Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতি ও শর্তাবলী

| প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
ইসলাম মানবজীবনের অপরাপর শাখার ন্যায় অর্থব্যবস্থার ক্ষেত্রেও স্বভাবজাত চাহিদা ও বাস্তবতাকে অগ্রধিকার দিয়ে থাকে। তাই ইসলাম ব্যক্তিমালিকানার স্বীকৃতি দিয়ে ব্যক্তিকে পুঁজি, শ্রম ও মেধা বিনিয়োগে উৎসাহিত করেছে, যাতে উৎপাদন ব্যাহত না হয়। আবার আইনগত বৈধতা ও অবৈধতার সাথে হালাল-হারামের বিধানকে সংশ্লিষ্ট করে দিয়ে সেই অধিকারকে সীমিত করে দিয়েছে, যাতে জনস্বার্থ উপেক্ষিত না হয়। এমনিভাবে মূল্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও ইসলামের বক্তব্য হলো, তা সম্পূর্ণরূপে ক্রেতা-বিক্রেতার ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করবে। ক্রেতা-বিক্রেতা বা ভোক্তা-উৎপাদক যে নির্দিষ্ট মূল্যে ক্রয়-বিক্রয় সম্পাদন করতে সম্মত হবে, সে মূল্যেই পণ্য বা সেবা বিক্রীত হবে। এক্ষেত্রে তারা উভয়ে পরিপূর্ণ স্বাধীন থাকবে। কখনো মূল্য বেশিও হতে পারে, আবার কখনো কমও হতে পারে। মূল্য নির্ণয় ও মূল্য ওঠা-নামা সম্পূর্ণরূপে যোগানবিধি ও চাহিদাবিধির ওপরই নির্ভর করবে। যোগান বাড়লে মূল্য কমবে আর চাহিদা বাড়লে মূল্য বাড়বে বা অন্য কথায় চাহিদা কমলে মূল্য কমবে এবং যোগান কমলে মূল্য বাড়বে। চাহিদা ও যোগানের স্বয়ংক্রিয় বিধানকে ইসলাম স্বীকার করে নিয়েছে। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পনার আওতায় অর্থব্যবস্থাকে ইসলাম সীমাবদ্ধ করতে চায়নি। কারণ, তাতে মেধা ও শ্রম পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয় না।
ইসলাম পণ্যের চাহিদা ও যোগানের স্বয়ংক্রিয় বিধির আলোকেই মূল্য নির্ধারিত হওয়ার ব্যাপারে সম্মতি জ্ঞাপন করে। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার মত সর্বাবস্থায় মূল্য নির্ধারণের পূর্ণ ক্ষমতা সরকারের হাতে ন্যস্ত করতে ইসলাম রাজি নয়। কারণ, এতে মেধা ও শ্রমের পূর্ণ বিকাশ ঘটে না। এ জন্য ইসলাম অর্থব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন বলে মনে করে। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি দুনিয়ার জীবনে তাদের জীবনোপকরণকে তাদের মাঝে বণ্টন করে দিয়েছি এবং কতিপয়ের ওপর কতিপয়ের প্রাধান্য দিয়েছি, যাতে করে একজন আরেক জনকে কাজে লাগাতে পারে।
আল্লাহ কতিপয়ের মাধ্যমে কতিপয়ের জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করে থাকেন। একটি হাদিসে ‘আলী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট বলা হলো, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিন। তিনি উত্তরে বললেন, দ্রব্যমূল্য বাড়া-কমা আল্লাহর হাতে।’ ইমাম আল-হায়ছামী বলেন, এই হাদিসটির সনদে আল-আসবাগ ইবনু নাবাতাহ নামক ব্যক্তি রয়েছেন; যাকে ইমাম আল-আজলী নির্ভরযোগ্য বললেও অন্যান্য ইমাম তাকে যঈফ বলেছেন; কোন কোন ইমাম তাকে মাতরূক বলেছেন। এই হাদিসেও দ্রব্যমূল্য বাড়া-কমার বিষয়টি আল্লাহর হাতে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি এমন একটি প্রাকৃতিক নিয়ম সৃষ্টি করেছেন, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরমূল্য নির্ধারণ করে। সে বিধিটি চাহিদা ও যোগানবিধি। এ বিধিকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে না দিলে তা অন্যায় হবে এবং এর পরিণতিতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অশুভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।
আনাস বিন মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.-এর যুগে মদীনায় এক সময় মূল্যস্ফীতি ঘটেছিল। সাহাবা কিরাম রা. দ্রব্যসমূহের ভারসাম্যপূর্ণ ও উপযুক্ত একটি মূল্য নির্ধারণের জন্য রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট আবেদন করলেন। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁদের আবেদন প্রত্যাখান করলেন এবং বললেন, প্রতিটি বস্তুর মূল্য আল্লাহ তাআলা নিজেই নির্ধারণ করেন, (যা বাজার প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক নিয়মেই নির্ধারিত হয়ে থাকে।) তিনিই মূল্য সংকোচনকারী ও স¤প্রসারণকারী, তিনিই রিয্কদাতা। আমি আমার রবের নিকট এমন অবস্থায় সাক্ষাত করতে চাই, যেন তোমাদের মধ্য কেউ জান-মালের ব্যাপারে আমার বিরুদ্ধে যুলুমের অভিযোগ উত্থাপন করতে না পারে। না রক্তের বিষয়ে, না অর্থের বিষয়ে। এ হাদিসটি সামান্য শব্দগত পার্থক্যসহ একাধিক হাদিস গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে।
আবূ হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.-এর যুগে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে এক ব্যক্তি এসে রাসূল সা.-এর কাছে মূল্য নির্ধারণের জন্য আবেদন করলেন। রাসূল সা. বললেন, না, তা পারব না। হ্যাঁ, আমি দু’আ করব (যেন মূল্য হ্রাস পায় এবং সবার ক্রয়ক্ষমতায় চলে আসে)। এরপর আরেক ব্যক্তি এসে অনুরূপ আবেদন করলেন। তখন তাকেও বললেন, ‘না, তা আমার অধিকারে নেই। কারণ, আল্লাহ তাআলা নিজেই দ্রব্যমূল্যের উত্থান-পতন ঘটান। আমি চাই আল্লাহ সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করতে, যেন আমার বিরুদ্ধে কেউ যুলুমের অভিযোগ করতে না পারে। উল্লেখিত হাদিস দু’টি থেকে দু’টি বিষয় সুস্পষ্টভাবে জানা যায়। এক. সাহাবা কিরামের আবেদন সত্তে¡ও রাসূলুল্লাহ সা. মূল্যনির্ধারণ করেননি। দুই. মূল্যনির্ধারণকে রাসূলুল্লাহ সা. যুলুম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
ফিক্হবিদগণের মতে, যদি ব্যবসায়ী মহলের হস্তক্ষেপ ব্যতীত প্রাকৃতিক অভাবের কারণে যদি মূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে সরকার মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা রাখবে না। বরং তখন যোগান বাড়ানোর চেষ্টা করবে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবে। কারণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় হেতু কাঙ্খিত পরিমাণ ফসল উৎপাদন না হওয়ায় উৎপাদক বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সে এ ক্ষতি লাঘবের জন্য মূল্য বেশি নিতে চেষ্টা করবে এবং তা চাহিদা ও যোগানের স্বাভাবিক নীতি। এমতাবস্থায় মূল্য নির্ধারণ করে চাহিদা ও যোগানের স্বাভাবিক নীতিকে বাধাগ্রস্ত করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। তবে যদি ব্যবসায়ীমহল এমন কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়, যা বাজারের স্বাভাবিক বিধিকে অকেজো করে দেয় এবং বাজারদরের উপর গুটিকতেক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ ও দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে সরকার সাময়িকভাবে নির্দিষ্ট পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে সমস্যার সমাধান করতে পারবে। বরং তা শুধু সরকারের অধিকার নয়, কর্তব্যও বটে। যেহেতু ব্যবসায়ীমহল অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে বাজারে স্বাভাবিক বিধিকে প্রভাবিত করেছে, তাই অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে তাদের এ অপকর্মের প্রতিকার করা যুক্তিযুক্ত। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ফকীহ আল-হাছকাফী (মৃ. ১০৮৮ হি.) রহ. বলেন, কোন শাসক মূল্য নির্ধারণ করবেন না। তবে মালিকরা ভারসাম্যপূর্ণ মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য দাবি করলে, তিনি বিজ্ঞ লোকদের সাথে পরামর্শক্রমে মূল্য নির্ধারণ করবেন। ইমাম আবুল হাসান আল-মাওয়ার্দী (মৃ. ৪৫০ হি.) বলেন, রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব হলো সাধারণের কল্যাণ সুনিশ্চিত করা। মূল্যস্ফীতির সময় তাস’য়ীর (মূল্যনির্ধারণ) উপকারী মনে হলে, তিনি তা করতে পারেন। ইমাম ইবনুল কাইয়িম (মৃ. ৭৫১ হি.) বলেন, ন্যায়সঙ্গত তাস’য়ীর (মূল্যনির্ধারণ), যাতে ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রিতে বাধ্য করা হয় এবং ন্যায্য মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রিতে নিষেধ করা হয় তা বৈধ: বরং কর্তব্য।
যদি একান্তই মূল্যনির্ধারণ করতে হয়, তাহলে কিছু পদ্ধতি ও শর্তাবলি পূরণ করতে হবে। যেমন, (১) নির্দিষ্ট দ্রব্যের প্রতি জনগণের ব্যাপক প্রয়োজন থাকতে হবে। (২) মূল্য নির্ধারণের সময় বিক্রেতার স্বার্থের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। (৩) মূল্য নির্ধারণের জন্য ভোক্তা, উৎপাদক, ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও বাজার সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। তাঁরা পর্যাপ্ত যাচাইয়ের পর ভোক্তা-উৎপাদক-ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের স্বার্থ সংরক্ষিত হয় এমন একটি মূল্য নির্ধারণ করবেন। (৪) নির্ধারিত মূল্য একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কার্যকর রাখা হবে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তা রহিত করা হবে। (৫) খাদ্যসহ সকল ধরনের পণ্যে প্রয়োজনবোধে তাস’য়ীর বৈধ হবে। (৬) মূল্যবৃদ্ধি কৃত্রিম সংকটের কারণে হতে হবে। প্রাকৃতিক কারণে দ্রব্যের অভাবহেতু মূল্য বৃদ্ধি পেলে মূল্যনির্ধারণ করা যাবে না। (৭) ব্যবসায়ীরা ভারসাম্যপূর্ণ মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য দাবি করলে তাস’য়ীরের আশ্রয় নেয়া হবে। (৮) কেউ কম মূল্যে বিক্রি করলে তাকে তাস’য়ীর দ্বারা বেশি মূল্যে বিক্রিতে বাধ্য করা যাবে না। কারণ, তাতে জনগণ লাভবান হয় এবং যোগান ও চাহিদার স্বয়ংক্রিয় বিধি কার্যকর থাকে। অনেক সময় পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে বিক্রেতাকে কম মূল্যেও বিক্রি করতে হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্ধারণ

২৭ জানুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন