পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
০ বিশিষ্টজনরা বলছেন বিশ্বায়নের ধারা থেকে বিচ্ছিন্নতার আলামত
‘আঁরা চাটগাঁইয়া ভাই নওজোয়ান, দইজ্জার কুলত বসতগড়ি ছিনাত টেগাই ঝড়-তুয়ান’। ঐতিহাসিক সেই ‘চাটগাঁ’ আর ‘চিটাগাং’ বিতাড়িত হতে চলেছে! হঠাৎ করেই বাদ গেল ‘চিটাগাং’ নামটি। এ নিয়ে বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামবাসীর সাথে কোন ধরনের আলাপ-আলোচনা, মতামত গ্রহণ করাই হয়নি। এখন এ নিয়ে চলছে সচেতন নাগরিক মহলে ব্যাপক তোলপাড়। সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে গেছে নাম পরিবর্তনের বিষয়টি। এ অঞ্চলের সচেতন জনগণের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল বিশ্বায়নের ধারার সাথে খাপ খাইয়ে রাখার জন্য ‘চিটাগাং’ নামটি কাটা-ছেঁড়া করা হবে না কখনই। বরং সেই সাথে প্রাগৈতিহাসিক আমলে ব্যাপক প্রচলিত নাম ‘চাটগাঁ’ নামটিও পাশাপাশি প্রচলিত বা সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু তা না করে জনগণের মতামত ছাড়াই ইতিহাসের ‘চাটগাঁ’ বা ‘চিটাগাং’ হয়ে গেল বাংলা ছাড়াও ইংরেজিতেও চট্টগ্রাম (ঈযধঃঃধমৎধস)। যার ইংরেজি বানানও খাপছাড়া। এতে করে রীতিমত বেকুব বনে গেছেন চট্টগ্রামের বনেদি ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে ইতিহাস-ঐতিহ্য ও আত্মমর্যাদাবান মানুষজন। অনেকেই ক্ষোভ-অসন্তোষের সাথে বলছেন, চিটাগাং নামটি কর্তন করে দিয়ে বিশ্বায়নের ধারা বিশেষত দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর, শিপিং, আমদানি-রফতানি ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আন্তর্জাতিক যোগাযোগ থেকে এ অঞ্চলকে বিচ্ছিন্নতার আলামত এরমধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। কেননা শত শত বছর পূর্ব থেকেই প্রাচীন ভারতবর্ষে মনীষীদের উক্তি থেকেই একটি কথা প্রচলিত, “চিটাগাং টু দি ফোর” অর্থাৎ সবার আগে এগিয়ে চট্টগ্রাম। যা চাটগাঁবাসী সহজভাবে গ্রহণ করছেন না। গতকালও (মঙ্গলবার) বন্দরনগরীর সর্বত্র আলাপে-আড্ডায় এ বিষয়টিই গুরুত্বের সাথে আলোচনায় উঠে আসে। এতে প্রত্যেকেই বিস্ময় ও উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তবে তারা আশা করেন, নিকার-এ প্রাথমিকভাবে গৃহীত এ প্রস্তাবনার অনুমোদন চূড়ান্ত বাস্তবায়নের আগেই এ বিষয়ে সরকার চাটগাঁবাসীর নাড়ির স্পন্দন উপলব্ধি করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন। সরকার চিটাগাং তথা চাটগাঁর মানুষের হৃদয়ের মাঝে ঠাঁই নেয়া ঐতিহাসিক সেই দু’টি নাম ‘চাটগাঁ’ ও ‘চিটাগাং’ বহাল রেখে জনতার আবেগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন।
এদিকে সরকারের নিকার-এ গৃহীত প্রাথমিক প্রস্তাবনা অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই লিখতে হবে ‘চট্টগ্রাম’। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভায় বানান পরিবর্তনের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চট্টগ্রামের সাথে সভায় আরও ৪ জেলার ইংরেজি বানান পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে যে যুক্তিতে চিটাগাং বদল করে চট্টগ্রাম করা হয়েছে তা নিয়ে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। চিটাগাং বাদ দেয়ার পক্ষে যুক্তি দেখানো হয় ব্রিটিশদের প্রণীত বানানে এতদিন ধরে ইংরেজিতে যেভাবে লেখা হতো তার সঙ্গে মূল নামের বানান ও উচ্চারণগত তফাৎ রয়েছে। তবে ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, চিটাগাং নামটি ব্রিটিশদের দেয়া নয়। তাছাড়া হাজার হাজার বছরের নিরাপদ পোতাশ্রয় চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের কারণে গোটা বিশ্বে চট্টগ্রামকে ‘চিটাগাং’ হিসেবেই চেনে। প্রাগৈতিহাসিক বিভিন্ন দলির দস্তাবেজ, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অংশ হচ্ছে ‘চিটাগাং’ এবং ‘চাটগাঁ’। তবে এ কথাও ঠিক চট্টগ্রামের প্রায় অর্ধশত নাম রয়েছে। এরমধ্য থেকে শুধু চট্টগ্রাম নামটি পরিগ্রহণের ফলে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমÐলে যোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে বলে মনে করেন অনেকে। স্থানীয় লোকজনকে বলতে শোনা গেছে, কেউতো কথাবার্তায়ও বলেন না যে ‘আমার বাড়ি চট্টগ্রামে’। সচরাচর বলতে শোনা যায়, চাটগাঁ কিংবা চিটাগাংয়ে আমার বাড়ি। অর্থাৎ আমি ‘চাটগাঁইয়া’। যা এক গর্বের পরিচয়।
বেসরকারি ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন, চিটাগাং বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে চট্টগ্রামের মানুষের মতামত নেয়া দরকার। চট্টগ্রামের সাথে চিটাগাং থাকলে অসুবিধা নেই। ইংরেজিতে চিটাগাং যেমনি শ্রæতিমধুর তেমনি বাংলাতে শ্রæতিমধুর চট্টগ্রাম। ইংরেজিতে চট্টগ্রাম বেমানান। ভারতেও একসময় ইন্ডিয়া বদল করে ভারত করা হয়েছিল। কিন্তু এখন দুইটাই সেখানে চালু আছে।
ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিন বলেন, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে পুরো বিশ্বে চিটাগাং পরিচিত। চট্টগ্রাম বন্দরের কারণে পুরো পৃথিবী চিটাগাংকে চিনে। গোটা বিশ্বে ঐতিহাসিক যত দলিলপত্র, সাহিত্য-সংস্কৃতি সবকিছুতেই রয়েছে চিটাগাং। এখন চট্টগ্রাম হলে নানামুখী সমস্যা হতে পারে। তিনি বলেন, ব্রিটিশরা ভুল বানানে চিটাগাং লিখেছে বলে যে যুক্তি দেখানো হচ্ছে তাও গ্রহণযোগ্য না। আন্তর্জাতিক পরিমÐলে চট্টগ্রামের গুরুত্ব বিবেচনায় চিটাগাং শব্দটি বহাল রাখা জরুরী।
বিশিষ্ট কবি ও নাট্যকার অভিক ওসমান বলেন, আমি চিটাগাংয়ের পক্ষে। ইংরেজিতে চট্টগ্রাম লেখা বেমানান। সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ চিটাগাংকে বাদ দেয়া যায় না। বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্তি সাহিত্যিক রাশেদ রউফ বলেন, বাংলাকে সম্মান জানিয়ে ইংরেজিতেও চট্টগ্রাম লেখার এ প্রস্তাব অভিনন্দনযোগ্য। একটি জেলার দু’টি নাম থাকলে বিভ্রান্তি হয়। এখন বিভ্রান্তি কেটে যাবে। চিটাগাং বাদ দিয়ে ইংরেজিতেও চট্টগ্রাম লেখার দাবি দীর্ঘদিনের উল্লেখ করে ডি কে ঘোষ নামে একজন একটি বইও লিখেছেন।
ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদান থেকে জানা যায়, চিটাগাং শব্দের উৎপত্তি ‘চেৎ-ত-গৌঙ্গ’ থেকে। যার অর্থ ‘যুদ্ধ করা অনুচিৎ’। আরাকানী পুঁথি থেকে জানা যায়, এরপর থেকে এই এলাকার নাম হয় চেত্তগৌং। কালক্রমে চেত্তগৌং থেকে চাটিগ্রাম, চাটগাঁ, চট্টগ্রাম, চিটাগাং নামের উৎপত্তি। এ থেকে বোঝা যায় চিটাগাং শব্দটির উৎপত্তি প্রাগৈতিহাসিক যুগের, এটি ব্রিটিশদের দেয়া নয়। নবম ও দশম শতকে আরব বণিকদের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারের সাথে সাথে ‘ইসলামাবাদ’ হিসেবেও এ অঞ্চলের পরিচিতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামের অপর নাম ‘বা’বুল ইসলাম’ বা ইসলামের প্রবেশদ্বার। হাজার বছর আগে আরব ও ইয়েমেন থেকে আসা পীর-দরবেশ-বণিকরা এ অঞ্চলে বসতি শুরু করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের স্মারক চেরাগী পাহাড়ে এবং বদরপাতি এলাকায় বদর পীর সাহেব ও আরো অগণিত অলি-আউলিয়া-বুজর্গ চেরাগ জ্বালিয়ে ইসলাম প্রচার শুরু করেছিলেন। কথিত আছে, আউলিয়াগণ চেরাগ-বাতি জ্বালিয়ে যতটুকু জায়গা আলোকিত করতেন ততটুকু জায়গায় জ্বীন-পরী দৈত্য-দানবদের অবস্থান করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তীকালে সেই জায়গা আরো বাড়িয়ে ইসলাম প্রচারের মাধ্যমে সমগ্র চট্টগ্রাম অঞ্চল তারা কোরআন-সুন্নাহর আলোকে আলোকিত করেন। এ অঞ্চলের আয়তন ছিল প্রাচীনকালে সমগ্র বাংলাদেশের আয়তনের চেয়েও অনেক বেশি।
প্রাচীন শিলালিপি ও প্রস্তরস্তম্ভে লেখা হয়, চেৎ-ত-গৌঙ। যার অর্থ হলো ‘যুদ্ধ করা অনুচিৎ’। আরাকানী পুঁথি থেকে জানা যায়, ওই নামের আলোকে চাটগাঁর নাম হয় প্রথমদিকে চেত্তগৌং। কালক্রমে চেত্তগৌং থেকে চাটিগ্রাম, চাটগাঁ, চট্টগ্রাম, চিটাগাং নামের উৎপত্তি। বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতার বিবরণীতে (১৩৪৬ খ্রি.) তিনি লিখেছেন, ‘(বাংলাদেশের) যে শহরে আমরা প্রবেশ করলাম তা হল সোদকাওয়াঙ (চাটগাঁ-চিটাগাং)। এটি মহাসমুদ্রের তীরে অবস্থিত একটি বিরাট শহর। এরই কাছে গঙ্গা নদী। চীনা পর্যটকের ফেই-শিন এর প্রাচীন বিবরণীতে জানা যায়, ‘বাতাস অনুকূল থাকলে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা থেকে এ দেশে বিশ দিনে পৌঁছানো যায়। এ দেশ চীনের পশ্চিমে অবস্থিত।
হরেক চাটগাঁ নামের আদি উৎসের বিষয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজে জানা যায়, বিচিত্রে ভরা চট্টগ্রামও বৈচিত্র্যময়ী এক জনপদ। আজ যে ‘চট্টগ্রাম’ নামটি নিকার কর্তৃক বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় ব্যবহারের জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে খ্রিস্টীয় দশ শতকের আগেও এ ধরনের (চট্টগ্রাম) নামের কোন অস্তিত্বই ছিল না। অর্থাৎ চট্টগ্রাম নামটির আদি উৎসের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এটি চিটাগাং বা চাটগাঁ ও এ ধরনের আরো কিছু নামের পরবর্তী অপভ্রংশ বা বানান পরিবর্তন বলেই অনেকে মনে করেন। ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদানে চিটাগাংয়ের ৪৮টি নাম পাওয়া গেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চিটাগাং, চাটগাঁ, চাটিগ্রাম, চাটগাম, সুহ্মদেশ, ক্লীং, রম্যভূমি, চাতগাঁও, চট্টল, চৈত্যগ্রাম, সপ্তগ্রাম, চট্টলা, চক্রশালা, পুস্পপুর, চিতাগঞ্জ ইত্যাদি। কিন্তু নামের অপভ্রংশ ছাড়া ‘চট্টগ্রাম’ নামের কোন মৌলিকত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এদিকে ১৩৯৭ খ্রিস্টাব্দে লিখিত বিখ্যাত সুফি সাধক মুজাফফর শামস বলখির চিঠিতে চাটগাঁও নামের উল্লেখ দেখা যায়। এ অঞ্চলের নামের উৎস খুঁজতে গিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রথমে উদ্ধৃত করেছেন বুদ্ধধর্মাবলম্বীদের ভাষ্য, চৈতকিয়াং কিংবা চৈতাগ্রাম, চৈতার অর্থ হলো বুদ্ধের স্মৃতিসৌধ। সেই থেকে সম্ভবত এ অঞ্চলের নাম চট্টগ্রাম। ইতিহাসের আরো কিছু বিবরণীতে জানা যায়, এ অঞ্চলে একটি অনন্যসুন্দর প্রজাতির পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যেত। এ পাখিটির নাম ‘ছাতগ’। সেই থেকে সুপ্রাচীনকাল থেকে ‘চাটিগাঁ’ নামের উৎপত্তি হতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।