পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
তৃণমূলে গণতন্ত্রায়নের লক্ষ্যে যে ইউপি নির্বাচন হচ্ছে, তা এক ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। দেখা যাচ্ছে, এ নির্বাচন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথটিকে প্রশস্ত করার পরিবর্তে রক্তে রঞ্জিত করছে। ভোট কেন্দ্র দখল, হুমকি-ধমকি, প্রতিপক্ষ তো বটেই, এমনকি নিজ পক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বীকে মাঠছাড়া করা, পেশীশক্তির ব্যবহার, ভোটের আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখাসহ হেন কোনো অনিয়ম নেই যা হচ্ছে না। এ নির্বাচন সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল বাদে অন্য প্রার্থীদের অনেকে জীবন ও পরিবার বাঁচাতে আগেভাগেই নির্বাচন থেকে সরে যাচ্ছে। যারা সমান সমান ক্ষমতা নিয়ে নির্বাচন করছেন, তাদের মধ্যে নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তীতে বাঁধছে ভয়াবহ সংঘর্ষ। এ সংঘর্ষে আহত-নিহত হচ্ছে নিরীহ মানুষ। সংঘর্ষের শিকার হচ্ছে বৃদ্ধ, নারী ও শিশু। ইউপি নির্বাচন দেশের গ্রামে গ্রামে ভয়াবহ আতঙ্ক হয়ে হাজির হচ্ছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে নির্বাচন পর্যবেক্ষকসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সচেতন মহল এমনকি বিদেশীরাও তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। প্রত্যেকেই বলছেন, নির্বাচনের নামে তৃণমূল পর্যায়ে প্রহসন চলছে। তারা নির্বাচন কমিশনের চরম ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা নিয়ে বরাবরের মতো তীব্র ক্ষোভ ও সমালোচনা প্রকাশ করছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্তও বলেছেন, আমাদের নির্বাচন কমিশন লড়েও না, চড়েও না। তিনি আকুতি জানিয়ে বলেছেন, একটা কিছু করুন, একটা কিছু করুন। সিপিবি’র সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, ইউপি নির্বাচনে জনগণের ভোটের অধিকারের গণতন্ত্রে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া স্টিফেন ব্লুম বার্নিকাট কূটনৈতিক ভাষায় বলেছেন, নির্বাচনে সংঘাত ও সহিংসতা মেনে নেয়া যায় না। নির্বাচন নিয়ে এ সব প্রতিক্রিয়া বাদ দিয়েই বলা যায়, দেশের একজন অতি সাধারণ মানুষও জানে ইউপি নির্বাচন কেমন হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে। তাদের উদ্বেগ সীমাহীন হয়ে পড়ছে। গ্রামে-গঞ্জে প্রভাবশালীদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন সুরক্ষিত থাকলেও উদ্বিগ্ন এসব সাধারণ মানুষের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনরাই নির্বাচনের শিকার হচ্ছে। গণতন্ত্রায়নের নামে প্রহসনের যে নির্বাচন মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে হিংস্রতার জন্ম দেয় এবং জীবন ও বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেয়, তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যে নির্বাচন কমিশনের অক্ষমতা, মেরুদ-হীনতা ও ব্যর্থতা নিয়ে সরকারি দল বাদে সর্ব মহলে এত নিন্দার ঝড় বইছে, সেই নির্বাচন কমিশনের কোনো বিকার নেই। সে একটার পর একটা নির্বাচন দিয়ে মানুষের জানমালকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তার মধ্যে এমন প্রবণতা গেঁড়ে বসেছে যে, নির্বাচন করতেই হবে, তাতে কে মরল আর কে বাঁচল তাতে কিছু যায় আসে না। নির্বাচন দিয়েই সে যেন খালাস পেতে চাচ্ছে। তার যেন আর কোনো দায়িত্ব নেই। এ ধরনের প্রবণতাকে বিকৃতি ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! নির্বাচনের আগে সাংবাদিকদের কাছে অনিয়মের ক্ষেত্রে কঠোর ভাষায় দুয়েকটি কথা, এমনকি গুলি করার কথা বলা ছাড়া কার্যক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের আর কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। নির্বাচনে ভয়াবহ সংঘাত-সংঘর্ষ ও মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে এমন কথাও বলতে দেখা গেছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কথা শুনছে না। তারপরও তারা নির্বাচন চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের নামে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বাঁধিয়ে মানুষকে আহত-নিহত করার মতো এমন কর্মসূচি বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় কিনা, আমাদের জানা নেই। বোধহীন ও কা-জ্ঞানহীন এমন নির্বাচন কমিশন বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিজ্ঞজনরা এ কমিশনের পাহাড়সম ব্যর্থতা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করলেও তার কোনো বোধবুদ্ধির উদয় হচ্ছে না। বলা যায়, এ কমিশন ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের যেটুকু সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা অবশিষ্ট ছিল, তা নিঃশেষ করে দিয়েছে। গণতন্ত্রকে দৃঢ় ভিতের উপর দাঁড় করাতে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ ও সংঘাত-সহিংসতামুক্ত করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন ছিল, তা এই প্রতিষ্ঠানটি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচনে এ পর্যন্ত ৩২ জন নিহত ও পাঁচ শতাধিক আহত হওয়ার মধ্য দিয়েই তা প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের মতোই আইন-শৃংখলা বাহিনী বিজ্ঞজনদের তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছে। কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-, হেফাজতে মৃত্যু, খুন, চাঁদাবাজি, নারীর শ্লীলতাহানি, মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়াসহ প্রায় সব ধরনের অপরাধে এর একশ্রেণীর সদস্যের জড়িয়ে পড়ার কথা সবাই জানেন। আইনের রক্ষক এবং সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান এ বাহিনীর প্রধান কাজ হলেও, কিছু সদস্য তার কোনো তোয়াক্কাই করছে না। তারা অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এতে পুরো বাহিনীটির ভাবমর্যাদা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যই যদি অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তবে সে কীভাবে মানুষের নিরাপত্তা বিধান করবে? ইউপি নির্বাচনে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে এবং হচ্ছে, এক্ষেত্রে যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তার কর্তব্যের কথা স্মরণ করে কার্যকর ভূমিকা রাখত, তবে নিশ্চিতভাবেই এত আহত-নিহত ও বাড়িঘর ধ্বংস হতো না। আমাদের দেশের ট্র্যাডিশন অনুযায়ী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ক্ষমতাসীন দলের আজ্ঞাবহ হবে, এটা কারো অজানা নয়। তবে এ বাহিনী যদি ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের মতো বা তার অনুরূপ আচরণ করে, তবে তার কাছ থেকে সাধারণ মানুষের ন্যায্য আচরণ পাওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। পুলিশের এ ধরনের আচরণ কাম্য না হলেও ইতোমধ্যে জনমনে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সরকার এ বাহিনীর উপর ভর করেই টিকে আছে। অনেককে বলতে শোনা যায়, দেশ পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশ ইতিবাচক হোক আর নেতিবাচক হোক, যা খুশি তা করতে পারবে। তবে সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশের নেতিবাচক দিকটিই বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এ কথা বহুবার বলা হয়েছে, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে অতি ব্যবহার করার ফলে তার পক্ষে মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা সম্ভবপর হচ্ছে না। ইউপি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও পুলিশের এ আচরণ পরিদৃষ্ট হয়েছে। প্রতিপক্ষকে বিতাড়ন কাজে দৃষ্টিকটুভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে ইউপি নির্বাচন ক্রমান্বয়ে মারাত্মক সহিংস হয়ে উঠেছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, গণতন্ত্র এবং ন্যায় ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দুটি স্তম্ভ নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ বিভাগের ভাবমর্যাদা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। প্রতিষ্ঠান দু’টি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ যে ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে, তা ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের অকার্যকারিতায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেছে। সেখানে সংঘাত-সংঘর্ষ ও পারস্পরিক হানাহানি ছড়িয়ে পড়েছে। যারা জোর-জবরদস্তির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের রক্তে রঞ্জিত পথ বেয়ে নির্বাচিত হচ্ছেন, তারা যেমন গণতন্ত্র বোঝে না, তেমনি তাদের দ্বারা কস্মিনকালেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আমরা মনে করি, এ বিষয়টি সরকারের উপলব্ধি করা উচিত। সরকারের বুঝতে হবে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে আর যাই হোক দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সরকারকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নয়, জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিতে হবে। তা না হলে এর দায়-দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।