Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিদেশি বিনিয়োগে বাধা দূর করতে হবে

আবুল কাসেম হায়দার | প্রকাশের সময় : ২৩ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করার জন্য সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী আশানুরূপ বিদেশি বিনিয়োগ দেশে হচ্ছে না। সমপ্রতি ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট তিন দিনের এক রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসেন। সফরের শেষ দিনে তিনি বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে হোটেল সোনারগাঁয়ে এক সভা করেন। মূল বক্তব্যে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ত্রান দাই কুয়াং বেশ কিছু গুত্বপূর্ণ কথা আমাদের উদ্দেশ্যে রাখেন। বিশেষ করে ভিয়েতনামে বিদেশি বিনিয়োগ বেশ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণসমূহ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দেশে আইনের শাসন কায়েম করা। নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ বিচার বিভাগ প্রধান বিষয়। ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশকে উদ্ভাবন, বাড়তি উৎপাদনশীলতা, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও শিল্পায়ন, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের বড় সুযোগ আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তার ভাষায়, বাংলাদেশ একটি বড় বাজার। এ দেশে কম খরচে পণ্য উৎপাদনের সুবিধা আছে। এ দেশের মানুষের ইংরেজি জ্ঞানও বেশ ভালো। ভিয়েতনামের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ, তথ্য প্রযুক্তি, কৃষি, বস্ত্র, জ্বালানি তেল ও গ্যাস এবং কাঠামো খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। তবে তার মতে, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ বেশি আসবে না। সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ও সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মূল শক্তি।
সরকারের ‘ভিশন ২০২১’ বাস্তবায়নে বছরে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন। শুধু স্থানীয় উদ্যোক্তাদের পক্ষে এত বিনিয়োগ জোগান দেয়া সম্ভব নয়। এ জন্য বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে বিশেষ পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিদ্যমান কর কাঠামো এজন্য সহায়ক নয়। ৪৫ শতাংশ করপোরেট কর দিয়ে ব্যবসা করা কঠিন। অনেক দেশে এতো বেশি হারে কর নেই। এমন পরিস্থিতিতে কর কমিয়ে আনার প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি)। আগামী বাজেটে অন্তত ৫ শতাংশ কর কমানোর দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। রাজধানীতে হোটেল ওয়েস্টিনে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুইয়া। ফিকির অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে, ভ্যাট নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় জটিলতা দূর করা, ন্যূনতম কর প্রথা বাতিল ও সারচার্জ প্রত্যাহার।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের নেপথ্যে ব্যবসায়ীরা। উন্নয়নের ধারাবাহিকতার জন্য সহায়ক নীতি নেয়া হবে আগামী বাজেটে। বাজেট প্রণয়নে ফিকির প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় নেয়া হবে। তিনি বলেন, ভালো নীতি নেয়া গেলে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ আরো বাড়বে এবং এফডিআই বাড়বে। বিদেশি উদ্যোক্তাদের প্রশংসায় তিনি বলেন, মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে ভোক্তার প্রত্যাশা পূরণ করছেন তারা। নতুন সভাপতি শেহজাদ মুনিম বলেন, বিনিয়োগ স¤প্রসারণ করতে চায় ফিকির সদস্যরা। এ জন্য এনবিআরের সঙ্গে আরো অংশীদারিত্ব চান তারা। ফিকির প্রস্তাবগুলো আগামী বাজেটে বিবেচনার অনুরোধ জানান তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রসহ বাংলাদেশের সব প্রতিবেশীই এফডিআই বাড়াতে কর হ্রাসের কৌশল নিয়েছে। বাংলাদেশকেও সে পথে এগোতে হবে। প্রশ্নোত্তর পর্বে ফিকির সাবেক সভাপতি রূপালী চৌধুরী বলেন, বিনিয়োগ উন্নয়নে দেশে ভালো আইন আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। নীতির ধারাবাহিকতা নেই। এ বিষয়ে এনবিআরের পদক্ষেপ জানতে চান তিনি। জবাবে মোশাররফ হোসেন বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি কর্মকর্তাদের বলেছেন, ব্যবসায়ীসহ কোনো সেবাগ্রহীতাকে যেন হয়রানি না করা হয়। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ার দেয়া হয়েছে।
সুপারিশসমূহ: ১. বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হলে করপোরেট কর কমাতে হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে আর্থিক হারে কর বড় বাধা। দেশি-বিদেশি সকল বিনিয়োগকারীকে উৎসাহিত করার জন্য করপোরেট কর কম পক্ষে ১০ শতাংশ কমানো উচিত। তাতে আর্থিক বিনিয়োগে সরকার বেশি কর আয় করতে সক্ষম হবে। অধিক বিক্রি বেশি লাভ, এই নীতিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
২. বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য আইনের সুশাসন কায়েম করতে হবে। সকলের জন্য আইন সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বিচারকগণকে সুশাসন কায়েম সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। দলের ঊর্ধ্বে উঠে আইন প্রয়োগ করতে হবে।
৩. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দীর্ঘসূত্রিতা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সম্পূর্ণভাবে দূর করতে হবে। সরাসরি সুবিধা বিনিয়োগকারীগণকে দিতে হবে। এক কেন্দ্র থেকে সুবিধা বিনিয়োগকারীগণকে দিতে হবে। ডজনে ডজনে দপ্তর ঘুরে বিনিয়োগকারীগণ হয়রানির শিকার হচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।
৪. ঘুষ ও দুর্নীতি এই দুইটিকে ‘না’ বলতে হবে। এখন দেশে ঘুষ ছাড়া কোন কাজ হয় না। আমদানি-রফতানির পুরো কাজটি এখন ঘুষ বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল। এতে কোটি কোটি টাকা ব্যবসায়ীদের অপচয় হচ্ছে। উৎপাদন ব্যয় বেশি হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশিগণ প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ কমাতে হবে।
৫. ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে সুশাসন, শৃঙ্খলা ও আইনের বলয়ে ফিরে আসতে হবে। ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাট বন্ধ করতে হবে। অর্থ পাচার বন্ধ করতে হলে সহজে বিনিয়োগ সুবিধা দিতে হবে। তার জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে কর কমিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে ৩৫ শতাংশ করে ব্যক্তি কর দিতে হয়। তা কমিয়ে ২০ শতাংশ আনা প্রয়োজন। তাতে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। অর্থ পাচার হ্রাস পাবে।
৬. দেশে রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ কায়েম করতে হবে। সকল দল ও ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষকে গুম ও খুন থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশি ও বিদেশি সকল বিনিয়োগকারীর নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।
৭. দেশে সকল দলের অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে-বিদেশে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার কায়েম করতে হবে। বিগত নির্বাচন প্রশ্নবোধক ছিল। যা দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারেনি। তাই দ্রুত সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। তাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীগণ বিনিয়োগে আস্থা ফিরে পাবেন। তখন বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। শেয়ার বাজারসহ সকল বাণিজ্যিক কার্যক্রমে গতি আসবে।
৮. ব্যাংকে সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে। সারা দুনিয়া ৩ থেকে ৪ শতাংশ সুদের হার। আর আমাদের দেশে সুদের হার ১৮ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। এই অবস্থায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে না। সুদের হার দ্রুত কমিয়ে আনতে হবে। বিদেশি অর্থ বিনিয়োগের পথকে সহজ ও দ্রুত করতে হবে। সকল জটিলতা কাটিয়ে বিদেশি মুদ্রা বিনিয়োগে সরকারকে যত্নবান হতে হবে।
৯. বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দ্রুত গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু করতে হবে। এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অপরিহার্য। প্রধানমন্ত্রীকে শক্ত হাতে সিদ্ধান্ত নিয়ে চীনের সঙ্গে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া খুবই প্রয়োজন। চীন ছাড়া এই বিশাল প্রকল্পের অংশীদার বিশ্বে অন্য কোন দেশ হওয়ার ক্ষমতা রাখে না। এই কঠিন, গুরুত্বপূর্ণ ও অতিব জাতীয় জরুরি সিদ্ধান্ত এখনি গ্রহণ করা প্রয়োজন। আরো বেশি দেরি হলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
লেখক: সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিদেশি বিনিয়োগে
আরও পড়ুন