Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

হুমকিতে ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদ

| প্রকাশের সময় : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মিজানুর রহমান তোতা : শুষ্ক মৌসুমে নদ-নদী, খাল-বিল ও পুকুর থাকে প্রায় পানিশূন্য। পানির চাহিদা মিটাতে হয় ভূগর্ভস্থ পানিতে। সারাদেশে কৃষি সেচ, শিল্প ও ঘর-গৃহস্থালিতে প্রায় ৮০ লাখ গভীর, অভীর নলকুপ, পাওয়ার পাম্প ও টিউবওয়েল ব্যবহার হয়। এতে মারাত্মকভাবে চাপ পড়ছে মাটিরতলার পানিসম্পদের উপর। কিন্তুু ভুগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের একটা নীতিমালা করা হলেও কার্যকর হয়নি। যার জন্য অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ও ব্যবহার দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। বিএডিসি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও হাইড্রোলজি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সুত্র, উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এবারের শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই অধিকাংশ এলাকায় ভুগর্ভস্থ পানির স্তর ১৫ থেকে ২০ ফুট নীচে নেমে গেছে। আর ৫ফুট নীচে নামলে অগভীর নলকুপগুলোতে পানি উত্তোলন কঠিন হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
সুত্রমতে, একদিকে সারফেস ওয়াটারের মারাত্মক সংকট। আবার আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটারও কমে আসছে। প্রতিটি শুষ্ক মৌসুম এলে এটা টের পাওয়া যায়। পানির জন্য পড়ে হাহাকার। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন পরিকল্পনা নেই। শুষ্ক মৌসুমে এর মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণে। মাটিরতলার মূল্যবান পানি সম্পদ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে। এবারও তার ব্যতয় ঘটছে না। যার জন্য ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদ রক্ষার্থে যে নীতিমালা করা হয়েছে তা কার্যকর অত্যন্ত জরুরী বলে কৃষি ও পানি বিশেষজ্ঞগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সুত্রমতে, ভূপৃষ্ঠের পানির ঘাটতি পুরণে পাল্লা­ দিয়ে চলছে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন। যার প্রায় ৪০ ভাগ অপচয় হচ্ছে। ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় রেখে ফ্রি-স্টাইলে পানি উত্তোলন বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তা না হলে নীরবে দেশের মূল্যবান সম্পদ ধ্বংসের চরম সীমায় পৌছাবে। যা কোনভাবেই পুরণ করা সম্ভব হবে না। সুত্র জানায়, কৃষি সেচ ও ঘর-গৃহস্থালিসহ সকল ক্ষেত্রেই পানির যে ব্যবহার বর্তমানে হচ্ছে তার প্রায় ৮০ ভাগই ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নীতিমালা কার্যকর না হওয়ায় সেচ ব্যবস্থাটা চলছে সম্পুর্ণ অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে।
সেচ নির্ভর বোরো আবাদে পানি উত্তোলন ও ব্যবহার চিত্র দেখার দায়িত্ব মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের। তারা কখনোই এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নেন না বলে কৃষকদের অভিযোগ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্র জানায়, এগ্রিকালচার ইনফরমেশন সার্ভিস (এআইএস) থেকে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মতামত সংগ্রহ করা হয় বেশ আগে। কিন্তু ভুগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ও ব্যবহারের এখনো কোন চুড়ান্ত নিয়মনীতি করা হয়নি। একজন পানি বিশেষজ্ঞ জানান, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কৃষি সেচের জন্য পানি উত্তোলন করতে হলে নিয়মনীতি মানতে হয়। পরিকল্পিতভাবে পাকা ড্রেন তৈরী, পানি শুধুমাত্র যাতে জমিতে যায়, কোনভাবেই অপচয় না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটে উল্টো। সুত্র জানায়, দেশে প্রায় ৯০ লাখ হেক্টর আবাদযোগ্য জমির সিংগভাগই শুষ্ক মৌসুমে সেচনির্ভর চাষাবাদ হয়ে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ১৭ লাখ গভীর, অগভীর ও পাওয়ার পাম্প ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন হয়। এছাড়া ঘর-গৃহস্থালিতে ব্যবহারের জন্য দেশে প্রায় ৬০ লাখ টিউবওয়েল ও পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন হয়ে থাকে। এর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছেই।
বিএডিসি (সেচ) সুত্র জানায়, প্রতিটি ডিপ টিউবওয়েলে প্রতি সেকেন্ডে ২ কিউসেক ও শ্যালো টিউবওয়েলে শূন্য দশমিক ৫ কিউসেক পানি উত্তোলন হয়। যার প্রায় ৪০ শতাংশ অপচয় হচ্ছে নানা কারণে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর, বিএডিসি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, কৃষি সেচ, শিল্প ও ঘর-গৃহস্থালিসহ সকল ক্ষেত্রেই পানির যে ব্যবহার বর্তমানে হচ্ছে তার প্রায় ৮৫ ভাগই ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। দেশে প্রায় ১৪ হাজার মাইল দৈর্ঘ্য ২শ’ ৬০টি ছোট-বড় নদী রয়েছে। বড় খাল রয়েছে প্রায় ২০ হাজার। কয়েক বছর আগেও নদ-নদী ও খাল-বিল থেকে দোনা ও সেউতি পদ্ধতিতে একটা অংশের আবাদী জমিতে সেচের পানি ব্যবহারের সুযোগ পেত কৃষকরা। এখন সেই সুযোগ নেই। চলতি বোরো মৌসুমেও চাষাবাদের সেচ পুরোটাই মাটিরতলার পানি উত্তোলন হচ্ছে। সুত্র জানিয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের নীতিমালা করে যদি ‘সারফেস ওয়াটার’ বৃদ্ধি ও রাজশাহীর বরেন্দ্র প্রকল্পের আদলে সরকারীভাবে ‘সেচ কমান্ড এরিয়া’ গঠন করা যায় তাহলে সেচের পানির অপচয় তো হবেই না, উপরন্তু কৃষকরা বিরাট লাভবান হবে। সেচযন্ত্র থেকে পানি উত্তোলন করে বারিড পাইপ অর্থাৎ আন্ডারগ্রাউন্ড দিয়ে পাইপের সাহায্যে আশেপাশের জমিতে সেচের পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া হলে প্রতি বিঘায় সেচ খরচও নেমে আসবে অর্ধেকের কমে।
বিএডিসি মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ফজলে রাব্বি জানান, এর আগে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ও ব্যবহারের একটা নীতিমালা ছিল। সেটি বিশেষ কারণে অকার্যকর হয়ে পড়ে।
জানা যায়, ১৯৮৫ সালের দিকে সরকারী একটা নিয়মনীতি ছিল যে একটি ডিপ টিউবওয়েল থেকে আরেকটি ডিপ টিউবওয়েলের দুরত্ব কমপক্ষে ২ হাজার ৫শ’ ফুট এবং ডিপ টিউবওয়েল থেকে ১ হাজার ৭শ’ ফুট দুরত্বে শ্যালো টিউবওয়েল স্থাপন করতে হবে। একইভাবে একটি শ্যালো থেকে আরেক শ্যালোর দুরত্ব থাকতে হবে কমপক্ষে ৮শ’ ফুট। সেই নিয়মনীতি এখন আর নেই। সেচ স্থাপনের ক্ষেত্রে যে যার সামর্থ অনুযায়ী জমির আইলে ডিপ, শ্যালো কিংবা পাওয়ার পাম্প স্থাপন করে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছে। গ্রাম্য কোন্দলের কারণে কোথাও কোথাও দেড়/দুইশো’ ফুট দুরত্বেও ডিপ কিংবা শ্যালো টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। সবখানে সমানতালে রীতিমতো পাল্লা দিয়ে পানি উত্তোলনের হিড়িক পড়েছে। আবাদী জমির ফসল রক্ষার্থে যতটুকু পানির প্রয়োজন তার অনেক বেশী পানি উত্তোলন হচ্ছে বলে মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। যার একটা বড় অংশ অপচয় হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পানিসম্পদ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ