Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদের অপ্রতুল চিকিৎসাসেবা

সেলিনা আক্তার | প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

কুন্দলতা দেবীর শরীর অত্যন্ত দুর্বল, খাওয়ার রুচি নাই, হাঁটতে অস্বস্তি বোধ করেন। অনু সিন্হারও একই অবস্থা। অনিদ্রা, মাথা ব্যাথা, দুর্বলতা, ক্লান্তিবোধ, হাত-পা ব্যথা নিত্যদিনের সঙ্গী। কাছে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকায় বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগ নিয়েই তাদের বয়ে নিতে হয় জীবন।
শুধু কুন্দলতা ও অনু সিন্হাই নয়, সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের রাসনগর, ধনীটিলা ও রতনপুর এলাকার স্বপ্না সিনহা, গিথানী দেবী, অমলা দেবী, শেফালী সিনহা, কুসুম সিনহা, লেইপাক, চন্দলেইমাই, ইন্দ্রানী দেবী, ভানু দেবীসহ বহু মণিপুরী এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত। মণিপুরী অধ্যুষিত এলাকায় কোনো সরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নেই। উপজেলা সদরের সাথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় এসব নারীর মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়।
ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. অভিজিত শর্মা বলেন, আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারপরও আমরা আন্তরিকতাপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা দিতে চেষ্টা করি। আমরা মণিপুরী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কিংবা বাঙালি আলাদা করে দেখি না। সবাই মানুষ, সবাই বাংলাদেশি, তাই সবাইকে সমান সেবা প্রদানের চেষ্টা করি। সরকারি হাসপতালে সবার জন্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা সমান। বর্তমান সরকার নাগরিকদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে খুবই আন্তরিক। দেশের প্রতিটি উপজেলায় সকল নাগরিকের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবায় সরকার বেশ তৎপর। তবে দুর্গম এলাকা, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের খুব কমসংখ্যক নারী ও শিশু এই সরকারি সুবিধা গ্রহণ করতে আসে।
দেশের কিছু কিছু এলাকা এতোটাই দুর্গম যে, বিভিন্ন জনপদে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা চিকিৎসা সেবাসহ রাষ্ট্রের মৌলিক বিভিন্ন অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। সেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া এখনো পৌঁছেনি। ফলে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা এবং সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কমকান্ডের সুযোগ নিতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। এরফলে তাদের বিভিন্ন প্রতিক‚লতার মধ্যদিয়ে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারীরা সবসময় ঘরে-বাইরে সমানভাবে কাজ করে থাকেন। তাই নারী হিসেবে তাদের জন্য কতিপয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, বিশেষ করে প্রজনন ও মাতৃকালীন স্বাস্থ্যসেবা। দেশের প্রতিটি মানুষের মতো তাদেরও রয়েছে চিকিৎসাসেবা পাবার অধিকার। তাই সমাজ তথা রাষ্ট্রের অনেক স্তরে নারীরা এগিয়ে গেলেও নৃ-গোষ্ঠী নারীরা তেমন একটা এগোতে পারেনি সে অর্থে। সমাজে বিদ্যমান পারিপার্শ্বিকতার পরিপ্রেক্ষিতে আর দশটি মূলধারার নারীর অবস্থান থেকে তারা অনেক পিছিয়ে। পাহাড়ি জনপদের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে বিষয়টি দৃশ্যমান। দৈনন্দিন প্রয়োজনে ঘরে ও বাইরে উদয়াস্ত খেটে চলেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা। একদিকে স্বামীর সাথে ফসলের মাঠে, অন্যদিকে ঘরে স্ত্রী ও মা হিসেবেও সমানভাবে ভূমিকা রাখেন তারা। এসব নারীরা সক্রিয় উপার্জনকারী। সন্তান লালন-পালনসহ ঘর-গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ এক হাতেই শেষ করতে হয় তাদের।
দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বসবাস করে মণিপুরী জাতিগোষ্ঠী। শহর এলাকার মণিপুরীরা শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থ-বিত্তে বেশ ভালো আছেন। তারা নগর জীবনের সকল নাগরিক সুবিধা ভোগ করেন। ব্যতিক্রম শুধু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদে বসবাসকারী নারীরা। উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে সিলেটের পাহাড়ি জনপদের প্রতিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে। রোগ-বালাই, অসুখ-বিসুখ বৃদ্ধির প্রবণতা অনেক বেশি দৃশ্যমান সেখানে। যুগ যুগ ধরে এসব নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা শ্রমে ঘামে পরিবার পরিজনকে আগলে রাখলেও তাদের নিজেদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন আজো নিশ্চিত হয়নি।
এ বিষয়ে রাজধানীর কদমতলী থানার মাতুয়াইলে অবস্থিত শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক (গাইনি) ডা. হাসরাত জাহান বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করা মণিপুরীসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা অবহেলিত। উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে তারা বিভিন্ন রোগ-শোকে ভোগেন। জেলা ও উপজেলায় শহরের কাছাকাছি যারা বসবাস করেন, তারা সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন। কিন্তু যারা নিতান্তই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেন তাদের কাছে স্বাস্থ্য কর্মীরাও যেতে পারেন না সহজেই। তাই তারা বিভিন্ন স্বাস্থ্যসমস্যা ও রোগ-ব্যাধিতে ভুগেন অনেক বেশি।
পরিবারে শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, সমাজে স্বাস্থ্য শিক্ষার অভাব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, পুষ্টি জ্ঞানের অভাব, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে রান্না-বান্না ও খাওয়া-দাওয়া, ধূমপান ও মাদক সেবন, প্রাচীন রীতিনীতি ও কুসংস্কার, মদ্যপান, খাবার তালিকায় সুষম খাদ্যের অনুপস্থিতি, কাঁচা বন্যপ্রাণী ভক্ষণসহ বিভিন্ন অনিয়ম এ সকল নারী ও তাদের শিশুদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা ও রোগ-ব্যাধি সৃষ্টির অন্যতম কারণ। দারিদ্র্য আর অশিক্ষার কারণে দেশের সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা নানা রকম কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ফলে তারা সরকারের শিক্ষা ও সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারছেন না এবং অনেকে আবার তা গ্রহণেরও সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে এ গোষ্ঠীর কিশোরী, বাল্যবধূ, নববিবাহিতা নারী, গর্ভবতী মা এবং সন্তানকে দুগ্ধদানকারী মায়েরা রক্ত স্বল্পতাসহ নানা রকম জটিল ও কঠিন রোগে ভোগেন। ভৌগোলিক অবস্থান তথা ভূ-প্রকৃতিগত কারণে তারা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। সচেতনতার অভাবে তারা টাইফয়েড, জন্ডিস, যক্ষা, ক্যান্সার, ডায়রিয়া, চর্মরোগ, রক্তশূন্যতাসহ মাতৃকালীন বিভিন্ন জটিলতায় ভোগেন। প্রসবকালীন সমস্যা, শিশুদের কৃমি, নবজাতকের বিভিন্ন জটিলতাসহ নানা রকমের রোগ-ব্যাধিতেও তারা আক্রান্ত হন।
শিক্ষা ও সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। নিজেকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এসব নারীদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হতে হবে। সেই সাথে নিজে, পরিবার তথা চারপাশের পরিবেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। কুসংস্কার ত্যাগ করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবন যাপনে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন বিষয়ে সচেতন হতে হবে। ধূমপান ও মাদকসহ সকল প্রকার নেশা ত্যাগের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। বন্য পশু-পাখি ও কাঁচা তরকারি ভালোভাবে রান্না করে খেতে হবে। মাতৃকালীন সময়ে অন্তত ৩ থেকে ৪ বার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। শিশুদের সময়মতো টিকা দেয়াসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতে হবে। কোনো প্রকার রোগ-ব্যাধি কিংবা স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। এ ক্ষেত্রে ডাক্তার অনেক দূরে থাকলেও সেখানে যেতে হবে।
দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পাল্টে গেছে। পরিবর্তিত অবস্থার ইতিবাচক ফল দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। পার্বত্য এলাকায়ও এর প্রতিফলন ঘটছে। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকার মণিপুরী নারীরা যদি এখনো সচেতন না হতে পারেন এবং সরকারের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন, তবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদের সচেতন করতে, উন্নয়নের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে সরকারসহ বিভিন্ন বেসকাররি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদেরও এ গতিতে শামিল হতে হবে। তাদের শামিল করাতে হবে আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন