Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের কোন্দল বাড়ছেই

থামছে না খুন সহিংসতা

| প্রকাশের সময় : ৩০ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রাম নগরীর মেহের আফজাল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে হানা দিয়ে প্রকাশ্যে অসংখ্য মানুষের সামনে যুবলীগ কর্মী মোঃ মহিউদ্দিনকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করেন আওয়ামী লীগ নেতা হাজি ইকবালের লোকজন। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের উৎসবের দিনে নির্মম নৃশংস এই খুনের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের কেউ এখনও ধরা পড়েনি। মহিউদ্দিনের মায়ের অভিযোগ হাজি ইকবাল নিজেই এই খুনের নেতৃত্বে ছিলেন। সরকারি দল আওয়ামী লীগের দুই গ্রæপের বিরোধে সংগঠিত এই খুনের ঘটনায় জড়িতরা ধরা না পড়ায় ক্ষোভে ফুঁসছে মহিউদ্দিনের অনুসারীরা। এলাকার পরিস্থিতি এখনও থমথমে, যে কোন সময় ফের সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা স্থানীয়দের।
বন্দরনগরীর দক্ষিণ-মধ্যম হালিশহরের মতো অনেক এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মুখোমুখি সরকারি দলের বিভিন্ন গ্রæপ। টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি আর এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে সশস্ত্র সহিংসতায় মেতে উঠছে তারা। দলীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই নয়, নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে প্রতিনিয়তই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতকর্মীরা। নিজ দলের কর্মীদের নির্মমভাবে খুন করা হচ্ছে। টানা দুই মেয়াদে সরকারের প্রায় নয় বছরে বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে অসংখ্য খুনের ঘটনা ঘটেছে দলীয় কোন্দলের জেরে। কেন্দ্র থেকে সংঘাত সহিংসতা থামাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি। কলহ বিরোধ কিছুদিন চাপা থাকলেও ফের তা চরমে উঠে। জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ২২টি সংসদীয় আসনে নৌকা মার্কা পেতে মাঠে শতাধিক নেতা। প্রবীণ কেন্দ্রীয় নেতাদের চ্যালেঞ্জ করতে মাঠে শক্তি প্রদর্শনে ব্যস্ত উঠতি ও হাইব্রিড নেতাদের অনেকে। এরফলে মনোনয়নের লড়াইকে ঘিরে দলীয় কোন্দল আরও বাড়বে এমন আশঙ্কা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দলীয় কোন্দলের বলি হয়েছে অনেকে। এসব খুনের ঘটনায় জড়িতরা ধরা পড়ছে না। প্রভাবশালীদের চাপের কারণে অভিযুক্তদের ধরতে সাহস করে না পুলিশ। নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী, মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক নাছিম আহমেদ সোহেল, সিটি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা ইয়াছিন আরাফাত, যুবলীগ নেতা মেহেদী হাসানসহ ছাত্রলীগ যুবলীগ নেতাদের খুনিরা ধরা পড়ছে না। দলীয় কোন্দলে সর্বশেষ শিকার যুবলীগ কর্মী মহিউদ্দিন। তিনি ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম মোঃ কাদের ও ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি হাসানের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন তিনি। হাজি ইকবাল তার বিরোধী গ্রæপ হিসেবে পরিচিত। হাজি ইকবালকে দল থেকে বহিষ্কার করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এরপর থেকে তাকে এড়িয়ে চলতেন যুবলীগ কর্মী মহিউদ্দিন। স্থানীয়রা বলছেন, হাজি ইকবাল আগামী নির্বাচনে নগরীর বন্দর পতেঙ্গা আসন থেকে নৌকার মনোনয়ন চাইবেন। এলাকায় তার প্রভাব বিস্তারে মহিউদ্দিনকে বাধা মনে করতেন তিনি। আর এ কারণেই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মহিউদ্দিনের স্বজনদের অভিযোগ, তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে হাজি ইকবাল। অবশেষে তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হলো।
এ খুনের ঘটনায় হাজি ইকবালকে প্রধান আসামী করে ১৭ জনের বিরুদ্ধে বন্দর থানায় মামলা করেন মহিউদ্দিনের মা। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) বন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বিকাশ চন্দ্র সরকার ইনকিলাবকে বলেন, এজাহার নামীয় ১৭ জনের মধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হাজি ইকবালসহ বাকি আসামীরা পালিয়ে গেছে। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে এ খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তদন্তে যারা অভিযুক্ত হবে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হবে।
এদিকে স্বাধীনতা দিবসে দলীয় কোন্দলে যুবলীগ কর্মী খুনের ঘটনায় মহানগর আওয়ামী লীগে তোলপাড় চলছে। স্থানীয়রা বলছেন, মেহের আফজাল স্কুলটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ওই স্কুলে হানা দেয়ার সাহস করেনি কখনও। অথচ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর সেই স্কুল ভবন রক্তাক্ত হলো যুবলীগ কর্মীর রক্তে। স্থানীয়রা এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করেন। তবে এ খুনের ঘটনায় জড়িত আওয়ামী লীগ নেতা হাজি ইকবাল ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন খবরও পাওয়া যায়নি। ঘটনায় জড়িতরা সরকারি দলের হওয়ায় পুলিশও তাদের ধরতে তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়নি। এ প্রেক্ষাপটে নগরীতে সংঘটিত অন্যান্য খুনের মতো মহিউদ্দিন খুনের ঘটনাও চাপা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তার স্বজনদের।
নিজেদের মধ্যে খুনোখুনির পাশাপাশি উঠতি কিশোর-যুবকদেরও বিপথগামী করছে ছাত্রলীগ যুবলীগের কতিপয় নেতা। এদের মদদে এবং প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নগরীতে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী কর্মকাÐ সংঘটিত হয়। এসব ঘটনায় জড়িত গডফাদারদের পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার পরও তাদের গ্রেফতার করছে না পুলিশ। গত ১৭ ফেব্রæয়ারি নগরীর দুই নম্বর গেইটে পুলিশের চেকপোস্টে গুলি করে কয়েকজন কিশোর। এতে আহত হন আবদুল মালেক নামে পুলিশের একজন এএসআই। ওই ঘটনায় জড়িত ১০ জনের আশ্রয়দাতা ও অস্ত্রদাতা ওমরগণি এমইএস কলেজ ছাত্র সংসদের এক নেতার অনুসারী। তার নাম পরিচয় পাওয়ার পরও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি। এর আগে গত ১৬ জানুয়ারি নগরীর জামালখান আইডিয়াল স্কুলের সামনে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান ইসফারকে। ওই হত্যাকাÐের আদনানের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়েছিল হামলাকারীরা। অস্ত্রটি সরবরাহ করেছিল মহসিন কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতা। ঘটনার পরদিন রাতে হত্যাকাÐে জড়িত ৫ কিশোরকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। এই কিশোরদের আশ্রয়দাতা হিসেবে চন্দনপুরা এলাকার জনৈক আওয়ামী লীগ নেতা রউফের নাম এসেছে। ওই রউফ এখনও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
গত ২৭ ফেব্রæয়ারি নগরীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দুই গ্রæপের সংঘর্ষে পÐ হয় উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন। সেখানে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে বোমাবাজি ও মারামারি করে ছাত্রলীগের কর্মীরা। এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেও কারও বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তার আগের দিন লালদীঘি ময়দানে মহিউদ্দিন চৌধুরীর শোকসভায় সংঘর্ষে জড়ায় নগর ছাত্রলীগের দুই গ্রæপ। সেখানেও অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগের তান্ডব দেখেন কেন্দ্রীয় নেতারা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কলেজ, হাজি মুহাম্মদ মহসিন কলেজসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাস ও পাড়া মহল্লায় নিয়মিত সংঘাত সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছে ছাত্রলীগ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ