Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

যুদ্ধের পাঁয়তারা জোরদার হচ্ছে

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১৭ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠ ৭ ব্যক্তি ও তাদের নিয়ন্ত্রিত ১২টি কোম্পানির বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ৬ এপ্রিল এক ঘোষণায় বলা হয়েছে, ওই সব ব্যক্তি, মালিক অথবা নিয়ন্ত্রণ করেন এমন ১২টি কোম্পানির বিরুদ্ধে এই অবরোধ থাকবে। পুতিনের ঘনিষ্ঠচক্রের বিরুদ্ধে নেয়া এটি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। হোয়াইট হাউস বলেছে, টার্গেটেড এ অবরোধ রাশিয়াকে অস্থিতিশীল কর্মকান্ড সৃষ্টি থেকে বিরত রাখবে। তাদের বিরুদ্ধে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে পশ্চিমা দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ রয়েছে। তাদেরকে এখন এর জন্য পরিণতি ভোগ করতে হবে। প্রতি উত্তরে ‘উপযুক্ত জবাব’ দেবে বলে ঘোষণা করেছে রাশিয়া। দেশটি বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে যতই শক্তিশালী মনে করুক না কেন রাশিয়াও যে ফেলনা নয় তা শিগগিরই টের পাবে তারা। ৭ এপ্রিল রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে আক্রমণ বা রাশিয়া বিরোধী পদক্ষেপ নিলে তা আর বরদাস্ত করা হবে না। একই রকম পাল্টা জবাবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে ওয়াশিংটনকে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের প্রতিও একই ধরনের সতর্কবার্তা উচ্চারণ করা হয়েছে উক্ত বিবৃতিতে।
ওদিকে, ৪ মার্চ যুক্তরাজ্যের এক রেস্তোরাঁর বাইরে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় সের্গেই স্ক্রিপাল ও তার মেয়ে ইউলিয়া স্ক্রিপালকে। হাসপাতালে পরীক্ষার পর তারা বিষাক্ত রাসায়নিকে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানানো হয়। সের্গেই স্ক্রিপাল রুশ গুপ্তচর ছিলেন। যুক্তরাজ্যের গুপ্তচরদের কাছে রাশিয়ার গোপন তথ্য দেন তিনি। ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করার দায়ে ২০০৬ সালে রাশিয়ায় তার সাজা হয়। ২০১০ সালে গুপ্তচর বিনিময়ের মাধ্যমে ছাড়া পেয়ে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেন তিনি। গোয়েন্দারা জানান, তাদের ধারণা, স্ক্রিপাল বিষাক্ত রাসায়নিকে আক্রান্তের শিকার হন এবং তা ঘটিয়েছে রাশিয়া। এই ঘটনার পর যুক্তরাজ্য ও তার মিত্র দেশগুলো ১৩০ জনের বেশি রাশিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। জবাবে রাশিয়াও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সমান-সংখ্যক কূটনীতিক বহিষ্কার করেছে। ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা পরবর্তীতে জানিয়েছেন, কথিত গ্যাস রাশিয়া থেকে আসেনি। সের্গেই স্ক্রিপাল এবং তার মেয়ে ইউলিয়া স্ক্রিপাল সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তবুও এ সংকট নিরসন হয়নি! বহিষ্কৃত কূটনীতিকগণ স্ব-স্ব দেশে ফেরত গেছেন।
চীন ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য-যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এটা শুরু করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।তিনি চীনের অন্যায্য বাণিজ্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে অভিযোগ তুলে ৩ এপ্রিল আরও ৫০ বিলিয়ন ডলারের ১৩শ’ চীনা পণ্যে ২৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণা করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় চীনও যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যে ২৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণা করেছে। এর আগে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্যে শুল্ক আরোপ করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম দুটি অর্থনীতির মধ্যে এই বাণিজ্য-যুদ্ধ শুরু হওয়ায় সারা পৃথিবীতেই ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে ব্যাপক পতন হয়েছে। চীন হুমকি দিয়েছে, তারা এই যুদ্ধের শেষ দেখে ছাড়বে। এর বিপরীতে ক্ষুব্ধ মার্কিন বাণিজ্য-সচিব বলেছেন, সমাধান না মেলা পর্যন্ত উচ্চ আমদানি শুল্ক থাকবে। ওয়াশিংটনের আরও অভিযোগ হচ্ছে, চীন তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে এবং সে কারণেই এই শুল্ক আরোপ। চীনের আইন অনুসারে, বিদেশি কোম্পানি যদি চীনে ব্যবসা করে, তাহলে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ হস্তান্তর করতে হবে। সে জন্যই জার্মানির দ্রæতগতির ট্রেন প্রযুক্তি চীনা প্রকৌশলীদের হাতে এসেছে। নিজেদের বিশাল বাজারে প্রবেশাধিকারের বিনিময়ে চীন বিদেশি কোম্পানির ব্যবসায়িক গোপনীয়তাও হাতিয়ে নেয়। এর জবাবে চীনের সহকারী বাণিজ্যমন্ত্রী এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, চীন বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সুরক্ষিত প্রযুক্তি হস্তান্তরে বাধ্য করে। তাই এই অভিযোগ ভুয়া। তিনি আরও বলেন, পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে এই হস্তান্তর হয়ে থাকে। সিন-হুয়া গত ৮ এপ্রিল ‘বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গালাগালি নীতি গুরুতরভাবে চুক্তি চেতনার পদদলন’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে বলেছে, মার্কিন সরকার স¤প্রতি তথাকথিত ‘৩০১ তদন্ত’র ফলাফল অনুযায়ী চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যদ্রব্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দিয়েছে। এমন একতরফাবাদ ও বাণিজ্য সংরক্ষণবাদের দৃঢ় বিরোধিতা করে চীন। আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ও যুক্তরাষ্ট্রের এই আচরণের ব্যাপক সমালোচনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের এই আচরণ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি ও মর্মের লঙ্ঘন এবং এই সময়কার বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে উসকানি। যুক্তরাষ্ট্র হলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য। তার উচিত সংস্থার কাঠামোয় অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সংঘর্ষ সমাধান করা। কিন্তু তা না করে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে বাণিজ্য সংরক্ষণবাদের পথ বেছে নিয়েছে। এমন পথে বেশি দূর এগুলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি আরও বৃদ্ধি পাবে। জাতিসংঘের মহাসচিবও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি সমর্থন করেছেন বলে জানা গেছে। অবশ্য উক্ত দুই দেশের শুল্ক আরোপ এখনো কার্যকর হয়নি। স্মরণীয় যে, যুক্তরাষ্ট্র এর আগে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির উপর ব্যাপক শুল্ক আরোপ করে। এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় ভারত, চীন, ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ অনেক দেশ। ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই বিশ্বের বহু সেটেল্ড বিষয়কে আনসেটেল্ড করে বিশ্বময় অশান্তি সৃষ্টি করছেন। পÐিতদের অভিমত, বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হলে সমগ্র বিশ্বের ভয়াবহ ক্ষতি হবে।
গত ৭ এপ্রিল সিরিয়ার পূর্ব গৌতায় ৭০ জন মানুষ নিহত হয়। একে কেন্দ্র করে কয়েকটি দেশের মধ্যে প্রচন্ড বাকযুদ্ধ শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে, রাসানিয়ক অস্ত্র ব্যবহার করে ঐ গণহত্যা চালানো হয়েছে। অভিযোগ অস্বীকার করে সিরিয়ার সরকার বলে, উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের ঠেকানোর জন্য রাসায়নিক হামলার প্রয়োজন নেই। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও দুমা শহরে রাসায়নিক বোমা ফেলার অভিযোগ অস্বীকার করে বলে, দুমা শহর থেকে উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জয়শুল ইসলামের বহিষ্কারে সাফল্য ম্লান করার জন্য কয়েকটি পশ্চিমা দেশ এবং এনজিও এ অভিযোগ তুলে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বলে, সিরিয়ার সেনাবাহিনী যখন পূর্ব গৌতার প্রায় গোটা এলাকা সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করেছে তখন তাদের পক্ষ থেকে রাসায়নিক হামলার কোনও যুক্তি নেই। তবুও আমেরিকা ও কিছু ইউরোপীয় দেশের পক্ষ থেকে এ ধরনের অভিযোগ অব্যাহত থাকে। যুক্তরাষ্ট্র রাসায়নিক হামলার জবাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাবে বলে হুমকি দেয়। রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্র হামলার উপযুক্ত জবাব দেয়া হবে বলে পাল্টা হুমকি দেয়। এই বাকযুদ্ধের মুখেই গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এ নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। শুধু পশ্চিমা শক্তিজোট নয়, ইসরাইলও সিরিয়ার হোমস শহরে ৯ এপ্রিল ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
তুরস্ক সমপ্রতি ইরাকে অভিযান চালিয়েছে কুর্দি এলাকায়। সেখানে ফ্রান্স জড়িয়ে পড়েছে বলে তুরস্ক অভিযোগ করেছে। ফিলিস্তিনের ঘটনাপ্রবাহ পুনরায় মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ইসরাইলের সেনারা একদিনে বহু ফিলিস্তিনকে হত্যা করেছে। জাতিসংঘ নিরপেক্ষ তদন্তের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু আমেরিকা তাতে ভেটো দিয়েছে। উত্তর কোরিয়া ও আমেরিকার শীর্ষ বৈঠকে বসার সময় ও স্থান প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। উত্তর কোরিয়া পরমাণু অস্ত্র ত্যাগ করবে বলে এক বার্তায় আমেরিকাকে জানিয়েছে। ফলে এই দুই দেশের বাকযুদ্ধ আপাতত বন্ধ আছে। কিন্তু এটা কতদিন থাকবে তা বলা দূরহ। চীন শীর্ষ বৈঠকের মূলা ঝুলিয়ে পরিস্থিতি আপাতত শান্ত করেছে বলে অনেকের অভিমত। অপরদিকে, আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। সেখানেও কয়েকটি দেশ জড়িত আছে। ইয়েমেন বনাম সৌদি জোট যুদ্ধ চলছে অনেকদিন যাবত। এতে করে দেশটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ইরানের পরমাণু অস্ত্র নিয়ে ৬ জাতির সম্পাদিত চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করছে। কিন্তু চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্যদেশগুলো এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবুও যুক্তরাষ্ট্র তার মনোভাব ত্যাগ করেনি। ইরান বলেছে, সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করা হলে তারা পুনরায় পরমাণু কর্মসূচি এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় কর্মকান্ড শুরু করে দেবে। এ নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে।
বলা যায়, বিশ্বের চতুর্দিকে যুদ্ধের দামামা বাজছে। এ ডঙ্কা ব্রিটেন-আমেরিকা বনাম রাশিয়া এবং আমেরিকা বনাম চীন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। এটা শুধু তাদের মধ্যেই সীমিত নেই। এতে তাদের মিত্ররাও জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ইউরোপের অনেক দেশ ব্রিটেনের পক্ষ নিয়েছে। ফলে রাশিয়া ও চীনের মিত্র দেশগুলোও এ স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে তা নিশ্চিত। উপরন্তু এ স্নায়ুযুদ্ধ এক পর্যায়ে গিয়ে সামরিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। আর তা হলে নির্ঘাত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। আর সেটা হলে কি পরিণতি হবে তা বলা কঠিন। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে কোন পক্ষ জয়ী হবে তা জানি না। তবে যুদ্ধের ফলাফল দেখার মতো কেউ বেঁচে থাকবে না’। অতএব, সকল পক্ষেরই সাবধান ও সতর্ক হওয়া উচিৎ। ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শন করা উচিৎ। যুদ্ধ নয়, শান্তির পক্ষে ভূমিকা রাখা উচিৎ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যুদ্ধ


আরও
আরও পড়ুন