Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কোথাও নিরাপদ নয় শিশুরা

সাবরিনা শুভ্রা | প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সন্তান আল্লাহর দান। ফুলের মতো নির্মল। ফুল ও শিশুকে যারা ভালোবাসে না তারা অমানুষ অথবা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। নিজের শিশু সন্তান তো বটেই, অন্যের এমনকি জীবনের দুশমন হলেও তার শিশুসন্তানের প্রতি কেউ প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে না, যার সামান্যতম মানবতাবোধ থাকে। মানুষ তো বটেই, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পশুপাখিও নিজের সন্তানকে জীবনের বিনিময়ে হলেও রক্ষার চেষ্টা করে। এটাই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম। মায়া, মমতা, সহানুভ‚তি এসব গুণ মহান আল্লাহ্ই দিয়েছেন তাঁর বান্দাদের। তবে নানা কারণে প্রকৃতিতে যেমন বিপর্যয় দেখা দেয়, তেমনই মানুষের চিন্তা-চেতনাতেও বৈকল্য ঘটে, বিপর্যয় দেখা দেয়।
বিশেষত মানসিকভাবে কেউ রোগাক্রান্ত হলে তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। জীবন সম্পর্কে হতাশা, উপার্জনহীনতা, আপনজনের সঙ্গে বিরোধ, সামাজিকভাবে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকলে কেউ কেউ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নিজেকে সামলাতে পারে না। তখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আপনজন, স্ত্রী-পরিজন, এমনকি প্রিয় সন্তানকেও হত্যা করতে দ্বিধা করে না- এমনই নিষ্ঠুর ও নির্মম কর্মকান্ড আমাদের সমাজে ঘটছে প্রায়শ। চোর, ছিনতাইকারী সন্দেহেও শিশু-কিশোরদের ওপর এক শ্রেণির বিবেকহীন মানুষ অত্যাচার করছে। সামাজিক অস্থিরতা ও অভাব-অনটনের কারণে শিশু-কিশোরদের কেউ কেউ ছিঁচকে চুরির মতো ঘটনা ঘটাতে পারে। তাই বলে সন্দেহ হওয়া মাত্রই বিচার-বিবেচনা না করে কোনো শিশু-কিশোরের ওপর চড়াও হয়ে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবার মতো ঘটনাকে স্বাভাবিক বলা যাবে না কোনো বিচারেই।
বছর দুই আগে সিলেটের শিশু রাজনকে চোর সন্দেহে ধরে নির্মমভাবে মারধর করতে করতে মেরে ফেলে কয়েকজন নরপশু। খুলনার শিশু রাজীবকে নিজের গ্যারেজে কাজ না করার কারণে গ্যারেজ মালিক ও তার লোকেরা পায়ুপথে কম্প্রেসার দিয়ে হাওয়া ঢুকিয়ে মেরে ফেলে। শহরের বাসাবাড়িতে কাজের শিশু-কিশোরদের ওপর সামান্য কারণে চালানো হয় বর্বর অত্যাচার। কোনো কোনো মেয়ে শিশুর ওপর চলে যৌন নির্যাতন। এমনকি অনেককে বাবা-মা বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে দেয়া হয় না দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। অথচ শিশু-কিশোরদের দিয়ে কাজ করানোই বেআইনী। কিন্তু আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু-কিশোররা বাসাবাড়ি, কলকারখানা, গ্যারেজ প্রভৃতিতে কাজ করতে বাধ্য হয়। এদের স্বাভাবিক জীবন যেমন ব্যাহত হয়, তেমনই অসুখ-বিসুখে সুচিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থাও থাকে না। এমনকি অনেকে পর্যাপ্ত খাবারও পায় না। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি তাদের খাটিয়ে নেয়া হয় একনাগাড়ে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিশু-কিশোর শ্রমিকদের নিয়ে প্রায়শ কথা ওঠে। সিদ্ধান্তও গৃহীত হয় এদের পক্ষে। কিন্তু কাজের কাজ তেমন হয় না। শিশু-কিশোরদের অধিকার নিয়ে জাতিসংঘেও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশসহ সদস্যদেশগুলো স্বাক্ষরও করেছে। এরপরও শিশু-কিশোরদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমনটি বলা মুশকিল। শিশু-কিশোরদের কল্যাণে জাতিসংঘের গৃহীত সিদ্ধান্তের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন জরুরি।
আরেকটি বিষয়, ভ্রূণ হত্যা পৃথিবীর কোনো দেশেই স্বীকৃত নয়। এটি আইনত অপরাধ ও অমানবিক কাজ। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী ভ্রূণ হত্যা হচ্ছে হরহামেশাই। ভারতে এর পরিমাণ আশ্চর্যজনকভাবে বেশি। ভারতীয় সমাজে লিঙ্গবৈষম্য ভ্রূণ হত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। সেখানে ছেলে সন্তানদের গণ্য করা হয় সম্পদ ও আলো হিসেবে এবং মেয়েদের ধরা হয় অযাচিত। গর্ভে থাকা সম্ভাব্য কন্যাসন্তানকে অনেক পরিবার জন্মের আগেই লিঙ্গ নির্ধারণ পরীক্ষা করে গর্ভপাতের মাধ্যমে মেরে ফেলে। ভারতের একটি সরকারি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ভারতের জনসংখ্যায় ছেলে ও মেয়েদের তারতম্য আশঙ্কাজনক। প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রতি ১০০ জন মেয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করলে ছেলে সন্তান জন্ম নেয় ১০৭.৬ শতাংশ।
ভারতের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৭-১৮-এর তথ্য মতে, মেয়ে সন্তান ভারতে ‘জাতীয়ভাবে অযাচিত’। ওইসব পিতা-মাতার ধারণা, ছেলেরা যেহেতু পরিণত বয়সে উপার্জনক্ষম হয় মেয়েরা পরের ঘরে চলে যায় এবং সঙ্গে নিয়ে যায় যৌতুক যা পরিবারের জন্য অলাভজনক সেহেতু ছেলে সন্তানের প্রয়োজন বেশি।
সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের অনেক বিবাহিত দম্পতি ছেলে সন্তান না পাওয়া পর্যন্ত সন্তান নিতে থাকেন এবং গর্ভের সন্তান মেয়ে হলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দেখতে দেয়া হয় না পৃথিবীর আলো। তাদের ছেলে সন্তান নেয়ার ওই প্রবণতার শিকার হয় প্রায় ২১ মিলিয়ন অযাচিত মেয়ে সন্তান। তাদের ওই ছেলে সন্তানের আশায় সন্তান নিতে থাকা এবং লিঙ্গ নির্ধারণের পরীক্ষা করে ভ্রূণ হত্যার ফলে ভারতে প্রায় ৬ কোটি ৩০ লাখ নারীর অনুপস্থিতি ঘটেছে।
অপরদিকে এক শ্রেণির মানসিক বিকারগ্রস্ত মা-বাবা অথবা আত্মীয়স্বজন দ্বারা যাতে নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে মারা না যায় সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি করা দরকার। শিশুরা আমাদের স্বপ্ন। আশা-আকাক্সক্ষা। দেশ, জাতি ও সমাজের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। বিকারগ্রস্ত মায়ের হাতে নিহত শিশু যে, এদেশ ও জাতির জন্য বড় কোনও অবদান রাখতে সক্ষম হতো না- তা কে বলবে? নিষ্ঠুরতার শিকার নয়, শিশুদের বিকশিত হতে দিতে হবে। সুন্দর স্বপ্ন দেখাতে সহায়তা করতে হবে আমাদেরই।
লেখক: গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিরাপদ

২৩ অক্টোবর, ২০২২
৩০ জুলাই, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন