Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

থামছে না ডাকাতের দৌরাত্ম্য

অর্থনীতির লাইফ লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আতঙ্ক

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ২ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে থামছে না ডাকাতের দৌরাত্ম্য। নিত্যনতুন কৌশলে চলছে ডাকাতি, ছিনতাই। তাদের প্রধান টার্গেট আমদানি-রফতানি পণ্যবাহি ট্রাক, কার্ভাডভ্যান। তবে যাত্রীবাহি বাস থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত গাড়িতেও হানা দিচ্ছে সশস্ত্র ডাকাত দল। ফলে আতঙ্ক নিয়েই মহাসড়ক পার হচ্ছেন চালক ও যাত্রীরা। মহাসড়কে ডাকাতি প্রতিরোধে শুধু র‌্যাবের অভিযানেই দুই বছরে মারা গেছে ছয় ডাকাত। জানা যায়, মহাসড়কের চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা ময়নামতি পর্যন্ত ছোট বড় অন্তত ১৫টি ডাকাত চক্র তৎপর রয়েছে। তাদের প্রতিটি চক্রে রয়েছে ১৫ থেকে ২০ সদস্য।
মহাসড়কের সীতাকুন্ডে একটি হত্যা মামলার তদন্তের সূত্র ধরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিপিআই গতকাল (রোববার) এমন একটি চক্রের দুই সদস্যকে পাকড়াও করেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে কয়েক মাসে ৭টি বড় ধরনের ডাকাতির তথ্য পাওয়া গেছে। এই দলের বাকি ১৫সদস্যকে ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে বলে জানান পিবিআই চট্টগ্রামের কর্মকর্তারা। র‌্যাব-পুলিশ এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের দেওয়া তথ্যমতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর থেকে মেঘনা, মেঘনা থেকে দাউদকান্দি, দাউদকান্দি থেকে ফেনী ও সীতাকুন্ড থেকে চট্টগ্রাম- এ চারটি পয়েন্টে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বেশি।
এলাকাভিত্তিক রয়েছে ডাকাত-ছিনতাইকারীদের সংঘবদ্ধ চক্র। সড়ক পথে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সাথে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এই মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন ৬০ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করে। কিন্তু মহাসড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপ্রতুলতার সুযোগ নিচ্ছে ডাকাত ও ছিনতাইকারীচক্র।
আবার কখনো ডিবি পুলিশ পরিচয়ে পণ্যবাহী ট্রাক, কার্ভাডভ্যানের উঠে তল্লাশির নামে পণ্য লুট করা হচ্ছে। রফতানিপণ্যের শিপমেন্ট ঠিক রাখতে ডাকাত চক্রের কাছ থেকে ফের এসব পণ্য কিনে নিতেও বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ও পণ্য পরিবহন মালিক অ্যাসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে বলেন ডিবি পরিচয়ে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চালককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ট্রাক বা কাভার্ডভ্যানটি তারা চালিয়ে নিয়ে যায়। অনেক সময় ডাকাতির পণ্য ডাকাতদের কাছ থেকেই কিনে নিতে হয় ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিগুলোকে। গত এক বছরে মহাসড়কে বেশ কয়েকটি পণ্যবাহি পরিবহনে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ডাকাতির মালামাল উদ্ধারও করেছে পুলিশ। পণ্যবাহি ভারী যানবাহনের পাশাপাশি যাত্রীবাহি বাস ও ব্যক্তিগত গাড়িতেও ডাকাতির ঘটনা বাড়ছে।
খুনের মামলা তদন্তে ধরা পড়লো ডাকাত
গত বছরের ১৭ জুন সীতাকুন্ডের বারবকুন্ডু ইউনিয়নের হাশেম নগরে গুলিবিদ্ধ যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই নিশ্চিত হয় নিহত মোঃ কামাল সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সদস্য। মহাসড়কের বারবকুন্ডু এলাকায় একটি প্রাইভেট কারে ডাকাতি করে তারা। পরে ডাকাতির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধের জেরে কামালকে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় জড়িত ডাকাত দলের সদস্য মোঃ জসিম উদ্দিন (৩৭) ও মোঃ ইকবাল হোসেনকে (২৫) গ্রেফতার করে পিবিআই। গতকাল নগরীর দক্ষিণ খুলশীর পিবিআই কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে পিবিআইর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রেজাউল করিম জানান, এ ডাকাত চক্রের সদস্য সংখ্যা ১৭ জন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছে মহাসড়কের চৌদ্দগ্রামে এক প্রবাসীর প্রাইভেট কারে ২৫ লাখ টাকা ও বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালঙ্কার লুটসহ গত কয়েকদিনে তারা সাতটি বড় ধরনের ডাকাতি করেছে। জসিমের বিরুদ্ধে খুন ও ডাকাতির অভিযোগে তিনটি এবং ইকবালের বিরুদ্ধে চারটি মামলা রয়েছে। তিনি জানান, মহাসড়কের চট্টগ্রাম থেকে ময়নামতি অংশে ব্যক্তিগত গাড়িতে যতগুলো ডাকাতি হয়েছে তার প্রায় সবগুলোর সাথেই এরা জড়িত।
নিত্যনতুন কৌশল
গ্রেফতারকৃত ওই দু’জনের বরাত দিয়ে পিবিআই পরিদর্শক আবু জাফর মোঃ ওমর ফারুক বলেন, এরা নিত্যনতুন কৌশলে মহাসড়কে ডাকাতি করে। এদের প্রধান টার্গেট হয় বিদেশ ফেরত যাত্রীদের প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস। টার্গেটকৃত গাড়ি লক্ষ্য করে এরা কখনও বড় পাথর, কখনও লাঠি ছুঁড়ে মারে। পাথর ও লাঠির আঘাতে গাড়ির গ্লাস ভেঙে গেলে চালক গাড়ি থামিয়ে ফেলে। কখনও আবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে থেমে যায় গাড়ি। আর এ সুযোগে এসব গাড়িতে হানা দেয় ডাকাত দল। কখনও আবার গাড়ির সামনের গ্লাসে ছুঁড়ে মারে আস্ত ডিম। ডিম ফেটে গাড়ির গ্লাস ঘোলা হয়ে গেলে চালক বাধ্য হয়ে গাড়ি থামিয়ে ফেলে। আর তখন এরা চালক ও যাত্রীদের জিম্মি করে লুটপাট করে। চৌদ্দগ্রাম ও সীতাকুন্ডে এ কৌশলে তারা বড় ধরনের দু’টি ডাকাতি করেছে। পিবিআই কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি বিয়েবাড়ির একটি গাড়ি ও এক সেনা কর্মকর্তার গাড়িতে লাঠি মেরে গ্লাস ভেঙে দিয়ে ডাকাতি করে ডাকাত দলের সদস্যরা। আটক দুই ডাকাত জানায়, ঢাকার শাহজালাল এবং চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাদের সোর্স থাকে। বিদেশ থেকে আসা কোন যাত্রী মহাসড়ক হয়ে যাওয়ার আগেই তারা খবর পেয়ে যায়। এরপর মহাসড়কের সুবিধাজনক অংশে ওই গাড়িতে হানা দেয় তারা।
গ্রেফতার এড়াতেও কৌশল
পিবিআই চট্টগ্রামের তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গ্রেফতার জসিমের কাছ থেকে পাওয়া গেছে আটটি মোবাইল। তার কাছে আছে ২০টি বিভিন্ন কোম্পানির সিম। ইকবালের কাছেও ১০টি মোবাইল ফোন ও ১৫টি সিম পাওয়া গেছে। তাদের মতো ডাকাত দলের সব সদস্যদের কাছে অসংখ্য সিম রয়েছে। এসব সিম ও মোবাইল ব্যবহার করে তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে। সিমের রেজিস্ট্রেশনও তাদের নামে নেই। বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির বিক্রয় কর্মীদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তারা এসব বø্যাঙ্ক সিম সংগ্রহ করে। আর এ কারণে ডাকাতির পরও তাদের গ্রেফতার করতে বেগ পেতে হয়। মহাসড়কে ডাকাতির পর ওদের একটি অংশ কক্সবাজারের চকরিয়া, অপর অংশ কুমিল্লার ময়নামতিতে চলে যায়। এ দু’টি এলাকায় তারা বাসা ভাড়া করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করে। এসব কৌশলের কারণে প্রযুক্তি ব্যবহার করেও এসব ডাকাতদের ধরা কঠিন বলে জানান পিবিআই পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান।
অরক্ষিত মহাসড়ক
চট্টগ্রাম বন্দরমুখী আমদানি-রফতানি পণ্যবাহি হাজার হাজার ভারী যানবাহনের পাশাপাশি মহাসড়কে চলছে যাত্রীবাহি বিলাসবহুল বাস ও ব্যক্তিগত যানবাহন। কিন্তু নিরাপত্তায় তেমন কড়া নজরদারি না থাকায় অনেকটা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে মহাসড়ক। মহাসড়কের চট্টগ্রাম অংশ দেড়শ’ কিলোমিটারের বেশি। এর মধ্যে হাইওয়ে পুলিশের ফাঁড়ি রয়েছে মাত্র ৩টি। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কম হওয়ার কারণেও ডাকাতি প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। আবার ডাকাতির ঘটনা তদন্ত করে থানা-পুলিশ। ফলে ডাকাতদের বিস্তারিত তথ্য জানা থাকে না হাইওয়ে পুলিশের। মহাসড়কে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি উদ্যোগে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা) স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও পরে সেই উদ্যোগ থেকে সরে আসে পুলিশ। মহাসড়কে ডাকাতি প্রতিরোধে কাজ করছে র‌্যাব। র‌্যাবের সর্বশেষ তথ্যমতে, ২৩ ফেব্রুয়ারি সীতাকুন্ডের কুমিরায় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় এক ডাকাত। এর আগে একইভাবে ২০১৬ সালের ১৮ নভেম্বর ফেনীতে দুই, ২৯ অক্টোবর মিরসরাইয়ে তিন এবং ১৮ এপ্রিল জোরারগঞ্জে দুই ডাকাত মারা যায়। ডাকাতি প্রতিরোধের সময় এসব ঘটনা ঘটে। তবে এরপরও মহাসড়কে থামছে না ডাকাতের দৌরাত্ম্য।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হাসড়ক

২৮ ডিসেম্বর, ২০২২
২১ ডিসেম্বর, ২০২২
২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ