Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রাম বন্দরের সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণে বাড়ছে জটিলতা

| প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

শফিউল আলম : চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি ও রফতানিমুখী পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিং (ওঠানামা) বার্ষিক গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কন্টেইনার ও খোলা সাধারণ (ব্রেক বাল্ক) কার্গো উভয় ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই বছর বছর নিরবচ্ছিন্ন প্রবৃদ্ধি ঘটছে। তবে প্রবৃদ্ধির সাথে সমানতালে বাড়ছে না দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা। বরং পণ্যের চাপ ও চাহিদার তুলনায় সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে অবকাঠামো।
ক্রমেই সক্ষমতা ও দক্ষতা হারাচ্ছে বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়ন ও স¤প্রসারণের লক্ষ্যে গৃহীত সর্ববৃহৎ পরিকল্পনা ‘বে-টার্মিনাল’ বাস্তবায়নে পদে পদে নানামুখী বাধা-বিপত্তি, দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতা হচ্ছে। অথচ পতেঙ্গা-হালিশহরের সমুদ্র উপকূলের নতুন চর ঘেঁষে গভীর চ্যানেলে প্রস্তাবিত বে-টার্মিনাল নির্মাণে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত। লালদিয়ায় প্রস্তাাবিত কন্টেইনার টার্মিনাল প্রকল্প বন্দরের নাকি বেসরকারি খাতে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে থাকবে তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বন্দর ব্যবহারকারী তথা স্টেক হোল্ডারদের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে বন্দরের পুরনো জেটি-বার্থসহ ১৬টি ঘাটের সংস্কার ও যুগোপযোগী আধুনিকায়ন করা হোক। তাহলে বন্দরের অবকাঠামো স্বল্পতা কিছুটা লাঘব হবে। অন্যদিকে বে-টার্মিনাল, লালদিয়া টার্মিনাল ও অন্যান্য প্রকল্প বা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন গতিশীল হবে এমনটি আশাবাদী চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর সংলগ্ন বহির্নোঙরে বঙ্গোপসাগরের বুকে ভাসমান কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই ফ্লোটিং টার্মিনাল নির্মিত হলে জাহাজ সাগরে অবস্থানকালেই কন্টেইনার ওঠানামা এবং নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে। বিশেষত নারায়নগঞ্জের পানগাঁও টার্মিনালে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কন্টেইনারের ছোট ফিডার জাহাজে পণ্য আনা-নেয়া সহজ হবে। এখন বহির্নোঙর এলাকায় বড়সড় (মাদার ভেসেল) জাহাজ থেকে খোলা কিংবা বস্তাজাত মালামাল লাইটারিং খালাস করা হয়। দেশে সর্বপ্রথম ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণে কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘পাবলিক ডোমেইন আর্কিটেক্টেন’র সাথে গত ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ‘টেকনো ইকোনমিক ফিজিবিলিটি স্টাডি অব অ্যা ফ্লোটিং হারবার অ্যাট দ্য আউটার এরিয়া ইন চিটাগং পোর্ট’ শীর্ষক এই সম্ভাব্যতা যাচাই কাজে বাংলাদেশে লোকাল এজেন্ট ‘বেঙ্গল ডাচ ইন্টারন্যাশনাল’। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ব্যয় হবে প্রায় ৮ কোটি টাকা। ৬ মাসের মধ্যে তারা কারিগরি ও আর্থিক সমীক্ষা প্রতিবেদন দাখিলের কথা রয়েছে।
দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি ও রফতানি বাণিজ্য চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। দৈনিক শত শত কোটি টাকার হরেক ধরনের পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিং করা হয়। এর মাধ্যমে সরকারের সার্ভিস চার্জ ও রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দরে বিদায়ী ২০১৭ সালে রেকর্ড পরিমাণ আমদানি-রফতানি কন্টেইনার ওঠানামা হয়েছে। এ সময় ২৫ লাখ ৬৩ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার (প্রতিটি ২০ ফুটের একক হিসাবে) হ্যান্ডলিং করা হয়। গত ২০১৬ সালে হ্যান্ডেল হয় ২৩ লাখ ৪৬ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার, বিগত ২০১৫ সালে ২০ লাখ ২৪ হাজার, ২০১৪ সালে ১৭ লাখ টিইইউএস কন্টেইনার। এভাবে বছর বছর প্রবৃদ্ধি ঘটছে। কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ২০১৫ সালে ১৯ শতাংশ, ২০১৬ সালে ১৬ শতাংশ ও ২০১৭ সালে তা প্রায় ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। খোলা সাধারণ মালামাল হ্যান্ডলিং ও পরিবহনের পরিমাণ বার্ষিক প্রায় সাড়ে ৮ কোটি মেট্রিক টন। সর্বক্ষেত্রে বন্দরের পণ্যসামগ্রী বৃদ্ধির চাপ ও চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু মৌলিক, ভৌত অবকাঠামো সুবিধা, সক্ষমতা, দক্ষতা সেই হারে বাড়ছে না। বরং সীমিত হয়ে এসেছে। জেটি-বার্থ, টার্মিনালের ঘাটতিই সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা।
চট্টগ্রাম বন্দরের যুগোপযোগী আধুনিকায়ন ও স¤প্রসারণের লক্ষ্যে ‘বে-টার্মিনাল’ প্রকল্প-পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। তবে বাস্তবায়ন কাজ চলছে অতি ধীরগতিতে। পড়েছে আমলাতান্ত্রিক ও বিভিন্নমুখী জটিলতায়। দেশের প্রধান চট্টগ্রাম বন্দর স¤প্রসারণের লক্ষ্যে পরিপূরক প্রকল্প হিসেবে বৃহৎ অবকাঠামো প্রস্তাবিত ‘বে-টার্মিনাল’। বন্দরে কন্টেইনারসহ খোলা পণ্য এবং জাহাজবহর হ্যান্ডলিংয়ের ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে। এরজন্য বে-টার্মিনালকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্যবহারকারীরা। বিগত ৭ ডিসেম্বর’১৫ইং প্রকল্পের চিহ্নিত ভূমি অধিগ্রহণের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে অনাপত্তি পত্র দেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এরপরও ভূমির মালিকানা, মূল্য নিয়ে একের পর এক বিরোধ ও জটিলতায় এর বাস্তবায়ন থমকে আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো বে-টার্মিনাল প্রকল্প যদি বাস্তবায়ন না হয় তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ও পণ্যসামগ্রী ধারণ এবং ওঠানামা সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। কন্টেইনারসহ কার্গোজট ও জাহাজজট এক জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
বে-টার্মিনাল নির্মাণে কারিগরি সমীক্ষা পরিচালনা করে জার্মানির হামবুর্গ বন্দরের এইচপিসি শেলহর্ন-কেএস কনসালটেন্ট জেভি। গত ১৭ আগস্ট’১৬ইং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তির পর ইতোমধ্যে সাগর-উপকূলভাগের হাইড্রোগ্রাফি সমীক্ষা চালায়। জার্মান প্রতিষ্ঠানটির বিশেষজ্ঞরা বন্দরের কাছে দেওয়া সমীক্ষার তথ্য-উপাত্তে নতুন স¤প্রসারিত সমুদ্র বন্দর স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিকভাবে সুবিধা বিদ্যমান থাকা এবং এর সাথে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিষয়ও তুলে ধরেন।
পতেঙ্গা-হালিশহরে সাগরের কিনারভাগে জেগে ওঠা চর, এরসাথে লাগোয়া চ্যানেলকে ঘিরে বন্দর কর্তৃপক্ষ স¤প্রসারিত বন্দর বে-টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। প্রকল্পের জন্য ৯০৭ একর ভূমি চিহ্নিত করা হয়। এরমধ্যে ৭০ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন। বাদবাকি ভূমি সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত অকৃষি জমি। ব্যক্তি মালিকানার ভূমি বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যয় মিটিয়ে অধিগ্রহণের প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু সরকারি মালিকানার সাড়ে ৮শ’ একর ভূমি সরকারের পক্ষ থেকেই হ্রাসকৃত প্রতীকি মূল্যে বরাদ্দ লাভের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ সুরাহা খুঁজছে। প্রকল্পস্থলে ভূমির একাংশ বন বিভাগের। তারা বলছে, ভূমি হস্তান্তরে ‘ডি-রিজার্ভেশনে’র প্রয়োজন হবে। ‘বে-টার্মিনাল’ প্রকল্পে সিডিএ’র অনাপত্তিকৃত মোট ৯০৬ দশমিক ৪২ একর ভূমির মধ্যে উত্তর পতেঙ্গা ও দক্ষিণ হালিশহরে অবস্থিত ৪৬৪ দশমিক ৭৫ একর ভূমি বন বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত এলাকা। তবে এ বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনের এলএ শাখা, বন বিভাগ এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের মধ্যকার চিঠি চালাচালি চলছে।
চট্টগ্রাম বন্দর অবকাঠামোর খুব কাছেই বঙ্গোপসাগর উপকূলে পতেঙ্গা-হালিশহরে বড় আকারের জাহাজ ভিড়ার উপযোগী গভীরতা (চ্যানেলের ড্রাফট) রয়েছে। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের খেজুরতলার বিপরীত থেকে কাট্টলী পর্যন্ত অংশে পলি জমে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি চর সৃষ্টি হয়েছে। সাগর থেকে গত আড়াই-তিন দশকে ক্রমে জেগে ওঠে এই ভূমি। সেখানে বে-টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগটি নেয়া হয়েছে। এর অপারেশনাল এরিয়ার আয়তন ৩৩৫ একর। বে-টার্মিনাল প্রকল্পস্থলের আয়তন তিনগুণের কাছাকাছি। এই চর ও উপকূলের মাঝামাঝি ৮শ’ মিটার প্রশস্ত জায়গায় জাহাজ চলাচলের পথ বা চ্যানেল তৈরি হয়ে আছে প্রকৃতিগতভাবেই। এর গভীরতা ৬ থেকে ৯ মিটার পর্যন্ত। ড্রেজিং হলে ১২ মিটার পর্যন্ত ড্রাফটের বড়সড় দৈর্ঘ্যরে অনেকগুলো জাহাজ একযোগে ভিড়ানো যাবে। এখন বন্দরে সর্বোচ্চ ১৮শ’ টিইইউএস কন্টেইনারবাহী ফিডার জাহাজ ভিড়তে পারে। বে-টার্মিনালে ৫ হাজার কন্টেইনারবাহী বড় জাহাজ ভিড়তে সক্ষম হবে। একই সাথে খোলা পণ্যবাহী বড় জাহাজও ভিড়বে। চট্টগ্রাম বন্দরে এখন সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের এবং ১৯০ মিটার পর্যন্ত দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ভিড়তে পারে। তাও জাহাজের আসা-যাওয়া জোয়ারের সময়ের উপর নির্ভরশীল। ‘বে-টার্মিনাল’ এলাকায় জোয়ার-ভাটায় ২৪ ঘণ্টা জাহাজ চলাচল, ভিড়ানো ও ঘোরানো সম্ভব হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ আশা করছে, ভূমির জটিলতা নিরসন হলে বে-টার্মিনালের ভৌত ও কারিগরি অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রথম ধাপে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে।
চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেছেন, দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যকে গতিশীল করার জন্য অনতিবিলম্বে বে-টার্মিনাল এবং আরও বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। কেননা দেশের প্রধান এই বন্দর অবকাঠামো সুবিধার ক্ষেত্রে তীব্র ঘাটতির মধ্যদিয়ে চলছে। এটিকে সরকারের ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা, সক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। সার্বিকভাবে বন্দরব্যয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা পরিচালনায় ব্যয় আরো সাশ্রয় হবে।



 

Show all comments
  • লাবণী ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ৩:১২ এএম says : 0
    জটিলতার অবসান চাই
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ