প্রকাশ করেছে ঐদিনই। আর তার বরাত দিয়ে সেটি পরের দিন এ দেশেও ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে বিভিন্ন মিডিয়ায়।
‘বাংলাদেশ পোলস পোজ অ্যা চ্যালেঞ্জ টু রিজিওনাল স্টেবিলিটি’ শিরোনামের এই লেখায় বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের ভাবনা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে যে নির্বাচন হয়, তাতে মাত্র ২২% ভোট পড়েছিল। সেই নির্বাচন বিএনপি বর্জন কওে এবং সে সময় অনেক সহিংসতা হয়। কাজেই আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের আশা, বাংলাদেশের এবারের নির্বাচন যেন আগেরবারের চাইতে বিশ্বাসযোগ্য হয়। কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কারও ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাকে ভারত কিছুটা উদ্বেগের চোখে দেখে। কারণ, ভারত বিএনপির ব্যাপারে সন্দিহান। বিএনপি এর আগে যে দু’ দফা ক্ষমতায় ছিল, সে সময় বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গীবাদ শেকড় গেড়েছিল এবং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাকিস্তানের সমর্থন পেয়েছিল। আর বাংলাদেশ এই বিষয়টি না দেখার ভান করেছিল। বাংলাদেশে যেভাবে ইসলামী জঙ্গীদের তৎপরতা বাড়ছে, এমনকি আত্মঘাতী হামলা পর্যন্ত হয়েছে, সেখানে এই সমস্যা মোকাবেলায় বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগকেই বেশি নির্ভরযোগ্য বলে মনে করে ভারত। তাই ভারতীয় কর্মকর্তারা সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ এবং তৃতীয় দেশগুলোর গুপ্ত সংস্থার তৎপরতা মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তাদের একযোগে কাজ করার অভিজ্ঞতা বেশ ইতিবাচক। কারণ, ইসলামী জঙ্গীবাদ দমনে শেখ হাসিনা খুবই সক্রিয়। আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যে নির্বাচন এ বছরের শেষে হওয়ার কথা, সেটাকে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক, কিন্তু তারা চায় একটি ‘দলনিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের’ অধীনে এই নির্বাচন হোক, যে কমিশন নির্বাচনকালীন সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা করবে। বিএনপি আশা করছে, ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের যে ক্ষোভ, সেটি তাদের পক্ষে যাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যদিও ভালো করছে, তারপরও সরকারের ভেতর অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে, যা সহজে কাটানো যাচ্ছে না’। অপরদিকে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখনো পর্যন্ত যদিও নিরপেক্ষ, ২০০৬ সালে কিন্তু তারা একটি কেয়ারটেকার সরকারকে দুবছর ধরে মদত দিতে হস্তক্ষেপ করেছিল। তাই যদি আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠে, তখন এমন আশঙ্কা আছে যে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিশ্বাসযোগ্য করতে সেনাবাহিনীকে টেনে আনা হতে পারে। বাংলাদেশে প্রভাব নিয়ে বলা হয়েছে, ভারত যদিও বাংলাদেশের বহু বছরের মিত্র, এখন চীন সেখানে ভারতের প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০০৭ সালের পর থেকে চীন বাংলাদেশে প্রায় তিনশো কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। তারা বাংলাদেশে সেতু, সড়ক থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, অনেক কিছুই নির্মাণ করছে। তারা এখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় অস্ত্রযোগানদাতা। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরে গিয়ে আরও দুই হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের আশ্বাস দিয়েছেন। এসব প্রতিশ্রæতি রক্ষা করলে চীন হয়ে উঠবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারীদেশ। সবচেয়ে খারাপ যে পরিস্থিতির দিকে বাংলাদেশ যেতে পারে তা হলো সেখানে সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলি দুর্বল হয়ে ইসলামী গোষ্ঠীগুলো সেখানে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে (হেফাজতে ইসলাম)। দ্বিতীয় পরিস্থিতিতে সেনা সরকার গঠিত হতে পরে, যেটি দেশটির ইতিহাসে এর আগে কয়েক বার ঘটেছে। লেখার উপসংহারে বলা হয়েছে, এই মূহুর্তে বাংলাদেশ হয়তো তুলনামূলকভাবে একটি ভালো অবস্থানে আছে, কিন্তু ভবিষ্যতে নতুন ধরনের খুবই সহিংস এক ইসলামী জঙ্গীবাদ দেশটিকে ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। ভারতও তাই। সর্বোপরি দেশ দু’টি প্রতিবেশী এবং তাদের পারস্পরিক গভীর সম্পর্ক আছে। এই অবস্থায় ভারত এ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে খোলামেলা ও লিখিতভাবে আলোচনা করতে পারে না। উপরন্তু একটি দেশ অন্য একটি দেশের নির্দিষ্ট একটি দলের প্রতি সমর্থন জানাতে পারে না। তবুও এসবই করছে ভারত। এটাই প্রথম নয়, প্রায়ই তারা এই অন্যায় কাজটি করে থাকে। এমনকি সে দেশের মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয় এ দেশের একটি রাজনৈতিক দলের ও তার নেতা-নেত্রীর নাম। বাংলাদেশ তাদের ছাড়া অন্য কোন দেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলুক সেটিও চায় না তারা। এবং তা সেটা প্রকাশ্যে বলেনও তারা। কিছুদিন আগে ভারতীয় সাংবাদিকরা এ দেশে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন। সে সময় তারা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বাংলাদেশ কি চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে? প্রধানমন্ত্রীও তার যুৎসই জবাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বাংলাদেশ কার সাথে বন্ধুত্ব করবে, না করবে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। দ্বিতীয়ত, চীনের দিকে ঝুঁকে পড়লেও তাতে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, বাংলাদেশ কার সাথে বন্ধুত্ব করবে, আর কার সাথে করবে না তা তার নিজস্ব ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে অন্য কারো মাথা ঘামানো দরকার কী? দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্ব সকলের সাথেই, কোন নির্দিষ্ট দলের সাথে নয়। আর সেটা হলে বন্ধুত্ব টিকে না। তৃতীয়ত, মুখে যতই বন্ধুত্বের স্বর্ণযুগ চলছে বলা হোক না কেন, তা টেকসই হয় ন্যায্য পাওনা দেওয়া-নেওয়ার উপর ভিত্তি করে। কেউ যদি শুধু নেয়, কিছুই না দেয়, তাহলে সে বন্ধুত্ব বেশিদিন টিকে না। তবুও ভারত সে কাজটিই করে যাচ্ছে। এমনকি, তারা আমাদের মহান স্বাধীনতার প্রতি মর্যাদা রেখেও কথা বলে না। কিছুদিন আগে আসামের এক বিজেপি এমপি বলেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে দখল করে ভারতের অংশ না করা ভুল ছিল। তার এসব বক্তব্য এ দেশের স্বাধীনতা ও মর্যাদার উপর চরম চপেটাঘাত। যাকে বলে প্রভূত্ব খাটানো। এ দেশের কেউ-ই এর প্রতিবাদ করেননি। শুধুমাত্র বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এর তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। তাহলে কি এ দেশের মানুষ জীবনের বিনিময়ে যে মহান স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তা কি পিন্ডির পরিবর্তে দিল্লীর দাসত্ব করার জন্য? না। তা নয়। এ ভূখন্ডের মানুষ বরাবরই স্বাধীনচেতা। তাই তারা সব সময়ই দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে, তবুও পরাধীনতা মানেনি। ভবিষ্যতেও মানবে না।
লক্ষ করার বিষয়, মনোজ যোশীর ওই লেখায় আওয়ামী লীগ যে ক্ষমতায় আসতে পারবে না, বিএনপি ক্ষমতায় আসবে তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। আর সে কারণেই আগামী নির্বাচন নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন। কারণ, বিএনপি এমন একটি দল যার কাছ থেকে ইচ্ছামত সুবিধা আদায় করে নিতে পারবে না কেউ। আর এটাই ভারতের দুঃশ্চিন্তার কারণ। দ্বিতীয়ত, লেখাটিতে ইসলামী মৌলবাদ নিয়ে জুজুর ভয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য মুসলিম জঙ্গীরা বেশি ভয়ংকর, না ভারতের হিন্দু জঙ্গীরা বেশি ভয়ংকর সেটাও খতিয়ে দেখার দাবি রাখে।
যা’হোক, বিএনপি যে আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসবে তা শুধু মনোজ যোশীই নয়, আরো অনেকেই ইদানীং আভাষে-ইঙ্গিতে বলছেন। এরূপ ইঙ্গিত কিছুদিন আগে ভারতের আর এক গণ্যমান্য ব্যক্তিও এ দেশে সফরে এসে বলেছেন। এসব বলে তারা পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছেন। যা এ দেশের সাধারণ মানুষও বোঝে। তাই আগামী নির্বাচন হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বিশিষ্টজনদের অভিমতঃ আগামী নির্বাচনে ভারত একা খেলোয়াড় নয়- ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো। এবার খেলোয়াড় অনেক-সমগ্র বিশ্বই এবং এ দেশের সব মানুষ। তারা চায় নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, সকলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এবং তা সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। আর এ পক্ষের শক্তি ভারতের চেয়ে অনেক বেশি। তাই পানি ঘোলা না করে যার চরকা তারই তেল দেওয়া ভালো। লেবু কচলালে বেশি তিতা হয়ে যায়। স্মরণীয় যে, বাংলাদেশের নির্বাচনের কিছু আগে-পরে ভারতেরও জাতীয় নির্বাচন। তাতে বর্তমান সরকারি দল জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে দেশটিকে লন্ড-ভন্ড করে দিতে পারে। এমন শঙ্কা বলে এ দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। কারণ, সেখানে ধর্মীয় হানাহানি বেঁধে গেলে তার রেশ এ দেশেও পড়তে পারে। তাই ভারতের উচিৎ আয়নায় নিজের চেহারা দেখা, অন্যেরটা নয়। আরো স্মরণীয় যে, এ দেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে হলে বিএনপি যে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসবে তা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বুঝতে পারছে। দলের ঊর্দ্ধতন নেতারা প্রায়ই প্রকাশ্যে এ নিয়ে কর্মীদের হুঁশিয়ার করে দেন। তারা নিজেদের অধীনে নির্বাচন করে জয়ী হওয়ার চেষ্টা করবেন এ রকম ধারণা তাই উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ ধরনের যে কোনো উদ্যোগ-পদক্ষেপ দেশের জন্য শুভ হবে না বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। ক্ষমতাসীনরা এটা অনুধাবন করলেই দেশের কল্যাণ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিজের চেহারা
আরও পড়ুন