Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কারান্তরীণ খালেদা জিয়া বিএনপির করণীয়

মহিউদ্দিন খান মোহন | প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কারান্তরীণ হওয়ার পর দেশের রাজনীতির চালচিত্র অনেকটা যেন বদলে গেছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তার পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়েছে গত ৮ ফেব্রুয়ারি। ওইদিনই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি পরিত্যাক্ত ভবনে। এখনো তিনি সেখানেই আছেন। অবশ্য প্রথমে তাকে একজন সাধারণ কয়েদীর মতো রাখা হলেও পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিগত জরুরি অবস্থার সরকারের আমলে দায়ের করা এ মামলাটি নিয়ে গত দশ বছর বিস্তর কথা হয়েছে। বেগম জিয়ার আইনজীবীরা বলেছিলেন, যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। যে তহবিলের টাকা তছরুপের কথা মামলায় বলা হয়েছে তা আদৌ তছরুপ হয়নি। বরং ব্যাংকে রাখা সে টাকা সুদে আসলে তিনগুণ হয়েছে। বিএনপি এ রায়কে প্রত্যাখ্যান করে যুগপৎ আইনী লড়াই এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছে।
আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে জনমনে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। বেশিরভাগ মানুষ ধরেই নিয়েছিল যে, রায় ঘোষণার দিন বিএনপি রাজধানীতে ব্যাপক শো ডাউন করবে এবং রায় বিপক্ষে গেলে তারা তাৎক্ষণিক তীব্র প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে। অন্তত বিএনপি নেতাদের বক্তব্য বিবৃতি থেকে তেমন ধারণা হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। তবে, শেষ পর্যন্ত তারা রায়ের পরে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেনি, রাজপথে সহিংস কোনো কর্মসূচি দেয়নি। বরং রায়ের দিন বেগম খালেদা জিয়া আদালতে যাবার সময় রাজধানীর মগবাজার থেকে তার গাড়ি বহরের পাশে নেতাকর্মীদের যে বিপুল সমাগম দেখা গিয়েছিল, রায়ের পর তাদের তেমন কোনো সরব উপস্থিতি কোথাও দেখা যায়নি। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, রায় ঘোষণার পর কারাগারে যাবার আগে বেগম খালেদা জিয়া দলের নেতাকর্মীদের শান্ত থাকার আহবান জানিয়ে গেছেন। নেতাকর্মীদের তিনি কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছেন। দৃশ্যমান বাস্তবতায় বিএনপি নেতাকর্মীরা তাদের নেত্রীর সে নির্দেশ মেনে চলছে। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল ও মানব বন্ধন এবং অনশনের মতো অহিংস কর্মসূচির মধ্যেই তাদের প্রতিবাদ সীমিত রেখেছে।
অন্যদিকে সরকার দৃশ্যত কিছুটা নমনীয় ভাব দেখালেও কার্যত অত্যন্ত কঠোর অবস্থানেই আছে। রায়ের দিন কাকরাইল শাহবাগ এলাকায় বিএনপি কর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হলেও সেটা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেনি। বরং সেদিন পুলিশকে অনেকটাই ধৈর্যশীল দেখা গেছে। যেখানে পান থেকে চুন খসলেই পুলিশ সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেখানে ওইদিন তারা পরিস্থিতি যাতে শান্ত থাকে সে চেষ্টাই যেন বেশি করেছে। এর কারণ হিসেবে অনেকে মনে করছেন, বেগম খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরকে প্রহরা দিয়ে আদালতে নেয়ার জন্য পুলিশ সহনশীল ভূমিকা পালন করেছে। বেগম জিয়ার গাড়ি বহরকে মাঝে রেখে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, পুলিশের সজাগ দৃষ্টি ছিল সেদিকে। কোনো অঘটন ঘটে গেলে তার দায় চাপতো পুলিশের ওপর। সে জন্যই পুলিশ সেদিন অনেকটাই সহনশীলতা দেখিয়েছে। তবে, সরকার যে কঠোর অবস্থানে আছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে রায় ঘোষণার সপ্তাহ খানেক আগে থেকে এখনও পর্যন্ত ধরপাকড় অব্যাহত রাখা। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, গত দুই সপ্তাহে সারা দেশে তাদের প্রায় সাড়ে চার হাজার নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
বেগম খালেদা জিয়ার এ মামলার রায় ঘোষণার আগেই যে প্রশ্নটি বেশ জোরেশোরে উঠেছিল, তাহলো, যদি তিনি কারারুদ্ধ হন তালে দলের নেতৃত্ব কে দেবেন। সে প্রশ্নেরও মীমাংসা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বেগম জিয়ার অনুপস্থিতিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের নেতৃত্ব দেবেন। তবে, যেহেতু তিনি এ মুহূর্তে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন, তাই তার সঙ্গে পরামর্শ করে সিনিয়র নেতৃবৃন্দ দলের সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনা করবেন।
যে শঙ্কা জনমনে দানা বেঁধেছিল তা শেষ পর্যন্ত সত্য না হওয়ায় দেশবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। বেগম খালেদা জিয়া জামিন নিয়ে কবে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তার বিরুদ্ধে আরো অনেক মামলা রয়েছে এবং সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকেটিতে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি আছে। গণমাধ্যমে এ মর্মে খবর বেরিয়েছিল যে, ইতোমধ্যে তিনটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো (শ্যোন অ্যারেস্ট) হয়েছে যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তা অস্বীকার করেছেন। গত ১৩ ফেব্রæয়ারি তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়াকে অন্য কোনো মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়নি। তবে, ভেতরের খবর হলো, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অন্যান্য মামলায় অন্তত আরো চারটি গ্রেফতারি পরোয়ানা কারাগারে পৌঁছে গেছে। তবে, সরকার এখনই তা প্রকাশ বা কার্যকর করবে না। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আপিলে বেগম জিয়ার জামিন হলে মুক্তির আগে জেল গেটে আবার তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে পরোয়ানা দেখিয়ে। সুতরাং অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, আপিলে জামিন হলেও কারাগার থেকে বেগম জিয়ার বেরিয়ে আসতে বিলম্ব হবে।
রাজনৈতিক অভিজ্ঞমহল মনে করছে, বিএনপিকে ব্যতিব্যস্ত রেখে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী মাঠে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নীলনকশা আঁটছে। গত ১২ ফেব্রæয়ারি পত্রিকান্তরে এক প্রতিবেদনে সে ছকের কথাই তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী কয়েক মাস বিএনপিকে দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মামলা ও জামিন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। একই সঙ্গে দলের বেশিরভাগ নেতাও নিজ নিজ মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। সেই সাথে পুরনো মামলায় সরকার গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রাখছে। এর ফলে বিএনপি রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সাংগঠনিক তৎপরতা নির্বিঘেœ চালাতে পারবে না। আর সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বেগম জিয়ার মুক্তি কিংবা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে তেমন শক্ত কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না। আওয়ামী লীগ মনে করছে, এ অবস্থায় নির্বাচনে এলেও বিএনপি ঘর গুছিয়ে উঠতে পারবে না। ফলে অগোছালো বিএনপিকে পরাজিত করে নির্বাচনে জয় কেড়ে নেয়া তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হবে না।
বিএনপি নেতারা আগে থেকেই বলে আসছেন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে ছাড়া দলটি নির্বাচনে যাবে না। তারা বলছেন যে, দলীয় নেত্রীর মুক্তি দাবিতে তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাবেন এবং তিনি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। তবে, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, বিএনপির সে আন্দোলন তেমন একটা কার্যকর হবে না। কেননা, বেগম জিয়ার মুক্তি দাবিতে তারা যতই আন্দোলন করুক, আদালতের নির্দেশ ছাড়া সেটা পাবার উপায় নেই। রাজপথের আন্দোলনে আদালতের সিদ্ধান্ত বদলের নজির খুব একটা নেই। আর নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে বিএনপি কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে কী না তা সেটা কেবল সময়ই বলতে পারে। যে ধরনের সর্বাত্মক আন্দোলন, যাকে গণঅন্দোলন বলা হয়, তা গড়ে তোলার মতো সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিও বিকল্প নেই। সেটা অস্বীকার করা যাবে না।
গুঞ্জন রয়েছে যে, বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে থাকা অবস্থায় বিএনপিকে দ্বিধা বিভক্ত করার নীল-নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকার বিএনপিকে ভাঙ্গার জন্য নীল-নকশা আঁটছে এমন অভিযোগ বিএনপির পক্ষ থেকে অনেক বারই করা হয়েছে। যদিও ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। বরং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি একটি বড় দল। আমরা চাই না সেটা ভাঙুক। এই চেষ্টাও আমরা করব না। তবে, অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, ওবায়দুল কাদের মুখে যাই বলুন, ভেতরে ভেতরে তারাও চান বিএনপি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাক।
এটা সত্যি যে, বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাবার পর তার প্রতি মানুষের সহানুভূতি অনেক বেড়েছে। পথে-ঘাটে কান পাতলে এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের অভিব্যক্তির একটা আভাস পওয়া যায়। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার পরিচালনা কিংবা দলের নেতৃত্ব নিয়ে কারো কারো প্রশ্ন থাকলেও তার এ কারাবাস অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। ফলে গত এক সপ্তাহে বেগম জিয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশের মধ্যে যে সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছে, তা তার জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটারে নতুন মাত্রা যুক্ত করতে পারে। তার এই জনপ্রিয়তা দলের জন্য সম্পদ। তাকে কাজে লাগানো জন্য দলের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ, সক্রিয় ও তৎপর থাকতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার এক সুগভীর নীল-নকশার কার্যক্রম চলছে। সে নীল-নকশাকে প্রতিহত করতে বিএনপি নেতাকর্মীদের ইস্পাত কঠিন সংহতি ও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।



 

Show all comments
  • Jewel Haque ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ৪:৫৯ এএম says : 0
    বিএনপি নেতাকর্মীদের ইস্পাত কঠিন সংহতি ও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Saiful Alam ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১১:২৮ এএম says : 0
    মহান আল্লাহ তায়ালা আপনার সহায় হবেন, ইনশা আল্লাহ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খালেদা জিয়া

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন