Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুক্তার খনি বাঁচবে তো?

দক্ষিণ এশিয়ায় মিঠাপানির মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক

| প্রকাশের সময় : ২৭ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী বহুমুখী সঙ্কটে : অবশেষে সংরক্ষণে প্রশাসনিক পদক্ষেপ শুরু
শফিউল আলম : নদীর বুকজুড়ে জেলে নৌকার দীর্ঘ বহর। ভিন্ন রকমের নৌকা। চৌকস জেলের দল। অন্য সাধারণ জেলেদের মতো তারা নন। দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার সাথে বৃষ্টি-বজ্রবৃষ্টির মওসুম, আকাশ-বাতাসে আবহাওয়ার মেজাজ-মর্জি বুঝেই নদীতে নৌকার বহর ছুটিয়ে চলেন তারা। দীর্ঘ নদীর বুকজুড়ে এখানে-সেখানে নজর বুলিয়ে অগুণতি মা-মাছের ছেড়ে দেয়া নদীতে ভাসমান ডিম সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। উজ্জ্বল চকচকে মুক্তার দানার মতো লাখ লাখ ডিম। রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউস, চিতল ইত্যাদি কার্প শ্রেণির অর্থকরী হরেক বড় জাতের মাছের এই ডিমরাশি থেকে সুকৌশলে ও সতর্কতার সঙ্গে ফোটানো হয় রেণু আর পোনা মাছ। আর সেই পোনাই দেশের সোনা। সারা বাংলাদেশের পুকুর, দীঘি, জলাশয়সহ মৎস্য খামারে চাষের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এই মুক্তাদানা তথা মূল্যবান মাছের ডিমরাশি থেকে উৎপাদিত রেণু, পোনা ও বড় মাছের বার্ষিক মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। মুক্তাদানা ডিম বা পোনার যোগানদার দেশের বিশেষ এক প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ‘অর্থনৈতিক নদী’ চট্টগ্রামের হালদা নদী। এই নদী এবং তার প্রকৃতিগতভাবেই উৎপাদিত মৎস্যসম্পদকে আল্লাহতায়ালার অপার এক রহমত একই সঙ্গে বিস্ময় হিসেবেই দেখে আসছেন দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীরা। হালদা নদীটির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, এই নদীতে মিঠাপানির বড় জাতের মা-মাছের সদলবলে ডিমরাশি ছেড়ে দেয়া এবং সেই ডিম থেকে রেণু ও পোনা উৎপন্ন হওয়া এসব বিষয়ে গবেষণার যেন শেষ নেই।
এদিকে প্রতিনিয়ত দূষণ, দখল-বেদখল, ভরাট, যথেচ্ছ ড্রেজিং ও বালু উত্তোলন, রাসায়নিক ও বর্জ্য নিঃসরণ, অপরিকল্পিত বাঁধ ও রাবার ড্যাম নির্মাণ এবং নির্বিচারে অপরিপক্ক ও মা-মাছ নিধন, গতিপথে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ ও বাধা সৃষ্টিসহ বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন সাধনের শিকার হয়েছে হালদা দীর্ঘদিন ধরেই। বহুমুখী সঙ্কটে পড়েছে হালদা। এতে করে প্রকৃতির উপর খড়গ চালিয়ে মানুষের অপরিণামদর্শী ভয়াবহ কর্মকাÐের পরিণতিতে হালদা এবং এর মৎস্যসম্পদ ভাÐার বিপন্ন হতে চলেছে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বছর বছর ধরে বিশেষজ্ঞগণ ও একই সাথে চট্টগ্রামবাসী প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। হালদা নদীকে ধ্বংসের কবল থেকে সুরক্ষায় সরকারকে তারা বারে বারে সতর্ক করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে হালদা রক্ষাকল্পে সরকারি প্রশাসনের টনক নড়েছে। বিলম্বে হলেও এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গত দুই সপ্তাহ যাবত প্রশাসন কঠোর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে হালদায় মৎস্যসম্পদ সুরক্ষায়। অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের হাতেনাতে আটক করা হয়েছে কয়েক দফায়। ছোট ফাঁসের জালসহ চোরা শিকারিদের আটক করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বেআইনি জাল। এসব পদক্ষেপের ফলে নতুন করে আশাবাদ জাগ্রত হয়েছে, এবার হয়তো এই মুক্তার খনি বাঁচবে। সমগ্র দেশের মৎস্যসম্পদের উন্নয়নে হালদা নদীর একক বৃহৎ অবদান হবে আরও সম্প্রসারিত। দেশের জনগণও উপকৃত হবে আমিষের বিশাল এই উৎস ভাÐারকে সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা যাবে। তবে সচেতন চট্টগ্রামবাসী হালদা দখল-দূষণকারী ও মা-মাছ, অপরিপক্ক (নলা) মাছ নিধনকারীদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অভিযান পরিচালনার তাগিদ দিয়েছেন।
কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের সদ্যবিদায়ী জেলা প্রশাসক মোঃ জিল্লুর রহমান চৌধুরী (বর্তমানে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব) হালদা সংরক্ষণের লক্ষ্যে কঠোর অ্যাকশন প্ল্যান এবং সুপারিশমালা দিয়ে গেছেন। এর আওতায় গত দুই সপ্তাহ যাবত হালদা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলার অপব্যবসা চালানোর সময় হাতেনাতে বালুভর্তি ১৩টি নৌকা এ যাবত আটক করা হয়েছে। তাছাড়া আগুনে পোড়ানো হয় সাড়ে ৮শ’ মিটার জব্দকৃত জাল। হালদা নদীর ৫টি এলাকা থেকে এসব নৌকা ও জাল আটক করা হয়। নদীতে মা-মাছের অবাধ বিচরণের পথে বালু উত্তোলন, ইঞ্জিন চালিত নৌকার চলাচল ও মাছ ধরা ব্যাপক বাধা ও সমস্যা। এসব কর্মকাÐ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকলেও কতিপয় অসৎ ও অতিলোভী ব্যক্তি তা অমান্য করেই চলেছে। এর বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে অভিযান। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। হালদার আর ক্ষতি হতে দেয়া যাবে না। দখল ও দূষণকারীদের তালিকা তৈরি করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গবেষকরা জানান, দক্ষিণ এশিয়ায় হালদার রয়েছে অনন্য বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য। একমাত্র জোয়ার-ভাটা নির্ভর এ নদী থেকে সরাসরি রুই, কাতলা, মৃগেল (কার্প) জাতীয় মিঠাপানির বড় বড় জাতের মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়। বর্ষার আগে অথবা মওসুমের প্রথম দু’তিন দফায় তুমুল বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের যুৎসই সময়েই রুই, কাতলা, মৃগেল জাতীয় মা-মাছেরা দল বেঁধে হালদা নদীর বুকে ডুবভাসি করে করে ডিম ছাড়ে। সেই মুক্তাদানার মতো ডিম থেকে ফোটানো রেণু পোনা-বীজ জেলেদের হাতবদল হয়ে সারাদেশে মাছচাষি ও খামারিদের কাছে পৌঁছে যায়।
হালদার ডিম থেকে সৃষ্ট রেণু-পোনার মৃত্যুহার খুবই কম। সেই মাছও খুব তা দ্রæত বর্ধনশীল। এরফলে জাতীয় অর্থনীতিতে হালদা নদীর প্রত্যক্ষ অবদান বার্ষিক এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। তাছাড়া ফল-ফসল, কৃষি খামারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নদীটির অবদান আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা। হালদা কর্মসংস্থান নিশ্চিত করছে প্রায় এক লাখ মানুষের। চট্টগ্রামের জীবন-জীবিকার সাথে নদীটির নিবিড় সম্পর্ক।
হালদা নদী গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোঃ মনজুরুল কিবরীয়া মনে করেন, অপার সম্পদ, অর্থনৈতিক অবদানসহ বেশকিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এই নদী বাংলাদেশের ‘জাতীয় মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র’ হিসেবে ঐতিহ্যের দাবিদার। এটি হচ্ছে ‘মাছের ব্যাংক’। মাছসহ জীববৈচিত্র্যে ভরা ‘জীন ব্যাংক’। তবে অবিরাম দূষণ, ভরাট, বেদখল, নদীর গতিপথে বাধার কারণে মানুষ হালদার টুটি চেপে ধরেছে। লবণাক্ততার বিস্তার এবং আবহাওয়া-জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের ধারায় বিপন্ন অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য বিচরণক্ষেত্র। এর নেতিবাচক প্রভাবে অকালে বা অসময়ে বিক্ষিপ্তভাবে ডিম ছাড়ছে মা-মাছেরা। ডিম ছাড়ার হারও কমে গেছে। মাছের বিচরণে বিষিয়ে উঠেছে পরিবেশ। শুধু তাই নয়; স¤প্রতি বৈরী পরিবেশে টিকতে না পেরে বেশ কয়েকটি ডলফিনের মুত্যু ঘটেছে। জাতীয় অর্থনীতিতে অবদানকে গুরুত্ব দিয়ে হালদা নদীর সুরক্ষা অপরিহার্য। অন্যথায় আমরা মিঠাপানির মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রটি হারাবো। হারিয়ে যাবে অজস্র জীববৈচিত্র্য।
এদিকে মাছের ব্যাংক হালদা সুরক্ষার লক্ষ্যে বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোঃ জিল্লুর রহমান চৌধুরী বিভিন্ন সুপারিশে বলেছেন, হালদার বুকে ১৭টি বালুমহাল বিলুপ্ত করতে হবে। মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন নির্বিঘœ করতে হালদা নদী থেকে বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। তার প্রতিবেদনে বলা হয়, নাজিরহাট সেতু থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত হালদা নদীর ৪০ কিলোমিটার অভয়াশ্রম রয়েছে। সেখানে নদীর বুকে ১৭টি বালুমহাল রয়েছে। সেসব বালুমহাল প্রতিবছর ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। এরমধ্যে ১৪টি বালুমহাল ফটিকছড়ি এলাকায় এবং তিনটি রাউজানে রয়েছে। এসব বালু মহাল বন্ধ একই সাথে মাছের অবাধ বিচরণের জন্য মৎস্য সুরক্ষা আইন অনুযায়ী নদীর গতিপথে প্রাকৃতিক অভয়াশ্রম সংরক্ষণ, ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ থাকতে হবে। তাছাড়া হালদা নদীর গতিপথে রাবার ড্যাম ও বিভিন্ন উপায়ে প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করতে হবে। উক্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশের ভিত্তিতে প্রশাসন অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ আশাবাদী, এ অভিযান অব্যাহত থাকলে হালদা দেশের সর্বত্র আর বেশি পরিমাণে পোনা যোগান দিতে সক্ষম হবে। মাছ চাষে পোনার ঘাটতি পূরণ ছাড়াও উচ্চ ফলনশীল পোনা উৎপাদন প্রাকৃতিকভাবেই বৃদ্ধি পাবে। হালদায় মা-মাছেদের ডিমরাশি ছাড়ার ভরা মওসুম সমাগত। তার আগে হালদার কঠোর সংরক্ষণ জাতীয় স্বাথেই অপরিহার্য।



 

Show all comments
  • নাসির ২৭ মার্চ, ২০১৮, ৭:৪৩ এএম says : 0
    এটা সংরক্ষণে প্রশাসনিকভাবে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাছ

৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ