Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

জুট পলিমার ব্যাগের অপার সম্ভাবনা সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন

| প্রকাশের সময় : ৯ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

পাট ব্যবহারের আরেকটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এই নতুন দিগন্তের পরিধি বিশাল। পাটের আঁশ থেকে তৈরি পলিমার দিয়ে বানানো হচ্ছে ব্যাগ, যা দেখতে হুবহু পলিথিন ব্যাগের মতো। রাজধানীর ডেমরার লতিফ বাওয়ানী জুটমিলে পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প পরিমানে বানানো হচ্ছে এই ব্যাগ। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের ‘সোনালী ব্যাগ’ ইনিশিয়েটিভের আওতায় এই পলিমার ব্যাগ উৎপাদন হয়ে আসছে গত বছর মে মাস থেকে। বর্তমানে প্রতিদিন দু’হাজারের মতো ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। জানা গেছে, পাটের ব্যাগ পলিথিন ব্যাগের অনুরূপ হলেও এটি অনেক বেশী টেকসই ও মজবুত। এ ব্যাগ পচনশীল এবং মাটি চাপা দিলে পাঁচ মাসের মধ্যেই মাটির সঙ্গে মিশে যায়। পানিনিরোধক এ ব্যাগের দামও খুব বেশী নয়। এক কেজি পলিথিন ব্যাগের দাম যেখানে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা সেখানে পাটের পলিমার ব্যাগের দাম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এর বাণিজ্যিক উৎপাদন হলে দাম আরো কমবে। পাটের আঁশ থেকে ব্যাগ তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খান। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করছেন। তিনি বিগত ২০ বছর ধরে পাটের ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। তার এই নতুন উদ্ভাবনের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী থেকে ২০১৫ সালে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেছেন। পাটকলে পরিত্যক্ত পাটের আঁশ থেকে প্রথমে সূ² সেলুলোজ আহরণ করে আলাদা করে নেয়া হয়। পানিতে অদ্রবণীয় এই সেলুলোজকে পরে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে পরিবর্তন করা হয়। দ্রবণীয় সেলুলোজের সঙ্গে ক্রসলিংকার মেশানো হয়। বিশেষ তাপমাত্রায় রাসায়নিক বিক্রিয়ায় দ্রবণটি ড্রায়ার মেশিনে দেয়া হলে সেই দ্রবণ শুকিয়ে প্লাস্টিকের শিটের আকারে মেশিন থেকে বেরিয়ে আসে। পরে এই শিট কেটে চাহিদা মতো ব্যাগ বানানো হয়। দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ-ঘাতক পলিথিন ব্যাগের বিকল্প আবিষ্কারের চেষ্টা চলছিল। এই প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খানের কৃতিত্ব এই যে, তিনি বিকল্পটি উদ্ভাবন করেছেন, যা সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব ও যুৎসই। উল্লেখ আবশ্যক যে, তিনি ইতোপূর্বে পাট থেকে ঢেউটিন জুটিন ছাড়াও হালকা ও মজবুত হেলমেট, শৌচাগারের রিং, ¯ø্যাব, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি নিত্যব্যবহার্য পণ্য উদ্ভাবন করেছেন। তার এসব উদ্ভাবনের জন্য আমরা তাকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ ও মোবারকবাদ জানাই।
বিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খান তার এই নব উদ্ভাবনের নাম দিয়েছেন ‘জুট পলিমার’। জুট পলিমার থেকে তৈরি ব্যাগ বাহুল ব্যবহৃত পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হওয়ায় পরিবেশ সচেতন ও পরিবেশ নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা খুশী। তারা এ ধরনের বিকল্পেরই সন্ধানে ছিলেন, যা তারা পেয়ে গেছেন। তাদের কাছে এর চেয়ে বড় সুসংবাদ আর কিছু হতে পারেনা। পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বিশ্বজুড়েই উদ্বেগের বিষয়। ডেনমার্কের কোপেনহেগেনভিত্তিক সংস্থা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড কাউন্টস’-এর হিসাবে সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৫ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। এর মাত্র ১ শতাংশ পুণর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ১০ শতাংশ ফেলা হয় সমুদ্রে। ১০০ বছরেও এসব ব্যাগের পচার কোনো সম্ভাবনা নেই। মাটির সঙ্গেও তা মেশে না। বিশ্বপরিবেশের জন্য এই পলিব্যাগ কতটা হুমকি ও ক্ষতিকর, এ থেকেই তো অনুধাবন করা যায়। আমাদের দেশেও পলিথিন ব্যাগের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের হিসাবে শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই প্রতিদিন এক কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ জমা হয়। সারা দেশে প্রতিদিন কত ব্যাগ ব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত হয়, এ থেকে তার একটি আন্দাজ পাওয়া যায়। পলিথিন ব্যাগ আমাদের মাটির প্রকৃতি ও নদীর নাব্যতার জন্য ইতোমধ্যেই বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। শহরগুলোতে নর্দমা অকার্যকর হয়ে পড়া ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণ এই পলিথিন। পলিথিন ব্যবহার ও তা ফেলে দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের নাগরিক সচেতনতা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। এর খেসারত আমাদের নানাভাবে দিতে হচ্ছে। সরকার ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি রাজধানীতে এবং একই বছরের ৩১ মার্চ সারাদেশে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়নি। এখনো অবাধে পলিব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ চলছে, চলছে ব্যবহারও। মাঝে মধ্যে ধরপাকড় হয়, কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রভাব দেখা যায় না। বস্তুত পলিব্যাগের উপাদান-উপকরণ আমদানি ও উৎপাদন সচল রেখে পলিব্যাগের ব্যবহার নিরোধ ও নিরুৎসাহিত করা সম্ভব নয়। আমরা আশা করবো, সরকার এক্ষেত্রে শূণ্য সহনশীলতা প্রদর্শন করবে।
উপযুক্ত বিকল্প যখন পাওয়া গেছে তখন পলিথিন ব্যাগকে চিরতরে বিদায় জানাতে হবে। পাশাপাশি জুট পলিমার উৎপাদন বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপকহারে বাড়তে হবে, যাতে চাহিদামাফিক পলিমার ব্যাগ উৎপাদন সম্ভবপর হয়। সরকারীভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিছু যন্ত্রপাতিও আমদানি করা হয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে প্রতিদিন অন্তত এক লাখ পিস পলিমার ব্যাগ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। অনেকে মনে করেন, সরকারের এই উদ্যোগের আরো সম্প্রসারণ প্রয়োজন। এই সঙ্গে বেসরকারীখাতকেও উৎসাহিত করা উচিত। এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও সহযোগিতা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। দেশে পলিথিন ব্যাগের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। সেই চাহিদা পূরণ করতে হবে জুট পলিমার ব্যাগ দিয়ে। এর কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া এই ব্যাগের রফতানি সম্ভাবনাও বিপুল। ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ ব্যাগ আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জানা গেছে, বছরে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বায়োডিগ্রেডেবল বা পচনশীল পলিব্যাগের চাহিদা রয়েছে বিশ্বে। বাংলাদেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ পাট উৎপাদিত হয় তার পুরাটাও যদি পলিমার ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহার করা যায়, তবু বিশ্ব চাহিদার অর্ধেকও পুরণ হবে না। বলা বাহুল্য, রফতানির এই সুযোগ ও সম্ভাবনা কাজে লাগানোর চেষ্টা আমাদের জোরদার করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ একান্তভাবে আবশ্যক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন